Cinque Terre

ফজিলাতুন নেসা

৩১ মার্চ , ২০২০


কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্ট,

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়


নিঃসঙ্গতায় মানসিকভাবে ভালো থাকার উপায়

প্যনডেমিক করোনা নিয়ে পুরো বিশ্ব এখন আতংকিত। কোন কোন দেশ আক্ষরিক অর্থেই ‘shutting down’ অবস্থায় আছে বেশ অনেকদিন হয়ে গেলো। যদিও বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় এ দেশে করোনা সংক্রমণের ধীর গতি তবুও বর্তমানে আমরাও ‘lock down’  মধ্য দিয়েই যাচ্ছি। কাজেই ‘করোনা কোন আতঙ্ক নয়, দরকার শুধু সচেতনতা’ এটি একটি ভুল বার্তা। করোনা এখন রীতিমতো একটা আতঙ্কের নাম। এ ধরণের পরিস্থিতিকেই বলা হয় traumatic events. সাধারণতঃ কোন বড় বিপদ বা দূর্যোগ ঘটলে মানুষ ট্রমাট্রইজড হয় কিন্তু সে পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে এক সঙ্গে থাকতে হয়। এক অপরের পাশে দাঁড়ায়। শারীরিক ও মানসিকভাবে লড়াই করে করোনা নামক ভয়রাসটি আমাদের সেই choice টুকুও কেড়ে নিয়েছে। মানুষকে লড়তে হচ্ছে ভীষণ একা। শুধু মানুষ নয়, বিশ্বের প্রতিটি দেশ এখন একে অপরের কাছে থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। করোনার দৌড়াত্বে ‘হাতের মুঠোয় বিশ্ব’ কথাটা কিছুদিনের জন্য হাস্যকর হয়ে উঠেছে। এ অবস্থায় প্রত্যেকের মানসিক অবস্থা সহজেই অনুমেয়।

World health Organization (WHO) একই কথা বলছে। WHO এর পক্ষ থেকে Hans Kluge ২৬ মার্চ, ২০২০ বৃহস্পতিবার একটি বার্তায় বিশ্বের মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সতর্ক বার্তা জারি বলেন, ‘এই বিচ্ছিন্নতা, সামাজিক দূরত্ব, বন্ধ স্কুল, ঝুঁকি নিয়ে অফিস-আদালতে কাজ করতে যাওয়া মানুষকে করে তুলেছে উদ্বিগ্ন ও ভীত এবং মানুষের একাকীত্ব বোধ প্রত্যেকের মনের ওপর তীব্র চাপ তৈরি করছে।’

সত্যি সত্যিই আমরা এখন emotional এবং psychological trauma এর মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। এ ধরণের মানসিক অবস্থায় মানুষ বড্ড অসহায় এবং অনিরাপদ বোধ করে। আমাদের দেশে করোনার সংক্রমণ সেভাবে না হলেও কম বেশি সবাই আমরা একই রকম emotional এবং psychological trauma তে ভুগছি। এরকম তীব্র মানসিক চাপে ভোগার বড় কারণ শুধু করোনার সংক্রমণ নয়, আরও একটা বড় কারণ বিভিন্ন সামাজিক ও গণমাধ্যম। বার বার একই ধরণের ভয়াবহ সব খবর মানুষকে অস্থির করে তুলেছে। 

আমরা জানিনা কতদিন এ অবস্থায় থাকতে হবে? এই অনিশ্চয়তা বাড়িয়ে তুলছে রাগ এবং সিদ্ধান্তহীনতা।

কী ভয়াবহ এক সময়। এরকম বন্দী  অবস্থায় আমরা কেউ কারো সাহায্য নিতেও পারছি না এবং সরাসরি কাউকে সাহায্যও করতে পারছিনা। তাহলে কী করে ভালো থাকবো? এ মুহূর্তে self help is the best help. একা একা ভালো থাকার একটা বড় উপায় পরিস্থিতিকে  যতটা পারা যায় সহজভাবে গ্রহণ করতে হবে। এর কোন বিকল্প নেই। জানি কাজটা মোটেও সহজ নয়। তবুও মানুষের অসাধ্য কিছু নেই। 

