Cinque Terre

আজিমুল রাজা চৌধুরী

০৩ জুন , ২০২০


সাহিত্যকর্মী


গুরু অন্তঃপ্রাণ বাউল আবদুর রহমান

তাঁকে যতই দেখি ততই অবাক হই। নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করি, এই যুগেও কি এতো সহজ সরল মানুষ বেঁচে আছে?

কারণ বাউলঅঙ্গনের সঙ্গে আমার একটি আন্তরিকতা আছে। অনেক বাউল কবিদের দেখেছি। শুনেছি তাদের ক্ষোভের কথা, চাওয়া পাওয়ার কথা কিন্তু বাউল আবদুর রহমানকে কোনদিন কারও বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখিনি। নিজের জন্য কোনকিছু চাইতেও শুনিনি। দেখেছি হিংসামুক্ত হাসি, শুনেছি অল্পে তুষ্টির কথা।

এইতো গত ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০; শাহ আবদুল করিম লোকউৎসবে গেলাম। সেখানে গিয়ে লোকমুখে শুনলাম বর্তমান সময়ের খ্যাতনামা অনেক বাউল শিল্পীরা অনুষ্ঠানে আসবেন না। অথচ এই শিল্পীরা শাহ আবদুল করিমের গান গেয়েই  শ্রোতাদের মনে স্থান ও জনপ্রিয়তা পেয়েছেন। পৃথিবীর মানুষগুলো দিন দিন স্বার্থের কাছে এমনভাবে আবদ্ধ হচ্ছে যে অনেকেই তাদের পূর্বপরিচয়টা পর্যন্ত ভুলে যায়। স্বার্থ ফুরিয়ে গেলে কে কার খোঁজ করে!

কেউ চায় বড়ো মাপের সম্মানী পেতে, কেউ চায় প্রধান অতিথি হতে, কেউ চায় পোষ্টারে সবার উপরে ছবি দেখতে। কিন্তু বাউল আবদুর রহমান এসবের কিছুই চান না। কারও অনুষ্ঠানিক দাওয়াতেরও অপেক্ষা করেন না। বরং নিজের দায়িত্ববোধ থেকে, শাহ আবদুল করিমের প্রতি সত্যিকারের ভালোবাসা থেকে, প্রতিবারই শাহ আবদুল করিমের লোকউৎসবে উপস্থিত থাকেন।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অনেক বিখ্যাত অখ্যাতরা যখন স্টেজে উঠা নিয়ে রীতিমতো প্রতিযোগিতা শুরু করেছেন তখন চেয়ে দেখলাম, দর্শক সারিতে বসে আছেন বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিমের অন্যতম শিষ্য বাউল আবদুর রহমান। এই হলো মহান মানুষদের মহানুভবতা। আর তিনি এমন বা হবেন না কেন? জীবনের দীর্ঘ ৩৬ বছর সঙ্গ দিয়েছেন শাহ আবদুল করিমকে। গুরুর প্রিয় শিষ্যতো গুরুর মতোই হবেন, এটাই স্বাভাবিক।

প্রচারবিমুখ সহজ সরল বাউল আবদুর রহমানের জন্ম ১৯৫৫ সালের ১০ মে হবিগঞ্জ জেলার আজমিরিগঞ্জ উপজেলার জলসুখা গ্রামে। তাঁর পিতার নাম একরাম হোসেন মাতার নাম হাজেরা খাতুন। পিতামাতার একমাত্র সন্তান তিনি। ছোট বয়সেই পিতাকে হারান তিনি। মায়ের আদর ও শাসনের মধ্যদিয়েই তাঁর বেড়ে উঠা।

বাউল আবদুর রহমান স্কুল ফাঁকি দিয়ে গানের আসরে চলে যেতেন। দেখতেন ও শুনতেন কীভাবে লোককবিরা গান গায়। ছোটকাল থেকেই গানের প্রতি তাঁর এক অন্যরকম টান ছিল। তাইতো ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করে আর লেখাপড়া না করে পুরোপুরি যোগ দেন গানের জগতে।

