শুভ আজাদ
০৫ জুন , ২০২০
আজ ৫ জুন। বিশ্ব পরিবেশ দিবস। এবার ২০২০ সালের প্রতিপাদ্য হচ্ছে, ‘টাইম ফর নেচার।’ অর্থাৎ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের এখনই সময়।
কোভিড-১৯ এর তাণ্ডবে সারাবিশ্বের মানুষ যখন বিপর্যস্ত তখন প্রকৃতিতে ফিরেছে প্রাণ। গত চার মাস ধরে পৃথিবীর মানুষ একপ্রকার ঘরবন্দি। প্রকৃতির ওপর চালানোর অবিচার কমে আসায় প্রকৃতি যেন নিজেকে মেলে ধরেছে। ফিরেছে স্বমহিমায়। এই বাস্তবতা থেকে নতুন করে শিখতে শুরু করেছে মানুষ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জীববৈচিত্র্য রক্ষার যে তাগিদ দুনিয়াব্যাপি আলোচিত হচ্ছিলো মানুষের অতিপ্রয়োজনীয়তা তাতে বাঁধ সাধছিল। করোনা মানুষের সেই অতিপ্রয়োজনীতা কমিয়ে জীববৈচিত্র্য রক্ষা করছে।
এবার পরিবেশ দিবসের আয়োজক দেশ কলম্বিয়া। জার্মানির সহযোগিতায় এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করবে তারা। গত বছর ছিল চীন। সারা বিশ্বের জীববৈচিত্র্যের ১০ শতাংশই রয়েছে কলম্বিয়াতে। অ্যামাজন এর একটি বড় অংশ রয়েছেই কলম্বিয়াতে। এই অ্যামাজনেই বছরের পর বছর আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকার বনভ‚মিতেও গত বছর বড় রকমের আগুনের সূত্রপাত হয়।
জাতিসংঘ বলছে, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ না করাতে আমাদের পরিবেশের ভারসাম্যই শুধু নষ্ট হচ্ছে না আমরা এর মাধ্যমে আমাদের জীবনকে ধ্বংস করছি। কোভিড আমাদের সেই শিক্ষা দিচ্ছে উল্লেখ করে জাতিসংঘের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, আমরা জীববৈচিত্র্য রক্ষা করলে শুধু খাদ্যেরই যোগান পাব না বরং ওষুধসহ নির্মল পানি এবং বাতাস পাব। যা মানুষের সুস্থতার বড় অনুষঙ্গ হতে পারে।
আয়োজক কলম্বিয়া বলছে, এখন তাদের দেশে প্রায় ১০ লাখ জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের মুখে। জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে এর থেকে গুরুত্বপূর্ণ সময় আর আসেনি। জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ না করায় জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে যার শিকার হচ্ছে বাংলাদেশও। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সঙ্গে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়াতে লবণাক্ত পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে বিস্তর এলাকা। এতে মানুষ
গৃহহীন হয়ে ভাসমান জীবন যাপন করছে। শুধু বাড়িই নয় মানুষ হারাচ্ছে ফসলের মাঠ এবং তার কাজের জায়গাও।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিশ্বের বায়ুমান যাচাই বিষয়ক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ‘এয়ার ভিজ্যুয়াল’ এর বায়ুমান সূচকে (একিউআই) বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম স্থান থেকে সরে ৭৩তমতে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। সূচকের মান জানুয়ারি ফেব্রæয়ারি মাসে যেখানে ছিল ৩০০ এর ওপরে। যা শুধু অস্বাস্থ্যকর নয়, দুর্যোগের পর্যায়ে বলে মনে করতেন বিশেষজ্ঞরা। সেখানে এখন সেই সূচক নেমে এসেছে ৫০ এর নিচে।
অবশ্য লকডাউনের কারণে যানবাহন কম, ইট ভাটা বন্ধ, কনস্ট্রাকশন কাজ বন্ধ থাকায় বায়ু দূষণের মাত্রা অনেক কমে গেছে। আমরা এক সময় যেখানে মাত্রার দিক থেকে প্রথম স্থানে ছিলাম এখন তা বেশিরভাগ দিনই ১০০ এর নিচে থাকে।
প্রসঙ্গত, ১৯৭৪ সাল থেকে জাতিসংঘের মানবিক পরিবেশ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির (ইউএনইপি) উদ্যোগে প্রতিবছর ৫ জুন ‘বিশ্ব পরিবেশ দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়।
মূলত বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালনের পিছনে যে উদ্দেশ্য কাজ করে, তা হলো পরিবেশ সম্পর্কে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা।
