Cinque Terre

সুমন বনিক

২৩ মে , ২০২০


কবি ও ব্যাংকার


করোনাকালে জীবন ও জীবিকা

‘মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে/ মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই/ এই সূর্যকরে এই পুষ্পিত কাননে / জীবন্ত হৃদয় মাঝে যদি স্থান পাই’। মানুষের বাঁচার আকুতি ঠিক এরকমই।

বেঁচে থাকার জন্যে মানুষ প্রাণান্ত চেষ্টা করে। যে মানুষটি সাঁতার কাটতে জানে না ; সেও জলে পড়লে খড়কুটো ধরে বাঁচার চেষ্টা করে। মানুষ কেনো বেঁচে থাকতে চায়? উত্তরটি এভাবে বলা যায় ; মানুষ জীবন উদযাপনের প্রতিটি বাঁকে বাঁকে সন্ধান করে এতটুকু শান্তি। যা তাঁর জীবনকে উদযাপনের খোরাক জোগায়। মানুষ জীবনকে উপভোগ করতে চায়, ভোগে অথবা ত্যাগে কিংবা ভোগ এবং ত্যাগের মিশেলে। নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও মানুষ দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে মুক্তি পেতে চায়। শুধুমাত্র জীবনকে উদযাপনের জন্যে। তাই বেঁচে থাকার জন্যে জীবিকা নির্বাহের প্রয়োজন সঙ্গতভাবেই এসে যায়। 

করোনাকালে এরকম একটি প্রশ্ন এসে দাঁড়িয়েছে মানুষের সামনে। জীবন আগে না জীবিকা আগে। কেউ কেউ বলেন জীবনই যদি না থাকে, জীবিকা দিয়ে কী হবে। আবার কেউ কেউ এটাও ভাবেন যদি জীবিকা না-থাকে তাহলে জীবন বাঁচবে কেমন করে। দুটো যুক্তিই যুৎসই। মানুষ তো বৃক্ষ নয় ; তাই হাওয়া খেয়ে বাঁচতে পারেনা। ঘরে খাবার না থাকলে মানুষ কী মানবিক হতে পারে? প্রশ্নটার অনেক ব্যাপ্তি আছে বৈকি! অনেকে জীবনকে যুদ্ধের সঙ্গে তুলনা করে বলেন, জীবনযুদ্ধ। জীবন যুদ্ধে জয়ী যে মানুষ সেই তো প্রকৃত মানুষ। যদি তাই হয় ,তাহলে মানুষকে প্রতিটি মুহূর্তে যুদ্ধে নামতে হয়। এরকম একটি যুদ্ধে গোটা মানবজাতি আজ অবতীর্ণ।করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ।

এ এক অদ্ভুত যুদ্ধ। অদৃশ্য এক অনুজীবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। এই যুদ্ধের মূল রণকৌশল হচ্ছে নিজেকে ঘরে রাখা ,সামাজিক দৈহিক দূরত্ব বজায় রাখা, নিজেকে পরিচ্ছন্ন রাখা, জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বাইরে না-যাওয়া,সর্বোপরি স্রষ্টার করুনা প্রার্থনা করা। বেঁচে থাকার এইগুলোই বীজমন্ত্র। অনেকেই আছেন যারা অযথা এদিক সেদিক ঘোরাফেরা করেন। চায়ের দোকানে আড্ডায় মশগুল হন। কেউ কেউ এই দুঃসময়ে সাধারণ ছুটিকে নিছক আয়েসে ছুটি মনে করে ঘুরে বেড়ান। সেটি নেহায়েত বোকামি অজ্ঞতা ছাড়া কিছুই নয়। বুঝতে হবে এটা আপদকালীন ছুটি, ঘরে থাকার জন্যে। নিজেকে নিরাপদ রাখা অন্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। 

এখন প্রশ্ন উঠবে-ঘরে খাবার আসবে আকাশ ফোঁড়ে? না। আকাশ থেকে খাবার আসে না। অন্নের সংস্থান মানুষকে করতে হয়। এটাই প্রকৃতির নিয়ম। বিষয়টি একটু জটিল নিজেকে ঘরে রাখলে খাবার জুটবে কেমন করে ? উত্তরটি সহজভাবে ভাবলে খুবই সহজ। এই যুদ্ধ কিন্তু অনন্তকালের নয়। মাত্র কদিন নিজেকে গুটিয়ে রাখা। আমাদের অনেকেরই কয়েক সপ্তাহ খাদ্যের সংস্থান করার মতো সামর্থ্য রয়েছে। যারা সুবিধাবঞ্চিত ও ছিন্নমূল মানুষ তাদের পাশে সরকার এসে দাঁড়িয়েছে। ইতোমধ্যে ত্রাণ এবং প্রণোদনার কার্যক্রম চলছে। অনেক মানবিক চেতনা সমৃদ্ধ সংগঠন ও মানুষ তাদের সেবা প্রদান অব্যাহত রেখেছে। মনে রাখতে হবে এটি একটি যুদ্ধকালীন সময়। সুদিনের অপেক্ষায় আমারা দুর্দিন কাটাচ্ছি। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে আমারা অনেক নির্যাতন ,জলুম ,হত্যার মুখোমুখি হয়েছি। পাকিস্তান নামক এক দানবের বিরুদ্ধে শোষকের বিরুদ্ধে আমরা একটি অসমযুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলাম।

