Cinque Terre

সুমন্ত গুপ্ত

০৮ জুন , ২০২০


সংস্কৃতি-সংগঠক


মোস্তফা সেলিম এবং ‘বাতিঘর থেকে নাগরীচত্বর’ বৃত্তান্ত

পূর্ব জিন্দাবাজারে বাতিঘরের সিংহদ্বারে ঠিক মাথার উপরে ছাউনির মতো করে বিশাল আকারের একটি বইয়ের রেপ্লিকা চোখ পড়বেই আপনার। শ্রী অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত¡নিধির ‘শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত-পূর্বাংশ’, এই যে বইটির মুখশ্রী দেখবেন, তার যদি ইতিহাস জানা থাকে আপনার, তাহলে অবশ্যই মনে পড়বে মোস্তফা সেলিমের নামটি। সিলেট অঞ্চলের ইতিহাসের এই আকর গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছিল ঠিক ১১০ বছর আগে ১৯১০ সালে কলকাতা থেকে, হাজার পৃষ্ঠার এই বইয়ের উত্তরাংশ বের হয় ১৯১৭ সালে, প্রায় বিলুপ্ত এই বইটির দু-একটি কপি যা ছিল, তার হদিশ জানা ছিল না সাধারণের। সেই বইটি প্রকাশ করে ২০০১ সালে প্রকাশক হিসেবে অভিষেক হয় তাঁর। এখানেই ইঙ্গিত পাই, নিছক ব্যবসা করতে তিনি এখানে আসেননি। তারপর তিনি তো শ্রীহট্ট অঞ্চলের প্রথম বাংলা গ্রন্থ ‘শ্রীহট্ট দর্পণ’ থেকে শুরু করে বহু বিলুপ্ত, দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ উপহার দিয়ে এই অঞ্চলে ইতিহাসকে অন্ধকারে তলিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি থেকে রক্ষা করেছেন, সে কথা অনেকেই জানেন।

এবার একটু সামনে পুরানলেনে সিলেটের সবচেয়ে বনেদি বইয়ের দোকান নিউনেশনে ভেতরে প্রবেশ করলেই অধুনা জেগে ওঠা নাগরীলিপির হরফ দেখতে পাবেন তাদের বিশাল প্রতিষ্ঠানের ফাঁকে ফাঁকে। এখানে আপনার দেখা মেলবে বিরাট আকারের ‘কেতাব হালতুন্নবী’র একটি রেপ্লিকাও। প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার আনোয়ার রশিদ যেখানে বসেন, ঠিক তার মাথার উপরে নাগরীলিপিতে লেখা নিউনেশন লাইব্রেরি। এই প্রতিষ্ঠানের বর্তমান প্রজন্মের পূর্বজ মুন্সি আব্দুল করিম ছিলেন নাগরীলিপির প্রথম পেশাদার প্রকাশক। ১৮৬০ সালে তিনি ‘ইসলামিয়া প্রেস’ স্থাপন করে শুরু করেছিলেন এর মুদ্রণ। তার পাশের দালানে মধুবন মার্কেটে রয়েছে ‘রাগীব রাবেয়া নাগরী ইনস্টিটিউট’। তার ঠিক ডানপাশে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, এখানেও জেলা প্রশাসকের ভবনের একটি বিশাল দেয়ালে ম্যানিয়েচার করে স্থাপন করা হয়েছে নাগরীলিপি। তার সামনে কিনব্রিজের সামনের পয়েন্টে বিশাল নাগরীচত্বর। এই চত্বর প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি সিলেটে সিটি করপোরেশনের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক মতবিনিময় সভা করেছেন ২০১৪ সালে। 

এই যে শহরময় নাগরীলিপির নতুন জাগরণ, তার চেতনা ছড়িয়েছেন মোস্তফা সেলিম। সক্রিয়ভাবে তিনি এই জাগরণের লক্ষে এক দশক থেকে মেধা, বুদ্ধি, অর্থ ব্যয় করে চলেছেন অকাতরে। নাগরীলপির শতশত বই তিনি ছড়িয়ে দেয়েছেন আমেরিকার শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি থেকে শুরু করে ভারতের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠাগারে। বাংলাদেশে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঢাকা বিশ্বাবদ্যালয়ে। এই  যে সবখানে ছড়িয়ে গেলো বিলুপ্ত বর্ণমালার নতুন জয়গান, তার সূত্রপাত তিনি করেছেন ২০০৯ সালে। তারপর এক দশকে তিনি নিবেদিত হয়ে নিরলস যোগীর মতো চালিয়ে যাচ্ছেন তাঁর সাধনা। পুথি সংগ্রহ, বই প্রকাশ, নানা সাংগঠনিক আয়োজন, ডকুমেন্টারি নির্মাণ তার প্রদশর্ন, দেশে বিদেশে নানা সেমিনার সিম্পোজিয়ামে অংশগ্রহণ, দেশের মূলধারার গণমাধ্যামে লেখালেখি এবং আলোচনায় অংশগ্রহণের তিনি অক্লান্ত। জীবনের তিন দশক যখন তাঁর বয়স তখন তিনি এসেছিলেন প্রকাশনায় সিলেটের মানুষের জন্য আর্শীবাদ হয়ে, এখন তিনি ৫১ বছরে পদার্পণ করলেন। গত বছর সিলেটের লেখক-সাংস্কৃতিককর্মীরা বিপুল উৎসাহে তাঁর ৫০তম জন্মদিন পালন করেছিলেন সিলেট শহরের সারদা হলে, একইভাবে বাংলাদেশের প্রকাশক সমাজ ঢাকায় উদযাপন করেছিল ৫০তম জন্মদিন।

