Cinque Terre

পার্থ তালুকদার

২৮ মে , ২০২০


প্রাবন্ধিক ও ব্যাংকার


করোনাকালে বাউল জীবন

নভেল করোনা ভাইরাসের ফলে বিশ্ব পরিস্থিতির বর্তমান বেহাল দশা নিয়ে আমরা সবাই অবগত। আমাদের জীবন, আমাদের স্বপ্ন, কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা কারও পক্ষে বলার বা ধারণা করার উপায় নেই। গতিশীল জীবন হঠাৎ করে যে এভাবে থমকে দাঁড়াবে তা কয়েক মাস আগেও কারও জানা ছিল না। তাই স্বাভাবিকভাবেই কর্মচঞ্চল অন্যান্য পেশার মানুষের ন্যায় আমাদের বাউল শিল্পীদের জীবনেও এই করোনাকালে ছন্দপতন নেমে আসে।

স্তব্ধ হওয়া পৃথিবীর মতো হঠাৎ থমকে গেছে বাউলের মন। নেই আজ দোতারার টুংটাং হৃদয়স্পর্শী সুরের আওয়াজ। গানের খাতায় নেই পূর্বের ন্যায় কোনো নতুন শব্দ বুনার আয়োজন। যেখানে মাসের প্রতিটা দিনই গ্রাম থেকে শহরে, শহর থেকে গ্রামে ছুটে চলেছেন গানের তাগিদে সেখানে এখন তাদের দিন কাটে বদ্ধ ঘরে ভয়ে, আতংকে। এভাবে জীবন বদলে যাবে, জীবন এভাবে বদলে যায়, তা ক’দিন আগেও ঘুনাক্ষরে কেউ কল্পনা করেনি।

বাউল শিল্পীরা যেহেতু গানের উপর ভর করেই জীবিকা নির্বাহ করেন তাই বর্তমান সময়টা তাঁরা অতি করুণ ভাবেই পার করছেন সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। জন্মের পরে বুঝে ওঠার পর থেকেই তাঁরা হাতে নিয়েছেন একতারা-দোতারা। গানের প্রতি তাঁরা এতটাই নিবেদিত যে অন্য কোনো পেশার কলকাঠি ছুঁয়ে দেখার প্রয়োজন অনুভব করেননি। বাউল শিল্পীরা আগে রেডিও টিভিতে প্রোগ্রাম করলেও বর্তমানে এই পরিস্থিতিতে কোনো প্রোগ্রাম না থাকায় তাদের হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকা ছাড়া অন্য কোন উপায় নেই। তাই স্বাভাবিকভাবেই অনুভব করা যায় আর্থিকভাবে তাঁরা আজ কতটা দুর্বল, কতটা নিঃস্ব। 

বর্তমান করোনা ভাইরাসের করাল গ্রাস নিয়ে কথা হয় সিলেটের প্রবীন বাউল আবদুর রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘বাউলদের প্রধান ধর্মই হচ্ছে মানবসঙ্গ। মানুষের সঙ্গে মেলামেশা না করলে শান্তি পাই না। করোনা আসার পর সবার কাছ থেকেই দূরে আছি। তবে আমার শুভাকাঙ্খীরা সবসময়ই খবর রাখছেন। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ।’ তবে এই করুণ পরিস্থিতিতে বাউলস¤্রাট শাহ আবদুল করিমের একলব্য শিষ্য বাউল আবদুর রহমান একেবারে ভেঙে না পড়ে ঘরে বসে বাউল গানের চর্চা করে যাচ্ছেন। তিনি এরই মধ্যে করোনাকে উপজীব্য করে কয়েকটি গানও রচনা করেছেন।

           ‘ঘরে থাকেন, প্রয়োজন বিনে বাইরে কেউ যাবেন না

করোনা ভাইরাসের ভয়ে আতংকিত হবেন না ॥

সাবান কিংবা স্যানিটাইজারে হাত ধুইবেন ভাল করে

করোনা রোগীর ধারে সাবধান কেউ যাবেন না ॥’