দীর্ঘ ন'মাস আমরা কী খেয়েছি ,কী পরিধান করেছি? সেইসব ইতিহাস আমরা ভুলিনি।

আমরা বিজয়ী বীর। আমরা বিজয় অর্জন করেছি একসাগর রক্ত অনেক ত্যাগ তিতিক্ষার বিনিময়ে। আমাদের কেউ দাবায়ে রাখতে পারে

 নাই। অতএব এই করোনাযুদ্ধে জয়ী হতে হলে আমাদেরকে জীবন যাপনের সাময়িক কষ্ট মেনে নিতে হবে।

স¤প্রতি এক ভার্চুয়াল মিটিংয়ে সিপিডির একজন নির্বাহী পরিচালক বলেছেন ‘আমরা মনে করি জীবনকে বাঁচাতে হবে আগে। তারপর জীবিকাও দরকার। জীবনই যদি না থাকে তাহলে জীবিকা দিয়ে কী প্রয়োজন। সুতরাং এ জন্য সুচিন্তিতভাবে পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।’

আমাদের দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ এখন উর্ধ্বমুখি। প্রতিদিন বাড়ছে মৃত্যু পথযাত্রীর সংখ্যা, লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে সংক্রমিত লোক। এই ক্রান্তিকালে লকডাউন নামক অস্ত্রের সম্বরণ হবে যুদ্ধের ময়দান থেকে পালিয়ে যাওয়া কিংবা আত্মহননের সামিল।

আমেরিকায় লকডাউন তুলে দিতে প্রেসিডেন্ট মরিয়া হয়ে উঠেছেন। ফলশ্রুতিতে সে দেশে মৃত্যু দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়েছে।

আমেরিকার মহামান্য রাষ্ট্রপতি যে অপকর্মটি করেছেন তার খেসারত দিচ্ছেন সেদেশের জনগণ। তাঁর বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ। প্রতিবাদ স্বরূপ নিউইয়র্কের রাস্তায় ঝোলানো হয়েছে ঞৎঁসঢ় উবধঃয ঈষড়পশ. অন্যদিকে ভিয়েতনাম,কিউবা,শ্রীলঙ্কা,নেপাল,ভ‚টান র মত দেশগুলো কঠোরভাবে লকডাউন প্রয়োগ করায় আজ স্বস্তিতে করোনাকাল মোকাবিলা করছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইড লাইন অনুসরণ করা আজ সময়ের দাবি। 

আমাদের সরকার বিশেষ করে আমাদের প্রধানমন্ত্রী অত্যন্ত দরদ দিয়ে এই করোনাকালে জনগণের জন্য দিনরাত সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। তাই সদাশয় সরকারের প্রতি জনগণের প্রত্যাশা সুচিন্তিতভাবে পদক্ষেপ গ্রহণ করে দেশ এবং জাতিকে এই মহামারী থেকে রক্ষা করা। অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে গিয়ে আমরা যেনো সংকটকে আরও ঘনীভ‚ত না করি। তাড়াহুড়ো করে লকডাউন তুলতে গিয়ে আমরা যেনো অন্ধকারে তলিয়ে না যাই। 

একটি সমন্বিত প্রয়াস আমাদেরকে বাঁচাতে পারে এই মহামারীর ছোবল থেকে। কিছু কিছু জায়গায় সরকারের ত্রুটি বিচ্যুতি রয়েছে,রয়েছে কিছু অমানুষের লোভ লালসা। 

এগুলো আমাদেরকে কাটিয়ে উঠতে হবে। এই ক্রান্তিকালে করোনাভাইরাসকে প্রতিরোধে বারবার যেনো আমরা ভুলের চোরাবালিতে পা না দিই।

যুদ্ধ বিধ্বস্ত একটি দেশ থেকে আজ আমরা পৃথিবীর উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে দাঁড়িয়েছে, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা। আমরা বীরের জাতি তাই আজ কোভিড নাইনটিনের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ চলছে এই যুদ্ধে আমরা জয়ী হবোই। আমাদের জীবনে মিশে আছেন রবীন্দ্রনাথ, চেতনায় নজরুল। তাই করোনাকালে আমাদের প্রত্যয় হোক : ‘সঙ্কোচের বিহŸলতা নিজেরে অপমান/ সঙ্কটের কল্পনাতে হয়ো না ম্রিয়মান’।