Cinque Terre

সঞ্জয় কুমার নাথ

২৫ মে , ২০২০


লেখক : গদ্যকার


আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে

কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে আমাদের পরিচয় হয় মুখে বুলি ফোটার পর থেকেই। আধো আধো কথার সঙ্গে থাকে তাঁর ছড়ার মিশেল। শিশু মনের দরজায় যে ছড়াটি প্রথম আনন্দের বার্তা নিয়ে আসে, সেটি-ভোর হলো/ দোর খুলো/ খুকুমনি ওঠরে/ ওই ডাকে/ জুঁই শাখে/ ফুলখুকি ছুটরে।

শৈশবে পাঠশালায় প্রতিটি শ্রেণিতে নজরুল আমাদের সঙ্গেই ছিলেন। তাঁর কবিতাগুলোইতো আমাদের ছন্দোবদ্ধ করেছে। কাঠবেড়ালী, লিচুচোর আরও কত কত ছড়া-কবিতা সাত থেকে আট-দশ বছর বয়সে থাকে আমাদের মুখস্তবিদ্যার অনুশীলন। তাঁর সুরের জাদুর ছড়াগানগুলো শিশুদের অবাক বিষ্ময় করা পছন্দের।

‘খোকার সাধ’ মুখস্ত করেননি, এমন কি কেউ আছেন? ‘আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে/ তোমার ছেলে উঠলে গো মা রাত পোহাবে তবে।’

কথাটির মানে তখন ছিল একরকম, এখন অন্যরকম। এই কবিতার চরণগুলো বয়সের সঙ্গে কত সুন্দর ভাবে বদলায় অথচ লাইনগুলো ঠিকই আছে।

কৈশোরে আমরা শিখলাম-‘থাকব নাকো বদ্ধ ঘরে/ দেখব এবার জগৎটাকে/ কেমন করে ঘুরছে মানুষ যুগান্তরের ঘূর্ণিপাকে/... বিশ্বজগৎ দেখব আমি আপন হাতের মুঠোয় পুরে/।’

ভাবতে অবাক লাগে যখন নিজের মুঠোফোনের দিকে তাকাই, ভাবি কবি কত আগে তাঁর মতো লিখে গেছেন, অথচ মনে হয় আধুনিক প্রযুক্তি নিয়েই যেন তিনি লিখেছেন। আমরা যত এগিয়ে যাব আমাদের জাতীয় কবি আমাদের সঙ্গেই থাকবেন তাঁর সর্বকালীন অমর কবিতাগুলোর জন্য।

যৌবনের অহংকার ‘বিদ্রোহী’ কবিতা। তাঁর ছেলে সব্যসাচী এ কবিতাটিতে আরও জাদুর কাঠি ছুঁইয়েছেন। ‘বিদ্রোহী’ বাংলা সাহিত্যের অনন্য আর অসাধারন কবিতা। তেমনি আবৃত্তিও হয় হৃদয়ছোঁয়া। এখন আবৃত্তিশিল্পীরা বাংলা ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ এ কবিতাটি আবৃত্তি করেন বিভিন্ন অনুষ্ঠানে। কী অসাধারণ উচ্চারণ-‘বল বীর বল উন্নত মম শির’। এই কবিতায় কবি নানা ভাষার শব্দ ও উপাখ্যানের উদ্ধৃতি দিয়ে হিন্দু-মুসলমানের ধর্ম ও সংস্কৃতির অভিনব এক মেলবন্ধন করেছেন। নজরুলের মতো অসা¤প্রদায়িক মানুষ বাঙালির সাধনার ধন। তাঁর কাছে নারী পুরুষ ভেদাভেদ ছিল না। তিনি লিখেছেন-‘এ বিশ্বে যা কিছু চির কল্যানকর/ অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর।’ এমন চমৎকার উক্তি কে করেছে কবে?

নজরুল রবীন্দ্রনাথের গান ভীষণ পছন্দ করতেন। সব অনুষ্ঠানে তিনি কবিগুরুর গানও গাইতেন। অথচ প্রায় তিন হাজার গান রচনা করে এই ‘জাতকবি’ জানিয়ে দিলেন তিনি এসেছেন বাঙ্গালিকে সুরের ভুবনে বেঁধে রাখতে। সুখে-দুখে চিরদিনের বাঁধনে।

নজরুলের ‘মানুষ’ কবিতা পাঠ করলে পাষাণ হৃদয়ও মানবতার কথা একবার হলেও ভাববে। সাম্যের সহজ পাঠ এর চেয়ে আর কী হতে পারে! তিনি ধর্মের নামে অধার্মিকদের মুখোশ উন্মোচন করেছেন শক্ত কলমে। তাঁর মানবতা বোধ ছিল বিশ্বজনীন।

কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন নবকল্লোলের সাম্যের কবি। উনিশ শতকের নবজাগরণ তাঁকে নাড়া দিয়েছিল গভীর আন্তরিকতায়। সৈনিক জীবনকে তাই আবিষ্কার করেছিলেন অপ্রতিহত পৌরুষ আর উদ্দাম হৃদয়াবেগের মধ্যে। প্রথম বিশ^যুদ্ধের ফলে যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংকট বিশ^সংকট হয়ে দেখা দেয়েছিল, তার ভয়াল ছায়া ছড়িয়ে পড়েছিল ভারতবর্ষ জুড়েও।

সর্বনাশের গ্রন্থি মোচনে বহ্নিদীপ্ত আবেগে দিয়ে তাই নতুন যুগের যুবসমাজকে ডাক দিয়েছিলেন কবি-‘বন্ধু গো তোল শির / তোমারে দিয়াছি বৈজয়ন্তী / বিংশ শতাব্দীর’। এই নতুন যুগের চেতনায় ধর্মে ধর্মে, নারী-পুরুষে, জাতিতে জাতিতে ভেদাভেদ নেই।’

আদি অন্তহীন চেতনাবোধে মানবিকতার মুক্তিসাধনাই এই যুগের ধর্ম। শাস্ত্রবর্ণিত পাপপুণ্যের পরোয়া তাই নিছক স্বার্থপরতা তাঁর কাছে। জরা, জড়ত্ব, হীনতা, ক্লীবত্ব থেকে মুক্ত হয়ে এগিয়ে চলাই যৌবনের একমাত্র লক্ষ্য। কবির তাই ব্যাকুল আহŸান- ‘জাগো দুর্মদ যৌবন / এসো তুফান যেমন আসে/ সমুখে যা পাবে দলে চলে যাবে অকারণ উল্লাসে’।

তাঁর জীবনের আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ছিল বঞ্চনার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। গণমানুষের অধিকার আদায়ের তীব্র আকাক্সক্ষা। শুধু তাই নয়, নজরুলের লেখার ওপরও নিষেধাজ্ঞা জারি করে ব্রিটিশ সরকার। কাজী নজরুলের লেখা যুগবাণী, বিষের বাঁশি, ভাঙ্গার গান, প্রলয় শিখা ও চন্দ্রবিন্দুসহ মোট ৫টি গ্রন্থ ব্রিটিশ সরকার বাজেয়াপ্ত করে। বলা বাহুল্য বাংলা সাহিত্যে সমকালীন অন্য কোনো কবি বা সাহিত্যিকের এত গ্রন্থ একত্রে কখনো বাজেয়াপ্ত হয়নি।

১৯২২ সালে নজরুল ‘ধূমকেতু’ নামের একটি পত্রিকা সম্পাদনা শুরু করেন। পত্রিকাটি সপ্তাহে দুবার প্রকাশ পেত। ১২ সেপ্টেম্বর ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত ধূমকেতুর দ্বাদশ সংখ্যায় ‘আনন্দময়ীর আগমন’ নামক একটি কবিতা প্রকাশিত হয়। কবিতাটি ব্রিটিশ শাসকদের ভিত কাঁপিয়ে দেয়। ফলে এই কবিতায় নজরুলের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম রাজদ্রোহের মামলা হয়। একই বছরের ৮ নভেম্বর রাজদ্রোহের অপরাধে নজরুলের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়। পরবর্তীতে এই মামলার রায়ে ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দের ১০ জানুয়ারি নজরুল এক বছর সশ্রম কারাদন্ডে দণ্ডিত হন।

আগে থেকেই নজরুলের কাব্য চেতনা আর সৃষ্টিশীল দ্রোহের সঙ্গে পরিচিত ছিল সাধারণ মানুষ। কারাবরণের ঘটনায় নজরুল সমগ্র দেশবাসীর কাছে শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে ওঠেন। এমনকি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ নজরুলের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে তার ‘বসন্ত’ নাটকটি কবির নামে উৎসর্গ করেন। নজরুল তার বিখ্যাত ‘শিকল পরার গান’ জেলে বসেই রচনা করেন। জেলখানার ভিতর অকথ্য নির্যাতন আর বৈষম্যের শিকার হয়ে নজরুল এখানেও বিদ্রোহী হয়ে উঠলেন।