জনপ্রিয় এই বাউল তাঁর গানের কলিতে বর্তমান ক্রান্তিকালে যারা তাঁর খোঁজখবর নিচ্ছেন তাদেরকে ধন্যবাদ জানিয়েছে। তিনি তাঁর গানে যেমন করোনা নিয়ে সতর্কতামূলক বাণী প্রচার করেছেন তেমনি বিত্তবানদেরকে এই দুর্যোগ সময়ে রাজসিকভাবে চলাফেরার জন্য অবজ্ঞা করতেও ছাড়েন নি। তাই যাদের সহায় সম্বল আছে তাদেরকে গরীবের দিকে নজর দেওয়ার উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন প্রখ্যাত এই বাউল শিল্পী। তাছাড়া তাঁর অন্যান্য গানেও বর্তমান সময়ের ভীষণ করুণ অথচ প্রাসঙ্গিক কিছু বিষয় তিনি এমনভাবে তুলে ধরেছেন যা আমাদের হৃদয়ে আলোড়ন তুলে। তাঁর লিখা কয়েকটি পঙ্ক্তি পাঠকদের জন্য তুলে ধরাটা যুক্তিযুক্ত মনে করি।

করোনা ভাইরাসে কেহ মরে উপবাসে

        কেহ আছে বসে পাঁচ তলায়

আসিল কী দুর্দিন সবাই গণে নিজের দিন

বিত্তহীন একেবারে নিরুপায়

হায়রে করোনার ডর,  ভাইয়ে নেয় না ভাইয়ের খবর

কেউরে কেউ এক নজর দেখতে না যায়। 

এই করোনাকালে মন পোড়ার পাশাপাশি ঘর পুড়েছে বাউল রণেশ ঠাকুরের। তাঁর আসরঘর অর্থাৎ যেখানে গানের আসর বসে সে ঘরটা আগুনে পুড়ে গত চল্লিশ বছরের জমানো স্মৃতি নিমিষেই ছাঁই হয়ে যায়। এই ঘরে থাকা তাঁর দোতারা, হারমোনিয়ামসহ গানবাজনার আনুষাঙ্গিক যন্ত্রপাতি ও গানের খাতাও পুড়ে ছাঁই হয়েছে। অবশ্য বাউল অনুরাগীরা ইতিমধ্যে তাঁর আসরঘর পুননির্মাণ করার জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। তাকে হয়তো গান বাজনার নতুন যন্ত্রপাতি কিনে দেওয়া হবে কিন্তু তাঁর চল্লিশ বছরের জমানো স্মৃতি তিনি কিভাবে ফিরে পাবেন বা কিভাবে ভুলে থাকবেন সেটাই মুখ্য বিষয়। তাই মন ভাল নেই বাউল স¤্রাট শাহ আবদুল করিমের অন্যতম শিষ্য এই বাউলের।

মন ভাল নেই সিলেটের জনপ্রিয় বাউল বশির উদ্দিন সরকারের। দেশে করোনা ভাইরাস সংক্রমনের পর থেকেই ঘরে ‘মন না বসা’ এই বাউলের ঘরবন্দী সময় কাটছে এখন। অথচ কিছুদিন আগেও গানের আসরের জন্য দম ফেলার ফুরসত ছিল না। বর্তমান সময় কেমন কাটছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘একদম ভাল যাচ্ছে না। ঘরবন্দী জীবন ভাল লাগে বলেন ? আমাদের আয়-উপার্জনের একমাত্র অবলম্বন হলো গান, এখন যদি গানই গাওয়া বন্ধ হয়ে যায় তবে জীবন কিভাবে চলবে সেটাই ভেবে কুল পাচ্ছি না।’ তবে এই বাউলশিল্পী শত বাঁধা-বিপত্তির মধ্যে নিজ ঘরেই গানের চর্চা করে যাচ্ছেন। মাঝেমধ্যে ভক্ত-অনুরাগীদের অনুরোধে ফেসবুক লাইভে এসে গান করেন। তাছাড়া করোনা ভাইরাস নিয়ে কয়েকটি গানও রচনা করেছেন তিনি।

করোনায় আতংক আজ সারা বিশ্ব জুড়ে

এই দুঃখ বলিব কারে

সব যোগযোগ বিচ্ছিন্ন, কেউ যাবে না কারও ধারে ॥

আপন ভাই মরে যদি তার কাছে যাইতে মানা

কি আজগবি রোগ আইল ভাই নাম হইল তার করোনা ॥

আবহমান থেকেই বাউলরা শত সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে তাদের জীবনতরী চালনা করছেন। তবুও তাঁরা তাদের গুরুর দেখানো পথ থেকে কখনও পিছপা হন নি। এমন কঠিন সময়েও বাউল গানের পূজারীরা মনোবল শক্ত রেখে গানের কলি সৃষ্টি করে যাচ্ছেন। ফলে হাজার বছর পরে কারওনাকালে রচিত এই গানগুলো তখনকার প্রজন্মকে বর্তমান দুর্দিনের কথা স্মরণ করিয়ে দিবে, বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর জানান দিবে-সেটা নিশ্চিত ভাবেই বলা যায়।