Cinque Terre

সুমন বনিক

১৭ জুন , ২০২০


কবি ও ব্যাংকার


বাজেট : জীবন-জীবিকার হিসেব

অর্থনীতির স্থবিরতা ও চরম মন্দা অবস্থাকে সঙ্গে নিয়েই এবারের বাজেট প্রণয়ন করা  হলো। পৃথিবী যখন করোনার ছোবলে আতঙ্কিত ঠিক এরকম ক্রান্তিকালে আমরা জীবন-জীবিকার হিসেব কষে অর্থ বছরের বাজেট প্রণয়ন করছি। এটাই বাস্তবতা। কারণ জীবন প্রবহমান নদীর মতো। থেমে থাকে না। দুঃখ  বেদনা মৃত্যু মহামারী সঙ্গে নিয়েই জীবন পথচলে। বাজেট নিয়ে বরাবর একটি দৃশ্য আমরা দেখি। 

বাজেট যেদিন উত্থাপিত হয়; তার পরের দিন পত্রিকার পাতায় সরকার পক্ষের লোকজন বলেন ‘এবারের বাজেট গণমুখী বাজেট কিংবা গরিব বান্ধব বাজেট অপরদিকে সরকার বিরোধী পক্ষ বলেন গরিব মারার বাজেট কিংবা গণবিরোধী বাজেট। আমি সেই রাজনৈতিক দৃষ্টিতে বাজেটকে না-দেখে; এবারের বাজেটের অন্তর্নিহিত অর্থনৈতিক দিকটি তুলে ধরার চেষ্টা করবো। এক নজরে এবারের বাজেটটি দেখে নিই। এবারের বাজেটের আকার ৫লাখ ৬৮হাজার কোটি টাকার। 

বাজেটে আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩লাখ ৮২হাজার ১৩কোটি টাকা,ঘাটতি ধরা হয়েছে ১লাখ ৯০হাজার কোটি টাকা। একনজরে দেখে নিই মোটা দাগের ব্যয়ের খাতগুলো। পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে ১১.২%,শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে ১৫.১%,প্রতিরক্ষা ৫.৪%,কৃষি ৩.৬%স্বাস্থ্য ৫.২%জনপ্রশাসন৬.৭%স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন ৭.৩%ইত্যাদি খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে। আমি শুধু এবারের বাজেটে  প্রস্তাবিত স্বাস্থ্য খাতের ব্যয় বরাদ্দের দিকটি তুলে ধরবো। করোনাভাইরাস  মহামারী রূপ ধারণ করে গ্রাস করছে মানুষের প্রাণ। কুরে কুরে খাচ্ছে এদেশের অর্থনীতির হৃদপিন্ড গার্মেন্টস,  কৃষি। অজানা অচেনা চরিত্রহীন এই ভাইরাসের ছোবল থেকে মানুষকে রক্ষা করতে হলে এদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়ন অতি জরুরি। একথা স্বীকার করতেই  হবে , মানুষকে  সুস্থ না-রেখে অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখার কোনো সুযোগ নেই। এবারের বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২৯২৪৭ কোটি টাকা যা  মোট  বাজেটের ৫.২% এবং জিডিপি’র ১.৩%। ইতিপূর্বে ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে বরাদ্দ ছিল  ১৮৬৭৭ কোটি টাকা এবং ২০১৯-২০ এ ছিল ২৫৭৩২ কোটি টাকা। করোনাভাইরাস প্রতিরোধে ১০হাজার কোটি টাকা থোক বরাদ্দ রাখা হয়েছে। 

সরকারের এই উদ্যোগ প্রশংসার দাবি রাখলেও কিছু কথা না-বলে পারছি না। বাংলাদেশে ৬৫০০ জনের জন্য একজন চিকিৎসক সেবাদান করেন। কী ভয়াবহ অবস্থা! শুধু কী তাই। স্বাস্থ্য খাতে অবকাঠামো উন্নয়ন হয়েছে দৃশ্যমান। বিল্ডিং আছে শুধু। নেই ডাক্তার। নেই চিকিৎসা সরঞ্জাম। কমিউনিটি ক্লিনিকের বেহাল অবস্থা বর্ণনা করার মতো নয়। করোনাকালে আমাদের স্বাস্থ্য অব্যবস্থাপনার কঙ্কাল মূর্তি দেখতে পেলাম। কীরকম আব্যবস্থাপনা চলছে তার করুণচিত্র ফুটে উঠেছে।  জনগণের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জায়গাটা এতোটাই নাজুক; যা ধারণা করা যায়নি। স্বাস্থ্য বিভাগের কর্তা ব্যক্তিদের দক্ষতা নিয়েও জনমনে প্রশ্ন ফুলে ফেঁপে উঠছে। তাই জনগণের প্রত্যাশা স্বাস্থ্য খাতের ব্যয় বরাদ্দের বিষয়টি দক্ষ ব্যবস্থাপনায় নির্বাহ করা। দক্ষ এবং স্বচ্ছ চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার অভাবে আজ গোটা স্বাস্থ্য সেবা ঝুঁকির মুখে পড়েছে। 