১৯২৩ খ্রিস্টাব্দের ১৪ এপ্রিল হুগলি জেলে অনশন ধর্মঘট শুরু করেন। নজরুল একটানা অনশন করে যান ৩৯ দিন। সেই সময় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বয়ং নজরুলকে চিঠি লিখে অনশন ভঙ্গ করার অনুরোধ জানান। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিলং থেকে এ বিষয়ে তাকে টেলিগ্রাম পাঠান। টেলিগ্রামটি নজরুলের হাতে পৌঁছায়নি। জেল কর্তৃপক্ষ প্রকৃত ঠিকানা জানলেও ইচ্ছে করেই টেলিগ্রামটি নজরুলের কাছে না পাঠিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে ফেরত পাঠায়।

রবীন্দ্রনাথ এ ঘটনায় দারুণ মর্মাহত হন। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও নজরুলের অনশনে খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। অতঃপর শেষ পর্যন্ত অনশনের ৩৯ দিন পর কুমিল্লার মাতৃসম বিরজা সুন্দরী দেবীর অনুরোধে তারই হাতে লেবুর রস পান করে নজরুল অনশন ভঙ্গ করেন।

এভাবেই গোটা জীবন নজরুল সংগ্রাম করে গেছেন। কিন্তু বাঙালির দুর্ভাগ্য সুস্থ কবিকে আমরা বেশিদিন পাইনি। ১৯৪২ সালের জুলাই মাসে কলকাতা বেতারে ছোটদের গল্পের আসরে কবি গল্প বলতে বলতেই বাকরুদ্ধ হয়ে যান।

সৌভাগ্যের কথা হচ্ছে, ১৯৭২ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্যোগে ভারত সরকারের অনুমতি নিয়ে কবি নজরুলকে সপরিবারে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়। তাকে দেওয়া হয় জাতীয় কবির মর্যাদা। বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে অবদানের জন্য ১৯৭৪ সালের ৯ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কাজী নজরুলকে ডি-লিট উপাধিতে ভ‚ষিত করে। ১৯৭৬ সা‌লের জানুয়া‌রি মা‌সে বাংলা‌দে‌শ সরকার ক‌বি‌কে বাংলা‌দে‌শের নাগ‌রিকত্ব প্রদান ক‌রে। একই বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি তাকে দেওয়া হয় একুশে পদক। ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

প্রিয় কবির শেষ ভাষণ দিয়েই লেখার ইতি টানব।

শেষ ভাষণে কবি বলেছিলেন, ‘বন্ধুগণ, আপনারা যে সওগাত আজ হাতে তুলে দিলেন, আমি তা মাথায় তুলে নিলুম। আমার সকল তনু-মন-প্রাণ আজ বীণার মতো বেজে উঠেছে। তাতে শুধু একটি মাত্র সুর ধ্বণিত হয়ে উঠেছে-আমি ধন্য হলুম, আমি ধন্য হলুম। আমায় অভিনন্দিত আপনারা সেই দিনই করেছেন, যেদিন আমার লেখা আপনাদের ভালো লেগেছে। বিংশ শতাব্দীর অসম্ভবের সম্ভাবনার যুগে আমি জন্মগ্রহণ করেছি। এরই অভিযান সেনাদলের ত‚র্য্যবাদকের একজন আমি-এই হোক আমার সবচেয়ে বড় পরিচয়। আমি এই দেশে, এই সমাজে জন্মেছি বলে, শুধু এই দেশেরই, এই সমাজেরই নই, আমি সকল দেশের, সকল মানুষের...।’

১৯৪১ সালের ৬ এপ্রিল মুসলিম ইনস্টিটিউট হলে ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি’র রজত জয়ন্তী উৎসবে সভাপতির বক্তব্যে নজরুল কালজয়ী এই ভাষণ দান করেন। দূরারোগ্য ব্যাধিতে চিরজীবনের জন্য বাক-রুদ্ধ হয়ে যাওয়ার পূর্বে এই ছিল তার সর্বশেষ বক্তৃতা।

ছোটবেলা থেকেই তাঁকে জেনেছি দুখু মিয়া হিসেবে। সেই চুরুলিয়া গ্রাম কিংবা তিনি যখন রুটির দোকানে কাজ করতেন তা গল্পে যখন পড়তাম, তখন চোখের সামনে কবির ছবি ভেসে উঠত। আজও ভাসে। পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে ১৩০৬ বঙ্গাব্দে ১১ জ্যৈষ্ঠ (২৫মে, ১৮৯৯) কবি কাজী নজরুল ইসলাম জন্মগ্রহণ করেন।

কবির ‘সৃষ্টি সুখের উল্লাসে’ যত সৃষ্টি একজন বাঙ্গালি হিসেবে অসীম দায়বোধ আর অফুরান অনুপম ভালোবাসা থেকে আজ আমরা তাঁকে স্মরণ করছি। কবির ১২১তম জন্মবার্ষিকীতে গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।