Cinque Terre

সুমন বনিক

০১ জুন , ২০২০


কবি ও ব্যাংকার


করোনার চোরাবালিতে দেশ

আমরা কী বারবার ভুলের চোরাবালিতে পা ফেলছি। ঘুটঘুটে অন্ধকার একটি সুড়ঙ্গ পথে হাঁটছি। এরকম প্রশ্ন অনেকের মনে ফুলে-ফেঁপে উঠছে প্রতিদিন। করোনাকালের ভয়াবহ রূপ দেখছে পৃথিবী। গোটা বিশ্বের মানুষ এক শ্বাসরুদ্ধ পরিবেশ অতিক্রম করছে। বাংলাদেশও এই ভয়াবহ করোনাভাইরাসের শিকার। বাংলাদেশ এই ভাইরাস প্রতিরোধে নিয়েছে বিভিন্ন উদ্যোগ। দেশের মানুষকে সুরক্ষা করাই আজকের বড় চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকার প্রতিনিয়ত বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। বিশেষ করে আমাদের প্রধানমন্ত্রী অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে এই সংকটময়কালকে মোকাবিলা করছেন। কিন্তু সরকারের সা¤প্রতিক কিছু সিদ্ধান্ত জনমনে উদ্বেগ উৎকন্ঠার জন্ম দিচ্ছে। ৩০ মে থেকে উঠে গেল সাধারণ ছুটি। সীমিত পরিসরে শুরু হচ্ছে গণ-পরিবহন, খুলে যাচ্ছে সরকারি বেসরকারি সব ধরনের প্রতিষ্ঠান, খুলছে বিপনী বিতান। শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আপাতত বন্ধ থাকছে। এই ধরনের সিদ্ধান্ত যখন নেওয়া হচ্ছে তখন দেশের করোনার ভয়াবহতার রূপটি কেমন একনজরে একটু দেখে নিই। 

গত ২৪ (৩১মে রবিবারের দেওয়া তথ্যে) ঘণ্টায় দেশে করোনায় নতুন আক্রান্ত ২৫৪৫ জন। মোট আক্রান্ত ৪৭১৫৩জন, নতুন মৃত্যু ৪০, মোট মৃত্যু ৬৫০, নতুন সুস্থ ৪০৬, মোট সুস্থ ৯৭৮১জন।

নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে ১১৮৭৬টি। শনাক্তের গড় হার প্রায় ২২%, মৃত্যুর হার প্রায় ১.৪%, সুস্থতার হার ২১% মৃত্যু পুরুষ ৭৫%নারী ২৫%। আমরা যদি গত কয়েকদিনের তুলনাম‚লক একটি চিত্র দেখি ; সেটি এরকম : 