তবে প্রকৃতির প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে আপনি যেকোনো দিন বিশ্ব পরিবেশ দিবস হিসাবে পালন করতে পারেন। এই দিবসটি উদযাপনের প্রধান কারণ হলো, পরিবেশ সম্পর্কে মানুষের সচেতনতা বাড়ানো। মানুষও পরিবেশ এবং পৃথিবীর অঙ্গ। প্রকৃতি ছাড়া মানুষের জীবন অসম্ভব। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের অঙ্গাঙ্গী সম্পর্কের কথাটা জানা খুবই জরুরি।
প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী দেশগুলিতে বিশ্ব পরিবেশ দিবস উপলক্ষে সরকারি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। কোভিড-১৯ মহামারীর প্রাদুর্ভাবের কারণে লক্ষ লক্ষ মানুষ ডিজিটাল মাধ্যমেই বিশ্ব পরিবেশ দিবস উদযাপন করবে বলে ঠিক করেছে। লকডাউন মানুষের জীবন বিধ্বস্ত করে দিয়েছে ঠিকই, তবে লকডাউন পরিবেশের ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
বিগত কয়েক বছর যাবত আমার দেখছি, শুনছি এবং পড়ছি, বিশ্বে পরিবেশ দূষণের সমস্যা ক্রমশ তীব্র আকার ধারণ করছিল। মানুষ তাদের সুবিধার জন্য সংস্থান তৈরি করেছে, আর তার জন্য ধ্বংস করেছে পরিবেশকে। এই প্রভাবের কারণে সৃষ্ট সমস্যাগুলির সঙ্গে মোকাবিলার জন্য একটি বিশ্বব্যাপী প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা হয়। আসলে বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালনের মূল কারণ হল পরিবেশ সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করা।
এদিকে শিল্পায়ন এবং নগরায়নের জেরে গোটা বিশ্বজুড়েই পরিবেশের দফারফা। বিশ্ব উষ্ণায়ণ ঘুম ছুটিয়েছে পরিবেশ বিজ্ঞানীদের। যে ভাবে পৃথিবীর উষ্ণতা বাড়ছে, ভ‚গর্ভে সঞ্চিত জল ও জ্বালানি তলানিতে এসে ঠেকেছে, তাতে অদূর ভবিষ্যতে মানব সভ্যতার সামনে যে বিশাল সংকট এসে উপস্থিত হবে তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
প্রযুক্তি এসে যেমন আমাদের জীবন যাপনকে সহজ করেছে, তেমনই ক্ষতিকর প্রভাব ফেলেছে পরিবেশের ওপরে। পরিবেশ রক্ষার দায়িত্ব আমাদের সবার ওপরেই বর্তায়। একটু চেষ্টা করলেই পরিবেশ রক্ষায় উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারি আমরাও। যে পাঁচ উপায় আমরা পরিবেশ রক্ষা করতে পারি, সেগুলি হল-
* গাছ পরিবেশে অক্সিজেন জোগানো ছাড়াও আরও নানাভাবে পরিবেশ রক্ষা করে। তাই পরিবেশ বাঁচাতে আমাদের সবার গাছ লাগানো প্রয়োজন। এছাড়া গাছ বাঁচলে বন্যপ্রাণীও বাঁচবে। তাই বায়োডাইর্ভাসিটির জন্য গাছ লাগানো খুব জরুরি।
* পরিবেশে প্লাস্টিকের প্রভাব অত্যন্ত ক্ষতিকর। তাই একবার মাত্র ব্যবহার করা যায় এরকম প্লাস্টিকের ব্যবহার আমাদের সবাইকে বর্জন করতে হবে। প্লাস্টিকের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ভ‚গর্ভস্থ জল। এমনকি মৃত্যু হচ্ছে নানা ধরনের সামুদ্রিক প্রাণীরও।
* বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয় কয়লা পুড়িয়ে। এর ফলে প্রচুর পরিমাণ গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গত হয়। গ্রিন হাউস গ্যাস, কার্বন ডাই অক্সাইড এবং নাইট্রাস অক্সাইড পরিবেশে দূষণ ঘটায়। তাই সোলার পাওয়ার এবং উইন্ড পাওয়ারের মতো অচিরাচরিত শক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে।
* রাস্তায় যত বেশি সংখ্যক গাড়ি বেরোবে, তত দূষণ বাড়বে। সেই কারণে লকডাউনে পরিবেশ স্বচ্ছ থাকায় বহু দূর থেকেও হিমালয় দেখা গিয়েছে। লকডাউন উঠলেও চেষ্টা করুন ব্যক্তিগত গাড়ির বদলে গণপরিবহণ ব্যবহার করতে। গণপরিবহণ ব্যবহার করলে রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা কমবে।
* পানি নষ্ট যাতে না হয়, সেদিকে আমাদের সবার দৃষ্টি দেওয়া জরুরি। রেইনওয়াটার হারভেস্টিং করলে পানি সঞ্চয় করা সম্ভব। ভ‚গর্ভস্থ পানি কমে আসছে। তাই আমাদেও পানি অপচয় করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
সর্বোপরি পরিবেশ রক্ষার কাজ কোনো দিবস ধরে করার নয়। এই দিবসের তাৎপর্য হচ্ছে-অঙ্গীকার করা, যেন সারা বছর পরিবেশ রক্ষায় আমরা কাজ করি।