Cinque Terre

শ্যামল কান্তি ধর

১৭ জুন , ২০২০


ব্যাংক কর্মকর্তা


প্রাণ ভরে শ্বাস নিতে চাই

বর্ণবাদের হাঁটুর নিচে জর্জ ফ্লয়েডের শ্বাসনালী যখন নিষ্পেষিত তখন মানবাধিকারের চোখ বোধহয় কালো কাপড়ে ঢাকা ছিল। ফ্লয়েড আর্তনাদ করে বলছিলেন ‘আমি শ্বাস নিতে পারছি না’। এ আর্তনাদ এখন বিশ্ববাসীর আর্তনাদ। প্রাণ ভরে শ্বাস নেওয়ার দাবি এখন সবার।      

জর্জ ফ্লয়েডের স্মরণসভা ও সংবাদসম্মেলনে তার স্ত্রী যখন কথা বলছিলেন, ফ্লয়েডের মেয়ে তখন চুপচাপ ছিল। সে শুধু একটি কথাই বলেছে ‘আমার বাবা পৃথিবী বদলে দিয়েছেন’। আসলে বিশ্ববাসীর বুকের ভেতর এক চাপা কান্না ছিল। ফ্লয়েড সবার এই চাপা কান্নাকে আর্তনাদে রূপ দিয়েছেন। এমনিতেই করোনা পরবর্তী এক নতুন পৃথিবীর কথা বলা হচ্ছে। করোনা বদলে দিচ্ছে পৃথিবী। ফ্লয়েড হত্যাকান্ডের পর বিশ্বব্যাপী তার প্রতিবাদ বদলে যাওয়ার পৃথিবীরই ইঙ্গিত দিচ্ছে। সারা পৃথিবীর নাগরিক বিভিন্নভাবে অনেকদিন ধরে শ্বাসরুদ্ধ। তৃতীয় বিশ্বের মানুষতো এটা মেনে নিয়েই জীবনটাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। 

মানুষ প্রাণ ভরে শ্বাস নিতে চায়। মানুষ মারণাস্ত্র তৈরি প্রতিযোগিতায়, সবুজ ঘাসে স্থল মাইন বিস্ফোরণে, নীল আকাশে বোমারু বিমানের হুঙ্কারে, নীল সমুদ্রে পরমানবিক বিস্ফোরণ পরীক্ষায় পৃথিবীবাসী অনেকদিন ধরেই শ্বাসরুদ্ধ। প্রতিনিয়ত জীবাণু অস্ত্র ছড়িয়ে দেওয়ার হুঙ্কার দেওয়া হয়। কথায় কথায় এক দেশের ওপর আরেক দেশের অর্থনৈতিক অবরোধ দেওয়া হয়। সীমান্তের বাঁধা টপকে মানুষ বাঁচতে চায়, সমুদ্র তীরে পড়ে থাকে শিশু আয়ানের লাশ। বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার অর্থ ব্যয় করা হয় মানবতার বিরুদ্ধে। এখন করোনা নামক প্রাকৃতিক অস্ত্রের কাছে জিম্মি গোটা বিশ্ব। এই যুদ্ধে অসহায় পরাক্রমশালী বিশ্ব নেতারা। এরই ভেতর ফ্লয়েডের শ্বাসনালীতে হাঁটু দিয়ে চেপে ধরে হত্যা করা হল। তাই শ্বাসরুদ্ধ প্রতিটি মানুষ এবার প্রান ভরে শ্বাস নিতে চায়।

আবার ফ্লয়েড হত্যাকান্ডে সারাবিশ্ব যখন প্রতিবাদমুখর তখন কিছু মানুষ মেতে আছে নিরীহ প্রাণী হত্যায়। লকডাউনের ভেতরেই একটি ডলফিন যখন সমুদ্র তীরে ঘুরে বেড়াচ্ছে তখন তাকে হত্যা করা হল। বানরদের বিষ খাইয়ে, শিয়াল, মেছো বাঘ হত্যা করে আমরা এখন এক নির্মল আনন্দ লাভ করছি। অন্তঃসত্ত্বা হাতির পেটের ভ্রুন হাতিটিও নিশ্চয় আর্তনাদ করে বলেছিল, ‘আমি শ্বাস নিতে চাই’। আমরা শুনিনি। একটু উন্নত জীবনের আশায় যারা মানবপাচারকারীর  ঘোরানো পথে পাড়ি জমিয়েছিলেন লিবিয়ায়, তাঁরা নিশ্চয় মৃত্যুর আগ পর্যন্ত প্রাণ ভরে শ্বাস নিতে চেয়েছিলেন।   