১৯৭০ সালের ৮ জুন মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা উপজেলার ইটাউরি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। লুপ্ত বর্ণমালা সিলেটি নাগরীলিপি ও সাহিত্য গবেষণা, প্রকাশনা এবং তার নবজাগরণে অনন্য ভূমিকা রেখে তিনি দেশ-বিদেশে নন্দিত। সিলেট অঞ্চলে প্রচলিত ছয় শ বছরের ঐতিহ্যবাহী নাগরীলিপি-গবেষক মোস্তফা সেলিম নাগরীলিপির ২৫টি পুথি সম্পাদনা (যৌথ) করে ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছেন। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে ‘সিলেটি নাগরীলিপি সাহিত্যের ইতিবৃত্ত’ (২০১৮) বইটি নাগরী-সাহিত্য গবেষণা-সম্পর্কিত বইয়ের ক্ষেত্রে এক অনন্য গ্রন্থ হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা আদায় করে নিয়েছে। এর বাইরে তাঁর রচিত ‘সিলেটি নাগরীলিপি সাহিত্যে প্রণয়োপাখ্যান’ (২০১৯), ‘নাগরীলিপির সহজ পাঠ’ (২০১৯), ‘নাগরীলিপি : নবজীবনের জার্নাল’ (২০১৮), ‘নাগরীলিপি বর্ণ পরিচয়’ (২০১৫) উল্লেখযোগ্য। তবে তাঁর প্রথম গ্রন্থ ‘মুক্তিযুদ্ধে বড়লেখা’ ১৯৯৯ সালে প্রকাশিত হয়। এছাড়া তাঁর প্রকাশিত সম্পাদিত বইয়ের মধ্যে ‘বড়লেখা : অতীত ও বর্তমান’ (২০০০), ‘সিলেট বিভাগের লেখক অভিধান’ (২০০৬), ‘গিয়াসউদ্দিন আহমদ সমগ্র’ (২০১৫), ‘বাংলাদেশ ভ্রমণসঙ্গী’ (২০১১) ও ‘ভারত নেপাল ভুটান ভ্রমণসঙ্গী’ (২০১৫), ভেলা শাহ ফকিরের ‘খবর নিশান’ উল্লেখযোগ্য।    

রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর মোস্তফা সেলিম ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। ১৯৯০ সালে তিনি মদনমোহন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ ছাত্র সংসদের সাহিত্য ও বিতর্ক সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। শিক্ষকতা দিয়ে কর্মজীবন শুরু করলেও পরে ঢাকায় ‘উৎস প্রকাশন’ নামে একটি প্রকাশনাসংস্থা চালু করেন। তাঁর প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশনাসংস্থা হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। সেরা মানের গ্রন্থ প্রকাশনার জন্য তাঁর প্রতিষ্ঠান ২০০৭ সালে বাংলা একাডেমি এআওয়ার্ড অর্জন করেছে।

বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী সম্পাদক হিসেবেও মোস্তফা সেলিম দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমানে রোটারি ক্লাব অব মতিঝিলের প্রেসিডেন্ট। তিনি ‘বাংলাপিডিয়া’, ‘লিবারেশনওয়ার পিডিয়া’সহ বিভিন্ন গবেষণা-প্রকল্পে কাজ করেছেন। সম্পাদনা করছেন ‘ভ্রমণচিত্র’ নামের একটি মাসিক সাময়িকী। দেশ-বিদেশে আমন্ত্রিত বক্তা হিসেবে অংশগ্রহণের পাশাপাশি অসংখ্য জার্নালে নিয়মিতভাবে নাগরীলিপি-বিষয়ক লেখা লিখেছেন। 

মোস্তফা সেলিমের সংগ্রহে নাগরীলিপিতে রচিত বহু পুথির পাণ্ডুলিপিও রয়েছে। এই পুথি সংগ্রহে তিনি ছুটে চলেছেন গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। দেশের চৌহদ্দি পিরিয়ে বিদেশে, কখনো ভারতে, কখনোবা বিলেতের বার্মিংহামে। এই সংগ্রহকে আর্কাইভে সংরক্ষণের উদ্দেশে এখন তিনি কাজ করছেন। তাঁর কাজের স্বীকৃতি নিয়ে বাংলাদেশের  শীর্ষ দৈনিকগুলো ফিচার প্রকাশ করেছে এবং টেলিভিশনগুলো নানা অনুষ্ঠান প্রচার করেছে।

এই কর্মযোগী, সিলেট অন্তপ্রাণ মানুষটির জন্য সিলেটের ইতিহাস-ঐতিহ্য চর্চায়-সাধনায় নবপ্রাণ সঞ্চারিত হয়েছে। তাঁর হাতেই ফুটেছে নানা ফুল, তিনি হারানো গৌরবকে আবার জাতির সামনে উপস্থাপন করে সিলেট মাতার মুখকে উজ্জ্বলতর করে তুলেছেন। বাতিঘর থেকে নাগরী চত্বর, গোটা সিলেট শহরে ছড়িয়ে রয়েছে তাঁর কাজের পরিসর। তাঁর কাজে তিনি আমাদেরকে গৌরবান্বিত করে আমাদেরই সম্মানিত করে চলেছেন। তাই তিনি আমাদের পরমবন্ধু, আত্মীয়। এমন এক সিলেটপ্রেমী মানুষের জন্মদিনে তাই আমাদের আনন্দ অপার। এই গুণী মানুষের ৫১তম জন্মদিনে জানাই আমার প্রণতি।