Cinque Terre

মিনহাজুল ইসলাম জায়েদ

১৭ জুন , ২০২০


সিনিয়র সহকারী সচিব


বিনয়ী কামরান : কিছু স্মৃতি

সরকারি মুরারী চাঁদ কলেজে সম্মান প্রথমবর্ষে ভর্তি হয়ে বসবাসের উদ্দেশ্যে সিলেট শহরে প্রথম পা রাখি ২০০০ সালের মাঝামাঝি সময়ে।  তবে সে সময়ে নিয়মিত থাকা হয়ে উঠেনি। মাঝেমধ্যে এসে দু’চারদিন হাজিরা দিয়ে আবার চলে যেতাম। 

২০০১ সালের ডিসেম্বরের শুরুতে আবাসিক ছাত্র হিসেবে ছাত্রাবাসে উঠার পর থেকে সিলেটে নিয়মিত অবস্থান শুরু করি। পরের ২১ ফেব্রুয়ারিতে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে সহপাঠী কয়েকজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু মিলে ছাত্রাবাস থেকে ‘সিঁড়ি’ নামক একটি সাহিত্য সাময়িকী প্রকাশ করা হয়। সাময়িকির জন্য বাণী সংগ্রহ ও সিটি কর্পোরেশনের বিজ্ঞাপন আনতে বন্ধু বি. এম আবুলকে (বর্তমানে সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার, রূপালী ব্যাংক, সুনামগঞ্জ কর্পোরেট শাখা) সঙ্গী করে এক সকালে হাজির হই তৎকালীন সিলেট সিটি কর্পোরেশনের মেয়র বদর উদ্দিন আহমদ কামরানের বাসায়। তাঁর বিনয়, সদাচরণ ও সদালাপী চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সর্ম্পকে আগে থেকে অবগত হলেও এটাই ছিল তাঁর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাত। 

ছাত্রাবাসের অনেকেই, এমনকি আমাদের এই উদ্যোগের সঙ্গে জড়িত অন্য বন্ধুরাও পরামর্শ দিয়েছিল যেহেতু আমাদের সঙ্গে তাঁর কোন পূর্ব পরিচয় নেই তাই উনার সঙ্গে সম্পর্ক আছে এমন কারও মাধ্যম হয়ে যেন আমরা দেখা করি। তাদের সেই পরামর্শ কর্ণপাত না করে আমরা সরাসরি চলে যাই। আমরা যখন পৌঁছাই তখনো তিনি বৈঠকখানায় আসেননি। অথচ এরইমধ্যে অনেক মানুষের সমাগম হয়ে গেছে।  শয়নকক্ষে বসে নৈশকালীন পোশাক পরেই তিনি সবার আবদার পূরণ করছিলেন। পরিচয় দিয়ে আমাদের বিষয়টি উত্থাপন করলে তিনি খুব খুশি হয়ে আমাদেরকে এমন উদ্যোগ নেওয়ার জন্য অভিবাদন জানান। (উল্লেখ্য, শিল্প-সংস্কৃতির প্রতি তাঁর বিশেষ অনুরাগ ছিল।  তিনি বাংলাদেশ ক্রীড়া লেখক সমিতি, সিলেট জেলা শাখার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন)। অনেককেই এ ধরনের সহায়তা করতেন বিধায় আমাদের দাবির অর্ধেক পরিমাণ আর্থিক সহায়তা অনুমোদন করে করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার কাছে জমা দেওয়ার কথা বললেন। চা পান না করিয়ে আসতে দেননি। সম্পূর্ণ অপরিচিত আমাদের সঙ্গে এমন আন্তরিক আচরণ একেবারে অপ্রত্যাশিত ছিল।