তাঁর হাতের  লেখা দেখলে মানুষ অবাক হয়ে যায়। কিছুদিন পূর্বে এটিএন নিউজের একটি অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে তাঁকে নেওয়া হয়েছিল। সেই অনুষ্ঠানের উপস্থাপক বিশিষ্ট সাংবাদিক মুন্নি সাহা তাঁর হাতের লেখার খুব প্রশংসা করেন। তিনি টিভি স্ক্রিনে বারবার তাঁর হাতের লেখা দেখিয়ে বলছিলেন, এটা হাতের লেখা বিশ্বাস হচ্ছে না। মনে হচ্ছে, লেখাটি কম্পিউটারের ডিজাইনিং টাইপ। অথচ বাউল রহমান ভাই আমার সামনেই লেখাটি লিখলেন।

বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিমের গানের অন্যতম প্রধান গায়ক হিসেবে বাউল আবদুর রহমানের সুনাম রয়েছে। অনেকেই তাঁর মধ্যেই খুঁজে বেড়ান শাহ আবদুল করিমকে। শাহ আবদুল করিমের গানের মূল কথা ও সুর অক্ষুন্ন রেখে যে কয়েকজন শিল্পী গান করেন, তাদের মধ্যে আবদুর রহমান অন্যতম। 

১৯৭৩ সালে শাহ আবদুল করিমের কাছে বাউলমন্ত্রে দীক্ষিত হয়েছিলেন তিনি। সেই থেকে শাহ আবদুল করিমের মৃত্যুর পূর্বদিন পর্যন্ত ছিলেন গুরুসেবায় নিবেদিতপ্রাণ এক শিষ্য হিসেবে। শাহ আবদুল করিম মৃত্যুর পূর্বে বাউল আবদুর রহমানের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, ‘ও রহমান, চিন্তা করিস না। তোরে একদিন মানুষ খুঁজবে। আমার দোয়া তোর জন্য সব সময় আছে।

বাউল সম্রাটের সেই আশীর্বাদের স্মৃতিস্বরূপ বাউল রহমান এখন পর্যন্ত তাঁর চুল আর কাটেননি। 

কারণ এই চুলে যে হাত বুলিয়ে শেষবারের মতো আশীর্বাদ করেছিলেন তাঁর প্রিয় গুরু শাহ আবদুল করিম।

একসময় বাউল করিমের ওপর নানা মিথ্যা অভিযোগ তুলেছিল উগ্রবাদীরা। সেই সময় অনেকেই বাউল আবদুল করিমের সঙ্গ ছেড়ে চলে যায়। কিন্তু বাউল আবদুর রহমান যাননি। তিনি বলেছিলেন আমি মুর্শিদের (শাহ করিমের) সঙ্গে আছি সঙ্গে থাকবো। আমার কাছে আমার গুরু পৃথিবীর সব কিছুর ঊর্ধ্বে।

আজ কালতো অনেকেই শাহ আবদুল করিমের শিষ্য হিসেবে নিজেদের দাবী করেন। বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা ভোগও করছেন। অথচ শাহ আবদুল করিমের খাঁটি শিষ্য আবদুর রহমানরা এখন পর্যন্ত অবহেলিত, লোকচক্ষুর অন্তরালে।

তিনি যেভাবে শাহ করিমের সঙ্গ দিয়েছেন তা খুব কম মানুষের দ্বারাই সম্ভব। খেয়ে না খেয়ে শাহ করিমের সঙ্গে কাটিয়েছেন দিনের পর দিন, রাতের পর রাত। বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিমের অভাব অনটনের কষ্ট দেখে নিজের বাড়ির জমিনের ফসল বিক্রি করে নিজ মুর্শিদ শাহ করিমের হাতে টাকা তুলে দিতেন। 

করিম বলতেন রহমান, ‘তুই আমারে টাকা দেওয়া লাগবে না। বরং তুই (রহমান) আমার সঙ্গে থাকলেই আমার টাকা পাওয়া হয়ে যাবে। 

একবার হলো কীÑ 

তখন শাহ আবদুল করিম জীবিত। শাহ আবদুল করিমের বাড়িতে একটি অনুষ্ঠান ছিল। ওই বছর বন্যায় ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। বাউল রহমানের হাতে কোন টাকা পয়সা নেই। তাই চিন্তা করছেন এই বছর আর অনুষ্ঠানে যাবেন না।

শিষ্যরা তৃপ্তি পায় মুর্শিদকে কিছু দিতে পারলে। প্রত্যেক শিষ্যরাই চায় তাঁর আপন মুর্শিদকে খাওয়াতে বা কোন কিছু উপহার দিতে।

সেই সময় তাঁর এক পীরভাই তাঁকে বললেন, কী রে রহমান, মুর্শিদ বাড়ি যাবে না?

