Cinque Terre

হেলাল উদ্দিন ঠাকুর

১৪ জুন , ২০২০


প্রাবন্ধিক


সংবাদ প্রভাকর : প্রথম বাংলা দৈনিক

করোনার কোপে পড়ে ছাপা পত্রিকা পড়ছি না গত প্রায় তিনমাস ধরে। অনলাইনে তথ্য জানা যায় ঠিক, কিন্তু পাঠের তৃপ্তি আসে না। এই ছাপা পত্রিকার কথা ভাবতে গিয়ে মনে পড়ল কবে কোথায়, কীভাবে প্রথম পত্রিকার যাত্রা হয়। ইন্টারনেট গেটে ১৪ জুন যে একটি বিশেষ দিন তা জেনে কিছু লেখার প্রয়াস করছি। বেশ ঘেঁটে দেখলাম, ইতিহাস বলছে, কবি ঈশ্বর গুপ্তের সংবাদ প্রভাকর ভারতবর্ষের প্রথম দৈনিক সংবাদপত্র। 

‘সংবাদ প্রভাকর’ ১৮৩১ সালে প্রথমে সাপ্তাহিক রূপে প্রকাশিত হলেও ১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দের ১৪ জুন দৈনিক রূপে আত্মপ্রকাশ করে। 

উনিশ শতকের বাংলাভাষী ভূখণ্ড ভারতবর্ষের যেকোনো ভূ-ভাগ থেকে স্বতন্ত্র ও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল জাতীয় চেতনার দ্বন্দ্ব ও গতির আবর্তে। রাজসভা থেকে সাহিত্যের গতিবিধি জনসভা তথা জনগণকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হতে শুরু করে। তবে বাংলা ভাষার প্রথম ‘গণমাধ্যম’ ‘সমাচার দর্পণ’ (১৮১৮)-এর প্রকাশ শব্দশিল্পকে পৌঁছে দেয় সাধারণ শিক্ষিত মানুষের দোরগোড়ায়। 

ঈশ্বর গুপ্তের ‘সংবাদ প্রভাকর’ (১৮৩১) প্রকাশের ফলে এই জনসভার সাহিত্যচর্চার গতি হয় আরও বেগবান, বৃহত্তর জনজীবনমুখী। সাহিত্যিকের হাত কীভাবে রাজসভা থেকে জনসভা, জনসভা থেকে বৃহত্তর লোকজীবনমুখী হয়ে ওঠে, ঈশ্বর গুপ্ত তার প্রমাণ। 

বাংলার সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক জীবনের ঘটনাবলির সমান্তরালে লুপ্তপ্রায় সাহিত্যকর্ম আবিষ্কার, লোকসাহিত্য আবিষ্কার ও প্রকাশ এবং নতুন লেখকদের রচনা প্রকাশ এই পত্রিকার অনন্য ঐতিহাসিক ভ‚মিকা প্রমাণ করেছে। 

অক্ষয় কুমার দত্তের সম্পদনায় ১৮৪২ সালে প্রকাশিত সাময়িকপত্র ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’য় কেবল তত্ত্ববিদ্যা, সাহিত্য, দর্শন, ইতিহাস, পুরাতত্ত্ব, বিজ্ঞান ও ভ‚গোল বিষয়ক প্রবন্ধের সঙ্গে নারী শিক্ষা ও বিধবা বিবাহের সমর্থন এবং বাল্য বিবাহবিরোধী উচ্চমানের প্রবন্ধ প্রকাশিত হতো। তিনি সংস্কৃত, ফরাসি ও জার্মান ভাষায় সুপণ্ডিত ছিলেন। 

উনিশ শতকের বাংলার সাময়িকপত্র-সংবাদপত্রের ইতিহাস বাংলায় নবজাগরণ ঘটায়। ‘সংবাদ প্রভাকর’ প্রকাশের পর থেকে সাহিত্যচর্চার সমান্তরালে সামাজিক-সাংস্কৃতিক জীবনে সংঘটিত ঘটনা প্রবাহের বিশ্লেষণ, নতুন লেখক সৃষ্টি যেমন বৃদ্ধি পেতে থাকে, তেমনি শিক্ষার প্রতিও বৃদ্ধি পেতে থাকে মানুষের আগ্রহ। উনিশ শতকের এই নব্যশিক্ষত বাঙালি তরুণরাই বাংলা সাহিত্যকে বিশ্বমানে উন্নীত করেন। 

দেশ বিভাগের পর ১৯৪৮ সাল থেকে সূচিত ভাষা আন্দোলন, ১৯৫২’র জাতিসত্তার রক্তিম উজ্জীবন এবং পরবর্তী সামাজিক-রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ এ ভূখণ্ডের সাহিত্য সাময়িকী ও দৈনিক পত্রিকার জগতে নবধারার সূত্রপাত করে। ফলে এ ভূখণ্ডের সাহিত্য-শিল্প পাকিস্তানের নয়া-ঔপনিবেশিক, স্বৈরতান্ত্রিক সাংস্কৃতিক রুচি ও দৃষ্টিভঙ্গি থেকে স্বতন্ত্র হয়ে যায়।

দৈনিক পত্রিকার ‘রবিবাসরীয়’ সংখ্যার মাধ্যমে ব্যাপক জনগোষ্ঠীর মাঝে নব্য বিকাশমান স্বাধীনতাকামী বাঙালি জাতিসত্তার অঙ্কুরিত আকাক্সক্ষা পৌঁছে দেওয়া হয়। প্রতিদিনের রাজনীতি সাহিত্যের বিশুদ্ধ শিল্পলোককে হয়তো বা কিছুটা রক্তাক্ত করেছে; কিন্তু বাংলাদেশের সাহিত্য চেতনার রূপায়ণে একটা জাতিগত স্বতন্ত্র চরিত্র অর্জন করে। ১৯৪৭-৭০ সময়কালে এ দেশে প্রকাশিত সাময়িকপত্রের সংখ্যা ৫০০ (সূত্র : শামসুল হক : বাংলা সাময়িকপত্র (১৯৪৭-৭০)। 

এসব সাময়িকপত্রের মধ্যে প্রগতিবাদী, আধুনিক চিন্তাধারার সাময়িকপত্রের পাশাপাশি পাকিস্তানবাদী সাহিত্যিক আবর্জনাও কম ছিল না। তবে সেসব পত্রিকা ষাটের দশকের শেষান্তে এসেই অন্তর্হিত হতে শুরু করে। ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের রক্তস্রোত বাংলাদেশের সাহিত্যলোককেও নতুন সম্ভাবনার পথে ধাবিত করে।

যা-হোক এখন বাংলা পত্রিকার সংখ্যা যে কত তা গণনা না করে বলা সম্ভব নয়। ভালো-মন্দ মিলিয়ে বাংলা ভাষায় কয়েক হাজার সংবাদপত্র রয়েছে। অনলাইন হিসেব করলে এ সংখ্যা অনেক বড় নিশ্চয়। সিলেট মিরর অনলাইনসহ সিলেটের প্রায় সবকটি পত্রিকায় ঢু মারার চেষ্টা করি। কিন্তু  কখন হাতে পাব একটি ছাপা পত্রিকা সেই প্রতীক্ষায় আছি।