Stay at home, maintain social distance এবং stay informed এই তিনটি বিষয় কঠিনভাবে মেনে চলার পাশাপাশি কিছু বিষয় নিয়মিত চর্চা করলে ঘরের মধ্যে কিছুটা ভালো থাকা সম্ভব। আজকে দুটো স্কিল নিয়ে আলোচনা করি, যে গুলো আমাদের আবেগ নিয়ন্ত্রণে বেশ সাহায্য করবে বলে আশা করছি।

প্রথমে শরীরটাকে ঠিক রাখতে হবে। শরীর মনের হাত ধরে ধরে চলে। শরীর ঠিক থাকলে মন ভালো থাকে এবং মন ভালো থাকলে যে কোন কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করার শক্তি অর্জন করা যায়। এছড়াও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ঠিক রাখার জন্য শরির ও মন ঠিক রাখা অত্যন্ত জরুরি। নানা রকমের খবর পড়ে এবং দেখে আপসেট হয়ে পড়লে, প্রায়শঃই শরীরের তাপমাত্রা (temperature) বেড়ে যেতে পারে। গরম লাগলে ঠাণ্ডা পানির ঝাপটা দিন মুখে কিম্বা ঠাণ্ড পানিতে গোসল করে ফেলুন।

দিনে অন্তত একবার হলেও বেশ কিছুক্ষণ এক্সারসাইজ (intensive exercise) করুন তাহলে ভালো বোধ করবেন।

খুব অস্থির লাগলে কিছু সময়ের জন্য বসে কিম্বা শুয়ে ধীরে ধীরে লম্বা শ্বাস (paced breathing) নিন। এরকম কিছুক্ষণ করলে অস্থিরতা কমবে। 

অনেকের রাতে ঘুম হচ্ছে না, দুঃস্বপ্ন দেখছেন। প্রতি মুহূর্তে ভাবছেন এই বুঝি খারাপ কিছু ঘটবে। বুক চেপে ধরছে, মনে হচ্ছে অজ্ঞান হয়ে পড়বেন। এরকম অনুভূতি হলে চেয়ারে বসে কিম্বা শুয়ে কিছুক্ষণ একটা বিশেষ ব্যায়াম (paired muscle relaxation) করতে পারেন। যেমনঃ দুই বতি হাত সামনের দিকে মেলে ধরে শক্ত করে মুঠি করুন পাঁচ সেকেণ্ডের জন্য আবার ছেড়ে দিন। এভাবে পা থেকে মুখ-মণ্ডল পর্যন্ত যে কোন অঙ্গ পাঁচ সেকেন্ডের জন্য শক্ত কওে ধীরে ধীরে শ্বাস নিন তারপর রিল্যাক্স করুন। দিনে পাঁচ মিনিট বা ১০ মিনিট করলে অনেক আরাম পাবেন।

পরিস্থিতি  সহজভাবে  গ্রহণ (accepts) করার কিছু বৈজ্ঞানিক উপায় আছে। এভাবে বিপদ্দজ্জনক পরিস্থিতি গ্রহণ করার চেষ্টা করলে ভালো ফল লাভ হয়।

নিজেকে কাজে (activities)ব্যস্ত রাখুন। ঘরের কাজের পাশাপাশি বাচ্চাদের সময় দিন। বাচ্চাদেও পাশে থাকা এখন ভীষণ জরুরি। প্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে কাছের বা পরিবারের কেউ করোনা আক্রান্ত হলে কী করনীয় সে ব্যাপারে সন্তানকে মানসিকভাবে প্রস্তুত রাখুন। ঘন্টায় ঘন্টায় করোনার আপডেট না দেখে ম্যুভি দেখুন, গান শুনুন। নামাজ পড়ুন। ফোনে বা ভিডিও কলে সবার সাথে যুক্ত থাকুন।