রহমান বললেন শরীরটা ভালো না।

পীরভাই বুঝে ফেলেন আসলে শরীরের জন্য না, বরং রহমানের হাতে কোন টাকা পয়সা নেই তাই হয়তো যেতে চাইছে না। পীরভাই বললো চল আমরা হেঁটে চলে যাই। বাউল রহমানের মনতো উজানধলের করিম বাড়িতেই পড়ে থাকতো। তাই বাউল রহমান ও তাঁর পীরভাই হেঁটেই চলে গেলেন বাউল সম্রাটের বাড়ি।

শাহ করিম রহমানকে দেখেই বললেন, ‘ও রহমান, তুমি ইবার অতো দেরিতে কেনে? আমিতো তোমার অপেক্ষা কররাম।’

পীরভাই জানিয়ে দিলেন আসল কথা। তিনি মুর্শিদকে বললেন, রহমান আসতে চায় নি আমি ওরে নিয়া আইছি।

করিম জিজ্ঞাস করলেন কেন?

পীর ভাই বলল, রহমানের কাছে এবার টাকা পয়সা নাই,তাই আসতে চায় নি।

শাহ করিম রহমানকে ডাক দিয়ে বললেন, ‘ও রহমান আমার টাকা লাগবে না।

তুমি আমার কাছে আইলেই আমার টাকা পাওয়া অই যাইবো।’

পাঠকরা নিশ্চই বুঝতে পারছেন, বাউল রহমানের প্রতি বাউল সম্রাটের কি পরিমাণ স্নেহ ভালোবাসা ছিল। 

কথা প্রসঙ্গে বলতেই হয়, আজকালতো অনেকেই দাবী করেন তারা নাকি শাহ আবদুল করিমের গান খাতায় লিখে রেখেছিলেন এবং সেই সংগ্রহ থেকেই বই প্রকাশিত হয়েছে। অথচ ঐতিহাসিক সত্য হলো বাউল সম্রাট বেশিরভাগ সময় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে উপস্থিত গান রচনা করতেন এবং সঙ্গে সঙ্গে তা লিখে রাখতেন বাউল আবদুর রহমান। বাউল সম্রাটের গানের যতগুলো পান্ডুলিপি ছিল তাঁর সিংহভাগের লেখক হচ্ছেন বাউল আবদুর রহমান। তবে বর্তমানে এই সত্যটা যেন চাপা পড়ে গেছে মিথ্যার যাঁতাকলে ।

আরেকটি কথা না বললেই নয়, বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিমের বিখ্যাত অনেক  গানের সুরকার বাউল আবদুর রহমান। 

শাহ আবদুল করিম যেমন তাঁর শিষ্য রহমানকে অন্যদের চাইতে অধিক ভালোবাসতেন তেমনি শাসনও করতেন। গানে সামান্য এদিক সেদিক হলেই বকা দিতেন এমন কি মারতেন। বাউল আবদুর রহমানকে হাতে কলমে গান শিখিয়েছেন বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিম।

বাউল সম্রাট যখন কোন গান সৃষ্টি করে সুর দিতেন। এরপর সেই গান প্রথম গাইতেন বাউল আবদুর রহমান। বাউল রহমানের কাছ থেকে শ্রবণ করে গান গাইতেন প্রয়াত বাউল রুহী ঠাকুর। এই ব্যাপারে বাউল আবদুর রহমান তাঁর এক সাক্ষাৎকারে বলেন, বাবা শাহ আবদুল করিম গান রচনার পর আমিই প্রথম এটা গাইতাম এরপর আমার কন্ঠে শুনে গাইতেন রুহী ঠাকুর। যেহেতু ওনার (রুহী ঠাকুরের) কন্ঠটা ছিল অসাধারন তাই, শ্রোতা রুহী ঠাকুরের কন্ঠে গানগুলোকে গ্রহন করতো বেশি।