শোনা যাচ্ছে জুন মাস থেকেই গার্মেন্টস শ্রমিকদের ছাঁটাই শুরু হবে। যাতে এ অবস্থা না হয় এর জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রনোদনা ঘোষনা করলেন এবং তা বাস্তবায়িত হল। কিন্তু এতেও শেষ রক্ষা হলো না। বিশ্বে ভোক্তা চাহিদা কমছে। ৫৫ শতাংশ ক্যাপাসিটিতে ফ্যাক্টরী চলছে। তাই মালিকপক্ষদের এই সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে। দেশের অর্থনীতির চাকা যারা ঘুরাচ্ছে তারা এখন বেকার হয়ে যাবে। তারা দাঁড়াবে কোথায়? তাদেরও শ্বাসনালী বন্ধ হবার পথে, তারাও প্রানভরে শ্বাস নিতে চায়।

ভোগবাদ বিশ্বব্যবস্থায় প্রকৃতি আজ অসহায়। পরিবেশ প্রতিনিয়ত বিপর্যস্ত হচ্ছে বৈশ্বিক উষ্ণতায়। হিমবাহের বরফ গলে বাড়ছে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা। উন্নত বিশ্বের অতিরিক্ত কার্বন নিঃস্বরণে আমরা হারাচ্ছি আমাদের ঋতু বৈচিত্র্য। আমরাও শ্বাস নিতে চাই। পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থায় শুধুই মুনাফা, আরও মুনাফা। এই মুনাফার চক্রে সবাই দিশেহারা। কারও কারও সম্পদ বৃদ্ধি হতে হতে আকাশ ছুঁয়ে যায়। তবু থাকে শ্রমিকের চাকরি হারানোর ভয়। 

তবু দৌড় থামেনা। মুনাফার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ক্রমেই বাড়ে নাগরিক অস্থিরতা। পুঁজিবাদের চক্রে গ্রামের ওই কৃষকও দিশেহারা। তাই প্রতিটি মানুষ প্রান ভরে শ্বাস নিতে চায়। জর্জ ফ্লয়েডের মেয়ে জিয়ানার কথামতোই পৃথিবীটা বদলে যাক। বদলে যাওয়া পৃথিবীতে প্রাণ ভরে শ্বাস নিক সবাই।

বদলে যাওয়া পৃথিবীতে আমরা কিছু আশা অবশ্যই করতে পারি। স্বপ্ন দেখি, চাকরি হারানোর ভয়ে ভীত যে শ্রমিক, তার কাঁধে হাত দিয়ে ভরসা দিচ্ছেন মালিকপক্ষসহ দেশের অন্যান্য বিত্তবান। চোখে চোখ রেখে বলছেন, আমরা আছি আপনাদের পাশে। আপনাদের শ্রমের ঘামেই এই সম্পদ। বদলে যাওয়া পৃথিবীতে প্রাণ ভরে শ্বাস নিক সবাই।  

করোনাও আঘাত হানে ফুসফুসে। প্রচন্ড শ্বাসকষ্টে রোগী প্রাণ ভরে শ্বাস নিতে চেয়ে পারে না। কেউ কেউ বেঁচে ফিরছেন, প্রাণ ভরে শ্বাস নিচ্ছেন। কেউ কেউ চলে যাচ্ছেন না ফেরার দেশে। প্রতিদিন বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যা। টেলিভিশন স্ক্রলে এ সংখ্যা দেখে আতংক বেড়েই চলেছে। বিশ্ব নীতিনির্ধারকরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে রাখতে প্রতিনিয়ত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু নিয়ন্ত্রণে রাখা যাচ্ছেনা। করোনার শ্বাসকষ্টে মানুষের মৃত্যু নিয়ন্ত্রিত রাখতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নিয়মিত নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছে। সেই সময় জর্জ ফ্লয়েডকে শ্বাসকষ্টে মরতে হল করোনার কারণে নয়, মানুষের কারণে।