Cinque Terre

মোহাম্মদ আলী

১০ জুন , ২০২০


প্রাবন্ধিক


ভূমির অধিকার ও সরকারের দায়

করোনা ভাইরাসের কারণে গত মার্চ মাস থেকে মানুষ মূলত ঘরবন্দী। কেউ কেউ বের হলেও আয়-রোজগারে ভাটা পড়েছে। শহর বা নগরে যারা বাস করেন, তাদের নব্বই শতাংশ ভাড়াটে বাসায় থাকেন। এই মহামারীর কালে যাদের নিজের বাসা-বাড়ি আছে, তারা কোনো রকমে জমানো টাকায় বা কারও সহযোগিতায় কোনোমতে দিনগুজরান করছেন। কিন্তু যারা বাসাভাড়া দিয়ে থাকেন তাদের আয়ের সিংহভাগ যেখানে বাসা ভাড়ায় চলে যায়, সেখানে খাওয়া-পরা যে খুব কষ্টে-সৃষ্টে করতে হয় তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এদিকে গ্রামে গঞ্জে যারা পরের বাড়িতে আশ্রিত হয়ে থাকেন, তাদেরও ভোগান্তির শেষ নেই। 

আমাদের দেশে প্রভাবশালীদের কবলে অনেক দুর্বলের ভূমি পদানত রয়েছে। শক্তি বা মামলা করেও তারা তা উদ্ধার করতে পারেন না। কত প্রাণ যে এই ভ‚মি রক্ষায় চলে যায়, তার হিসেবইবা কে রাখে?

মূলত গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর ৬০ ভাগেরও বেশি মানুষ ভ‚মি অধিকার বঞ্চিত। এই তথ্য সরকারি-বেসরকারি একাধিক জরিপে বেরিয়ে এসেছে।

নিয়নামুযায়ী সরকারি খাসজমি ভূমিহীনদের মধ্যে বণ্টনের কথা থাকলেও বাস্তবে তা কতটা হয় তা নিয়ে প্রশ্ন তো আছেই; উল্টো দুর্বল জনগোষ্ঠীকে নিজ ভিটে থেকে উচ্ছেদের অভিযোগও আছে বিস্তর। এই বাস্তবতার মধ্যেই প্রতি বছর ১০ জুন পালিত হয় ‘ভূমি অধিকার দিবস’।

দেশের আদিবাসীরা তাদের নামের সঙ্গে আদি শব্দ জুড়ে দেওয়া থাকলেও মূলত তারা ভূমির অধিকারের ক্ষেত্রে অধিক বঞ্চিত। টাঙ্গাইলের মধুপুরে গারোদের আদি বাস হলেও সেখানে তারা তাদের ভ‚মির অধিকার হারাচ্ছেন বলে গণমাধ্যমে প্রায়ই খবর আসে। বন বিভাগ ওই এলাকার ৯ হাজার একর জায়গা রিজার্ভ ফরেস্ট ঘোষণা করেছে। এ কারণে চাষের জমি তো অবশ্যই ভিটেবাড়ি থেকেও উচ্ছেদের দুশ্চিন্তায় থাকতে হয় তাদেরকে। 

একইরকম শঙ্কায় থাকেন দেশের কয়েক লাখ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের  আদিবাসী মানুষ। তাদের দাবি, ন্যাশনাল পার্ক, ইকোপার্ক কিংবা সামাজিক বনায়নের নামে তাদের উচ্ছেদের পাঁয়তারা বেশ পুরনো। এসব থামাতে আন্দোলনে আদিবাসীদের রক্তও ঝরেছে কয়েকবার কিন্তু পরিস্থিতি বদলায়নি।

আদিবাসী বিভিন্ন সংগঠনের দাবি হচ্ছে, সরকার যেন সরকারি জায়গা ডিমারকেশন করে নেয়। আর তাদের জায়গা তাদেরকে ডিমারকেশন করে দেয়। তাদের সাফ কথা হলো, তারা যেন সরকারের কাছে খাজনা দিতে পারে।

এদিকে আদিবাসীদের জমির প্রচলিত দলিল দস্তাবেজ নেই। তবে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত পদ্ধতি হলো, বংশানুক্রমিকভাবে তারাই জমির মালিক হয়েছেন। এই সুযোগটাই নিতে চায় রাষ্ট্র ও ক্ষমতাশালীরা। অবশ্য শুধু আদিবাসীরা নন ভূমির ক্ষেত্রে দুর্বলরা বরাবরই বঞ্চিত, এমনটাই অভিমত বিশেষজ্ঞদের। এ কারণে ভূমি সুশাসন নিশ্চিত করা উচিত। ভূমিহীনের সংখ্যা কমাতে কৃষিজমি বণ্টনের যে নীতিমালা আছে তারও বাস্তবায়ন জরুরি।

অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (এএলআরডি) জরিপ বলছে, দেশের কৃষিনির্ভর গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর ষাট ভাগের উপরে মানুষ কিন্তু ভূমি অধিকার বঞ্চিত, তাদের ভূমি নেই। অথচ তাদের জীবন যাপন, তাদের পেশা, জীবিকা, সবকিছুই ভূমি নির্ভর।

কিন্তু সরকারের দাবি, আদিবাসী বা বাঙালি সকলের জন্যই ভূমির অধিকার নিশ্চিতে কাজ করছেন তারা। এ ব্যাপারে প্রশ্ন উত্থাপিত হলে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কথা হলো, আদিবাসী কৃষকের জন্য ভূমি বন্দোবস্ত এবং আদিবাসীরা যদি ভূমিহীন হয় তাহলে তাদেরকে ভূমি বন্দোবস্ত দেওয়া হচ্ছে। তবে বলতে দ্বিধা নেই, বাস্তবতা তা পুরোপুরি বলছে না।

১৯৮৫ সালে পাবনার সাথিয়ায় জেগে ওঠা ঘুঘুদহ বিলে ভূমির অধিকার ফিরে পেতে আন্দোলন করেন ভূমিহীনরা। সফল আন্দোলনের ফলস্বরূপ সে বছরের ১০ জুন থেকে পালিত হয়ে আসছে ‘ভূমি অধিকার দিবস।’

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নানা কারণে এক দিকে যেমন বাড়ছে ভূমিহীনের সংখ্যা তেমনি গ্রামে কর্মহীন হয়ে ভূমিহীনরা ভিড় করছেন শহরের বস্তিতে। তাই বাড়ছে বস্তিবাসীর সংখ্যাও। মোটের উপর এই চাপ গিয়ে পড়ছে রাষ্ট্রের কাঁধেই। এমন চাপমুক্তির অন্যতম সমাধান ভূমির অধিকার নিশ্চিত করা।

তথ্য-উপাত্তে দেশের ষাট ভাগ মানুষ ভূমির অধিকার বঞ্চিত বলা হলেও আদতে তাদের সংখ্যা আরও অধিক। আজ ভূমি অধিকার দিবসে সরকারের কাছে দাবি, দেশের সকল পরিবারের অন্তত মাথা গোঁজার ঠাঁই হোক। বাহুবলে নয় অধিকারের ভিত্তিতে আদিবাসীসহ বঞ্চিতরা যেন ফিরে পায় তাদের অধিকার এই প্রত্যাশা।