একবার বাউল সম্রাটের সঙ্গে দেখা করার জন্য তৎকালীন সময়ের বিটিভির পরিচালক কামাল লোহানী সিলেট শহরে এসেছিলেন। তিনি বাউল সম্রাটের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলেন বাউল সম্রাট বিটিভির তালিকাভুক্ত শিল্পী বা গীতিকার নয়। তখন তিনি বললেন অতি দ্রুত আপনারা আবেদন করুন আমি ব্যবস্থা করে দিব। বাউল সম্রাট এসবের কোন তোয়াক্কা করতেন না। তিনি আবেদন করেন নি।

একদিন বাউল রহমান সাহস করেই বাউল সম্রাটকে বললেন বাবা বিটিভির পরিচালক বলেছিল আবেদন করতে আপনি বেঁচে তাকাকালীন যদি এটা করে যেতেন তাহলে আমরাও সুযোগ পেতান বিটিভিতে অনুষ্ঠান করার।

এই কথা শুনে বাউল করিম বললেন আমাদের আবেদন করতে হবে না একদিন এরাই আমাদের খুঁজে আমাদের বাড়িতে আসবে। তুমি এসব নিয়ে চিন্তা কইরো না, আমি মারা গেলেও তোমারে মানুষ তালাশ করবে। তোমার বাড়িতেও টিভি চ্যানেলগুলো যাবে তোমার সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য। কালের পরিক্রমায় বাউল সম্রাটের সেই ভবিষ্যত বাণীর বাস্তবতা আমরা বর্তমানে দেখছি। বাউল রহমানের মধ্যেই যেন আমরা শাহ করিমকে খুঁজে পাই।

বাউল আবদুর রহমান চার শতাধিক গান লিখেছেন। ‘ভাটির সুর’ নামে ২০০৯ সালে তার একটি গানের সংকলন বেরিয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশের প্রখ্যাত লোকসংগীত গবেষক সুমনকুমার দাশের মাধ্যমে তাঁর গানের আরেকটি বই প্রকাশের পথে। এতো এতো গানের রচয়িতা বাউল রহমান বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নিজের রচিত গান পরিবেশন করেন না বললেই চলে। কারণটা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার গান আমি গাইলে মুর্শিদেও (শাহ আবদুল করিম) গান কে গাইবে। নতুন প্রজন্ম কোথায় পাবে মূল বাণী, মূল সুর। তাইতো আমি আমার গান গাই না বরং আমার মুর্শিদের গান গাই। মুর্শিদের গান গেয়ে যেই পরিমাণ আনন্দ পাই তা নিজের গান গেয়েও পাই না। মুর্শিদের প্রতিটা বাণীই চিরসত্য, রতœ মানিকের মতো।

বয়সের কারণে বাউল রহমানের দেহে বাসা বেধেছে নানান জটিল রোগ। দীর্ঘদিন অসুস্থ ছিলেন তিনি। বয়োবৃদ্ধ বাউল রহমানের সংসার চলে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান গেয়ে যে সম্মানী পান সেটা দিয়ে। তিনি তাঁর ওস্তাদ শাহ আবদুল করিমের যে প্রতিচ্ছবি সেটার আরেকটি প্রমাণ হলো, তিনি কোন অনুষ্ঠানে টাকা চুক্তি করে গান পরিবেশন করেন না। গান শুনে কেউ খুশি হয়ে কিছু দিলে তাতেই তিনি খুশি না দিলেও অভিযোগ করেন না।

বর্তমান করোনা মহামারির পরিস্থিতিতে গানের আসর বন্ধ। খুব কষ্ট করে দিন কাটাচ্ছেন শাহ করিমের প্রিয় এই শিষ্য বাউল আবদুর রহমান।

সমাজের হৃদয়বান ও বিত্তবানদের উচিত এমন নির্লোভ মানুষের পাশে দাঁড়ানো। বেঁচে থাকাকালীন যেন তাঁরা তাদের প্রাপ্য সম্মানটুকু পেয়ে যেতে পারেন।

বাউল আবদুর রহমানের দীর্ঘায়ু কামনা করি।