প্রথম ৫৮দিনে (৪মে পর্যন্ত) ১০হাজার জন শনাক্ত, দ্বিতীয় ১১দিনে (১৫ মে পর্যন্ত) ২০হাজার জন, তৃতীয় ০৭দিনে (২২মে পর্যন্ত) ৩০হাজার জন, চতুর্থ ০৬দিনে (২৮ মে পর্যন্ত) ৪০হাজার জন শনাক্ত হন। এই পরিসংখ্যান থেকে সহজেই অনুমেয় করোনাভাইরাস আক্রমণ উর্ধ্বমুখি। কেনো এই উর্ধ্বমুখি প্রবনতা। উত্তরটা খুঁজে পাই এরকম : বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যায় আমরা জানি ভাইরাস আক্রমণ উর্ধ্বমুখি প্রবনতা অতিক্রম করে চ‚ড়ান্ত উচ্চতায় পৌঁছাবে। তারপর ধীরে ধীরে নিম্নগামী হবে। এখন আমরা করোনাভাইরাস আক্রমণের পিক টিইম বা উর্ধ্বমুখি প্রবনতায় আছি। ঠিক এই মুহুর্তে লক ডাউন জোরদার করা উচিত ছিল। এই বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের মতামত আমরা দেখে নেব। রোগতত্ত¡, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও জনস্বাস্থ্যবিদ ডা.মুশতাক হোসেন বলেছেন "প্রতিদিন আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। এর মধ্যে লকডাউন তুলে নেওয়ার এ সিদ্ধান্ত আত্মঘাতী। দরিদ্র মানুষের অর্থনৈতিক দুর্দশার জন্য যদি এ সিদ্ধান্ত হয়, তাহলে তাদের সামাজিক সহায়তা দিতে হতো তিনি ধাপে ধাপে লকডাউন তুলে নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি যখন করোনাভাইরাস সংক্রমণের এই পর্যায়ে; তখন সবকিছু খোলে দেওয়া হলো। সিদ্ধান্তটি কতটুকু যুক্তি সঙ্গত তা প্রশ্নবিদ্ধ বৈকি! ঈদের আগে আমরা দেখলাম গণ পরিবহন এমনকি ব্যক্তিগত গাড়ি চলাচলের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হলো, ফেরী পারাপারে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হলো। অথচ সন্ধ্যার পরে গণ পরিবহন ব্যতীত বাকি সব নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেওয়া হলো। মানুষ দলবেঁধে ঈদ উদযাপনে নাড়ির টানে বাড়ি চলে গেলেন। এখন তাদের ফিরে আসাটা আরও স্বস্তিদায়ক হয়ে গেলো। আর করোনাভাইরাস তার পাখা মেলে উড়লো শহর থেকে গ্রামে আর গ্রাম থেকে শহরে। আগামি সাত থেকে দশ দিনের ভেতর সংক্রমণের হারটা পরিষ্কার হয়ে যাবে। ঠিক আগেও এরকম একটি ঘটনা আমরা দেখলাম। গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি খোলা নিয়ে কী লঙ্কা কন্ডই না-ঘটে গেলো। হুট করেই গার্মেনটসের শ্রমিকদের ঢাকায় আনা হলো আবার ফেরত পাঠানো হলো, পুনরায় আনা হলো এই প্রক্রিয়াটি যথাযথ ছিল না। পরিকল্পিত ভাবে সুনির্দিষ্ট বিধি বিধান পালন করে তাদেরকে কর্মস্থলে আনা যেতো। সেটাই ছিল কাম্য এবং বিজ্ঞান সম্মত। পেছনের এতো ঘটনার কাসুন্দি ঘেঁটে লাভ নেই তবে আমরা সেই অভিজ্ঞতা নিয়ে করোনাকালকে মোকাবিলা করতে পারি। স¤প্রতি লকডাউন তুলে নেওয়াটা কতটুকু যথার্থ হয়েছে তা সময় বলে দিবে। আমরা বিজ্ঞান বুঝিনা ,অর্থনীতি বুঝি। তবে বিজ্ঞানকে মেনেই অর্থনৈতির চাকাকে সচল রাখাই বুদ্ধিমানের কাজ। এবং এটাই হবে মানবিক অর্থনীতির বিকাশ। সরকার প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর স্বার্থে অনেকগুলো প্রণোদনা প্যাকেজ গ্রহণ করেছে। যা প্রশংসনীয় তো বটেই যুগান্তকারী বললেও কম বলা হবে। সরকারের এসব কর্মস‚চিতে দিন মজুর, রিকশা -ভ্যানগাড়ি চালক থেকে শুরু করে নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারও উপকৃত হয়েছে। এই সরকারের অর্জন আকাশ ছোঁয়া। এতো অর্জনের মধ্যে এই করোনাকাল মোকাবিলা সরকারের একটি চ্যালেঞ্জ। এই ক্রান্তিকালে বুঝে-শুনে সবদিক বিবেচনায় এনে সিদ্ধান্ত নেওয়াটাই হবে সঙ্গত এবং যুক্তিযুক্ত। শুধু বিরোধিতার অজুহাতে বিরোধিতা না করে সকল রাজনৈতিক দলের উচিত সরকারকে সুপরামর্শ দেওয়া। দেশের এই ক্রান্তিকালে বিরোধী দলগুলোর কর্মকাÐ নেই, জনগণের কথা তাদের মুখে নেই। শুধুই দোষারোপ করা নিয়ে ই ব্যস্ত।

সরকারের তরফ থেকে বলা হচ্ছে লকডাউন তুলে নেওয়াটা হচ্ছে ট্রায়াল এন্ড এরর ভিত্তিক একটি পর্যবক্ষেণ। আমরা দেখতে চাই এই উদ্যোগ যেনো সঠিক হয়। যদিও বৈজ্ঞানিক যুক্তিতে লকডাউন তুলে নেওয়াটা সঠিক নয় অন্তত এই মুহ‚র্তে। সদাশয় সরকার বিষয়টি ভেবে দেখুন। মহামারীকে প্রতিরোধ করে মানুষের মৃত্যু ঠেকানোই সময়ের দাবি। তা না-হলে মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘায়িত হবে। সরকার নির্বিকার হলে মানুষ অসহায় বোধ করবে। আমরা যেনো বারবার ভুলের চোরাবালিতে তলিয়ে না-যাই। তাই এই সংকটকালে আমাদেরকে সৃষ্টিকর্তা র শরণাপন্ন হতেই হয়।

আমরা যেনো স্বাস্থ্য বিধি-বিধানগুলো মেনে চলি পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে। আমাদের নিজেদের সুরক্ষা নিজদেরই করতে হবে। সৃষ্টিকর্তা মানুষকে রক্ষা করুন। পৃথিবী নিরাময় হোক। কবিগুরুর ভাষায় আমরা বলতে পারি : ‘সকাতরে ঐ কাঁদিছে সকলে/ শোন শোন পিতা/ কহ কানে কানে/শুনাও প্রাণে প্রাণে/মঙ্গল বারতা...