আপনার লেভেল থেকে যতটুকু পারবেন অন্যকে সাহায্য (contributing) করুন। আপনার আশে-পাশের সুস্থ বয়োজেষ্ঠ্যদের বিভিন্নভাবে সাহায্য করতে পারেন। দরিদ্রদের জন্য কিছু করুন।

ভাবুন এর চেয়ে খারাপ সময় আপনি পাড়ি দিয়েছেন। যেমনঃ একবার আপনার পা ভেঙ্গেছিলো বলে আপনি তিন মাস বিছানায় ছিলেন।  সে সময়ের সাথে এ সময়ের তুলনা (comparisons) করুন। সে সময়টা কী ভাবে পাড়ি দিয়েছিলেন? তখন পারলে এখনো পারবেন।

মনখারাপ কাটাতে সাপ লুডু খেলুন। হাসির নাটক দেখুন, কৌতুক পড়ুন। অর্থাৎ মন খারাপকে বেশি পাত্তা (emotion/opposite emotions) দেয়া যাবেনা। বাড়ির লোকের সাথে আড্ডা দিন। আড্ডা দিন অনলাইনে।

খারাপ চিন্তা কিন্তু আসবেই। ঠেলতে (push away) থাকুন। প্রশ্রয় দেবেন না কিছুতেই। প্রয়োজনীয় তথ্য ছাড়া হাবিজাবি তথ্যগুলোকে দূরে রাখুন।

একটা খারাপ চিন্তা দশটা খারাপ চিন্তা বাড়ায়। ” যদি আমার করোনা হয়, তাহলে আমাকে কে দেখবে? আমি কি বাঁচবো কিনা? আমি বেঁচে না থাকলে আমার সন্তানদের কি হবে? আমাকে কি ফেলে রাখবে? আমার কবর কি ঠিক মতো হবে?” এভাবে চক্রবৃদ্ধি আকাওে একটার পর একটা চিন্তা আসতে থাকে। কাজেই কোন খারাপ চিন্তা আসলে সেটিকে তাড়াবার জন্য অন্যভাবে (thoughts / altenative thoughts)  ভাবুন। যেমনঃ করোনা হলেই কেউ মরে না। আমি তো সতর্ক থাকছিই এবং সব নিয়ম মেনে চলছি। কাজেই এত ভয় পাবার কিছু নেই। করোনা নয় আমি তো এমনিই মারা যেতে পারি। অতএব ভয় পেয়ে কোন লাভ নেই।

নিজের পঞ্চ ইন্দ্রিয়কে (sensation) কাজে লাগান। নিজের নিবিড় যত্ন নিন। পছন্দের মিউজিক শুনুন, সুযোগ থাকলে প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করুন। অস্থির লাগলে কিছুক্ষণ সন্তানকে বুকে জড়িয়ে রাখুন। ব্যাস্ততায় তো রান্না ঘরে যেতে পারতেন না। নিজের পছন্দের মজার কিছু খান। নিয়মিত এবং পুষ্টিকর খাবার খাওয়াটা এখন খুব দরকার।

গ্লোবাল ক্রাইসিস COVID19 নিয়ে মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা গবেষণা করে মতৃমত দিচ্ছেন যে বিশ^ যদি এই বর্তমান ক্রাইসিস কাটিয়েও ওঠে তবুও বিশ^কে এক ভয়াবহ মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের মধ্য দিয়ে যেতে হবে। সেই যুদ্ধে লড়ার জন্যও তো আমাদেও প্রস্তুত হতে হবে। এখনই সময় মানসিক স্বাস্থ্যেও যতœ নেবার। আসুন সকলে মিলে মানসিকভাবে ভালো থাকি। জয় হোক মানুষের। জয় হোক মানবতার।