Cinque Terre

শামীমা শারমিন

০৬ জুন , ২০২০


নারী উদ্যোক্তা


করোনাকালেও নারীর প্রতি সহিংসতা

নারীর প্রতি সহিংসতা, যৌন নির্যাতন ও খুনের ঘটনা এই করোনাকালিন সময়েও বন্ধ নেই। বাস্তবতা হলো এই ভাইরাস বাড়ে ছাড়া কমে না।  এখনও  প্রতিদিন শিশু ধর্ষণের খবর পাওয়া যায়। নারীদের ওপর অত্যাচার চলছে। নারী ধর্ষণ ও নির্যাতন বিরামহীনভাবে চলছে। থামাবে কে? 

তবু বিশ্বাস রাখতে চাই, দ্রুত বিচার ও একের পর এক রায় ঘোষণাই পারে ধর্ষক-অপরাধীদের জঘন্য নির্যাতনের পথ বন্ধ করতে।

এটা ঠিক যে কঠোর আইন দিয়ে সব সমস্যার সমাধান হবে না। সমাজের সচেতনতাও দরকার। নারীর প্রতি অন্যায় দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন প্রয়োজন। এ ধরনের সহিংসতার বিরুদ্ধে সংগঠিত সামাজিক প্রতিরোধ থাকলে সহজে কেউ নারী ধর্ষণ ও সহিংসতার পথে যেতে পারবে না।

আমি মনে করি, নারীদের প্রতি সব ধরনের সহিংসতার বিরুদ্ধে সংসদে সোচ্চার থাকার জন্য একটি গ্রুপ গড়ে তোলা দরকার। সংসদে নারী নির্যাতনের প্রতিটি ঘটনায় প্রতিবাদমুখর হওয়ার এ রকম একটি প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা এখন খুব দরকার। তাহলে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের একটি সংসদীয় রেকর্ড থাকবে। একদিন মানুষ দাবি করতে পারবে ওই ধর্ষকের বিচার কত দূর? শাস্তি হয়েছে কি? সংসদে এ বিষয়ে আবার আলোচনা তোলার সুযোগ থাকবে।

আলোচনায় ঘুরেফিরে একটি কথা আসে। নারী এখন ‘মাসল, মেন, মানি’ এই তিন এম-এর জাঁতাকলে পিষ্ট। এর সঙ্গে রয়েছে প্রভাবশালী রাজনৈতিক মহল। এই অপরাধী চক্র এমনভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, যার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান না নিলে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা কঠিন।

আইআইডির এক গবেষণা জরিপে দেখা গেছে, নির্বাচনের সময়টা নারীর জন্য আরও ভীতিকর হয়ে ওঠে। নারীরা বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হন। ভয়ভীতি, শারীরিক নির্যাতন ও ভোটের গোপনীয়তা রক্ষায় বাধার কারণে অনেক নারী ভোট দিতে পারেন না। ভয়ভীতির কারণে সবকিছু মেনে নিয়ে অন্যের কথামতো অনেকে ভোট দেন। এই পরিস্থিতি নারীর অধিকার ক্ষুণ্ন করে।

কিন্তু আমাদের দেশে তো ঘরে ঘরে নারী নির্যাতিত। স্বামীর কথার বাইরে যাওয়ার অধিকার যে থাকতে পারে, এ কথা গ্রামের বা সাধারণ ঘরের নারীরা ভাবতেও পারেন না। শ্বশুরবাড়িতে নারী নির্যাতিত হয় যৌতুকের দাবিতে। উঠতে-বসতে খোঁটা সইতে হয়। অনেক নারীকে অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে দেওয়ায় তাঁর লেখাপাড়া আর হয় না। এরপর স্বামীর ঘরে গঞ্জনা সয়ে যাওয়াই তাঁর নিয়তি হয়ে ওঠে। নির্যাতন-অপমান সইতে না পেরে অনেক নারী মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন বা জীবন্মৃত হয়ে সংসারের ঘানি টেনে চলেন। এই দুর্বিষহ পরিস্থিতি থেকে নারীকে মুক্ত করা সমাজের একটি অন্যতম প্রধান কর্তব্য।

ঘরে ঘরে নারীরা ভয়ে থাকেন। প্রায়ই নারী-শিশুরা ধর্ষণ বা নির্যাতনের শিকার হন। অনেক নারী প্রভাবশালীর বিরুদ্ধে মামলা করতে পারেন না। বিচার হয় না। প্রভাবশালীদের চাপে সালিসি মেনে নিতে হয়। বাংলাদেশের মতো ছোট্ট একটি ভ‚মিতে যে নারীদের জন্য এমন ভীতিকর পরিস্থিতি থাকতে পারে, তা অকল্পনীয়। মাঝে মধ্যে বলতে বাধ্য হই, থানার পুলিশ থেকেও নেই। আইন আছে, বিচার চলে না। বিচার-প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত হয়। শেষ পর্যন্ত অনেক মামলা হারিয়ে যায়। আসামিরা জামিনে বেরিয়ে এসে অভিযোগকারীদের হুমকি দেয়। পাশে দাঁড়ানোর কেউ থাকে না।

অনেকে বলেন, পরিবারে মা যেন তাঁর ছেলেদের ছোটবেলা থেকেই নারীকে মর্যাদা দিতে শেখান। যেন তারা বড় হয়ে নারীর প্রতি সহিংস আচরণ না করে। এ তো নিশ্চয়ই দরকার। তবে বিষয়টা অন্য দিক থেকেও দেখতে হবে। আমি প্রশ্ন রাখি, কোনো পরিবারে মা কি কখনো নিজের ছেলেকে নারীর প্রতি সহিংসতা শেখান? এটা কি হতে পারে? আর তা ছাড়া সুশিক্ষার দায়িত্বটা শুধু কি মায়ের? বাবার কি কোনো দায়দায়িত্ব নেই। পরিবারে বাবা যখন মাকে মারধর করেন, অপমানে জর্জরিত করেন, তখন ছেলেমেয়েরা কী শেখে? এটা তো খুব সহজ ব্যাপার। পরিবারের ভেতরে যদি নারীর প্রতি সহিংসতা না থাকে, নারীকে মর্যাদা দেওয়া হয়, তাঁর সমান অধিকারের স্বীকৃতি যদি ঘরে ঘরে প্রতিষ্ঠিত করা হয়, তাহলে হয়তো আমরা একদিন নিজেদের সভ্য সমাজের মানুষ বলে দাবি করতে পারব।

স্থানীয় সরকার, পুলিশ ও প্রশাসন এখানে বড় ভ‚মিকা পালন করতে পারে। কিন্তু দেশে রাজনীতি কলুষিত হয়ে পড়েছে। আমরা সবাই বলি স্বচ্ছতা, সততা ও জবাবদিহির কোনো বিকল্প নেই। মুশকিল হলো, এই তিনটিরই অভাব খুব বেশি। সে জন্যই এই দুর্দশা।

আমরা আশা করি, নারীর প্রতি সহিংসতার যে দুর্যোগকবলিত পরিস্থিতি চলছে, অচিরেই তা কাটিয়ে ওঠা যাবে। এর অবসান হতেই হবে। করোনার সঙ্গে নারী নির্যাতনও নির্মূল হোক।