বাজেটে কৃষি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সামাজিক নিরাপত্তা খাতগুলো আরও গুরুত্ব দেওয়া উচিত ছিল। সে তুলনায় দৃশ্যমান খাত পরিবহণ এবং সড়ক সেতু উন্নয়নে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

এবারের বাজেটে অর্থ আহরণের যে উৎসগুলো আছে সেগুলো হচ্ছে  জাতীয় রাজস্ব বোর্ড নিয়ন্ত্রিত কর৫৮.১%,অভ্যন্তরীণ ঋণ১৯.৪%, বৈদেশিক ঋণ১৩.৪%,কর ব্যতীত প্রাপ্তি ৫.৮% ইত্যাদি ইত্যাদি। বাজেটে আয়ের উৎসের যে প্রবাহ দেখানো হয়েছে তা আদায় করা এতটা সহজ নয়। কারণ জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে ৩লাখ৩০হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আদায়ের যে লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়েছে সেই লক্ষ্যে পৌঁছানো হিমালয় পর্বত আরোহণের সমান। ফলে ঘাটতি আরও বাড়বে। লক্ষ্যে না-পৌঁছানোর কারণটি হচ্ছে করোনাকালে ব্যবসা-বানিজ্য লাটে উঠেছে। তাই এই স্থবির ব্যবসা বানিজ্য থেকে ভ্যাট আদায় হ্রাস পাবে। আনেক ব্যবসায়ী কর মওকুফ চাইছে। আমদানি রপ্তানি বাণিজ্যে ভাটা পড়ায় শুল্ক আদায় হ্রাস পাবে। কর্মসংস্থান কমে যাওয়ায় আয়কর কমবে। সুতরাং আমরা দেখছি রাজস্ব আদায় আশানুরূপ  না-ও হতে পারে। এই সংশয় একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বাজেটে আয়ের আর একটি উৎস হচ্ছে অভ্যন্তরীণ ঋণ। সঞ্চয়পত্র বিক্রি এবং ব্যাংক ব্যবস্থাপনা থেকে ঋণ সংগ্রহ করে অর্থের যোগান দেওয়া। ব্যাংক থেকে ৮৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার কথা। সরকার ব্যাংক থেকে বেশি ঋণ নিলে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ হ্রাস পাবে। ফলশ্রুতিতে, বিনিয়োগ হ্রাসের কারণে কর্মসংস্থান কমবে।  জিডিপি প্রবৃদ্ধি হ্রাস পাবে। এবারের বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৮.২%। বিশ্ব ব্যাংক বলেছে ১%। আই.এম. এফ.বলেছিল বাংলাদেশে নতুন অর্থ বছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি  হতে পারে ৯.৫%তবে পূর্বশর্ত হিসেবে করোনার দ্রুত বিদায়, বিনিয়োগ বৃদ্ধির মতো অনুমান নির্ভর উপাত্তের ভিত্তিতে এরকম পূর্বাভাস দিয়েছিল। আবার ফরেন রেমিটেনস, পোষাক রপ্তানি বাণিজ্যে ভাটা পড়লে এই প্রবৃদ্ধি অর্জনের সম্ভাবনা ক্ষীণ হবে। বাজেট মানেই খড়গহস্ত অর্থনীতির মূর্তি নয়।

এবারের বাজেটের ভালো দিকগুলো হচ্ছে বাজেটে ১০%কর প্রদান করে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দিয়েছে। এ বিষয়ে নৈতিকতার প্রশ্ন থাকলেও বিদেশে অর্থ পাচার হ্রাস পাবে এবং রাজস্ব বাড়বে। তবে এই অপ্রদর্শিত অর্থ স্বাস্থ্যসেবা খাতে বিনিয়োগের সুযোগ দিলে রুগ্ন স্বাস্থ্য সেবা খাত সবল হতো। বাজেটে ব্যক্তিগত আয়ের করসীমা বাড়ানো হয়েছে। স্বাস্থ্য বিভাগের বিভিন্ন পণ্যের উপর থেকে শুল্ক কর কমানো হয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি।

সবশেষে এটাই বলবো বাজেট প্রণয়নে কৃতিত্ব নেই, বরং বাজেটকে বাস্তবায়নের পথে এগিয়ে নেওয়াটাই কৃতিত্ব। অর্থমন্ত্রী একজন কৃতী অর্থনীতিবিদ হিসেবে সেই কাজটি করে দেখাবেন এটাই জনগণ প্রত্যাশা করছে। 

বাজেট বাস্তবায়নের প্রতিটি স্তরে দুর্নীতিকে না বলতে হবে।  দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স বজায় রাখতে হবে। যদি করোনা মহামারী অতি অল্পদিনে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়, যদি দেশের অর্থনীতির চাকা সচল হয়, যদি বিশ্ব মন্দা কেটে যায় তাহলে আমাদের এবারের বাজেট আলোর মুখ দেখবে। এই কতিপয় ‘যদি’ প্যান্ডোলামের মতো আমাদের অর্থনীতির মাথার ওপর ঝুলছে।