আমরা যখন চায়ের অপেক্ষায় সে সময়ে হাতে লেখা একটি আবেদন পত্র নিয়ে হাজির হন এক বয়স্কা মহিলা। গায়ের পরিধেয় জানান দিচ্ছিল নিম্নবিত্ত পরিবারের সাধারণ একজন। ‘মা’ সম্বোধন করে মেয়র মহোদয় জানতে চান তার সমস্যার কথা। মহিলা হাতের আবেদন পত্রটি দিয়ে তাতে সুপারিশের অনুরোধ করেন। পত্র পড়ে মেয়র সঠিকভাবে লেখা হয়নি মন্তব্য করে তাকে বসার অনুরোধ জানান। মহিলা অল্পক্ষণ পরে চলে যান। কিছুক্ষণ পরেই মহিলাকে না  দেখে তার লোকদেরকে তাকে খোঁজে আনার নির্দেশ দেন। তাদের একজন উনাকে রাস্তা থেকে ফিরিয়ে নিয়ে আসে। পুনরায় তাকে ‘মা’ সম্বোধন করে মেয়র জানতে চান তিনি কেন চলে যাচ্ছিলেন। প্রতিত্তোরে মহিলা বলেন আবেদনপত্র ঠিক হয়নি বলে তিনি স্বাক্ষর না করায় ফিরে যাচ্ছিলেন। মেয়র উত্তর দেন আবেদন সঠিক হয়নি বলেছি কিন্তু ফিরে যেতে বলিনি। অতঃপর, তাঁর সহকারীকে ডেকে আবেদনটি সঠিকভাবে লিখে দেওয়ার নির্দেশ প্রদান করেন। পুরো ঘটনাটি স্বচক্ষে দেখে মনে হয়েছে একজন সিটি মেয়র তাঁর কোন নাগরিকের সঙ্গে নয়, কোন আদুরে সন্তান যেন কথা বলছে তার মমতাময়ী জননীর সঙ্গে। 

ফিরতি পথের পুরোটাই এই ঘটনাটি নিয়ে আমরা বিশ্লেষণ করেছি। অনেক সময় গ্রামের একজন ইউনিয়ন পরিষদ সদস্যের সঙ্গেও সাধারণ জনগণ এতটা কাছ ভীড়তে পারে না। অথচ প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদা সম্পন্ন হয়েও তাঁর দ্বার ছিল সবসময় সবার জন্য উন্মুক্ত।

পরবর্তীতে ছাত্রাবাসে থাকাবস্থায় সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়লে এবং একই মতাদর্শের  অনুসারী হওয়ায়  অনেকবার তাঁর বাসা ও নগরভবনে যাওয়া হয়েছে। প্রতিবারই তাঁর আদরমাখা স্নেহ-মমতা পেয়েছি। ছাত্র জীবন শেষে সিলেটে প্রায় অর্ধদশক সাংবাদিকতা করার সুবাদে বহুবার তাঁর সঙ্গে সাক্ষাত হয়েছে। সর্বদা তাঁর বিনয়ী স্বভাব, সদাচারণে মুগ্ধ হয়েছি। 

সিলেটের সাংবাদিক মহলে উল্লেখযোগ্য সব রাজনৈতিক দলের অনুসারী রয়েছেন। রাজনৈতিক নেতা কিংবা নির্বাচনের প্রার্থী হিসেবে সাংবাদিকের অনেকে বদর উদ্দিন আহমদ কামরানের বিরোধী হলেও ব্যক্তি কামরানের বিরোধী কেউ ছিলেন না। একইভাবে নগরবাসীর অনেকেই রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে তাঁর প্রতিপক্ষ হলেও ব্যক্তি কামরানের কোন প্রতিপক্ষ ছিল না। অমায়িক আচরণ, সদালাপ, বিনয় আর ভদ্রতার আভরণে তিনি আপন করে নিয়েছিলেন সমগ্র সিলেটবাসীকে। তাই নেতা হিসেবে আওয়ামী লীগের হলেও মানুষ হিসেবে তিনি হয়ে উঠেছিলেন ‘জনতার কামরান’। বদর উদ্দিন কামরানের প্রয়াণে গোটা সিলেটবাসী আজ শোকে মুহ্যমান। দল, মত, জাতি, ধর্মের ঊর্ধ্বে ঊঠে সবাই তাঁর বিয়োগব্যথায় কাতর। মহান রাব্বুল আলামীনের কাছে আকুল আবেদন মানুষ হিসেবে বদর উদ্দিন কামরানের ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলো যেন মার্জনা করে দেন। তিনি যেভাবে মানুষকে আপন করে নিয়েছিলেন, এভাবে পরলৌকিক জীবনে ক্ষমাশীল আল্লাহ যেন তাঁকে আপন করে জান্নাতের অতিথি হিসেবে গ্রহণ করে নেন। 

লেখক : সিনিয়র সহকারী সচিব