Cinque Terre

সালেহ আহমদ খসরু

১৭ জুন , ২০২০


প্রাবন্ধিক 


এ কান্না সম্প্রীতির ফেরিওয়ালার জন্যে

বদর উদ্দিন আহমদ কামরান! না, কামরান ভাই। সকলের একই উচ্চারণ, যেন একই সুতায় গাঁথা শিউলি মালা।  গত সোমবার ঝরে পড়েছে অন্য কোনো রাঙা কামনায়, সৃষ্টিকর্তা মহান রব আল্লাহ পাক এর প্রেমের টানে সব জাগতিক ভালোবাসা দুমড়ে মুচড়ে অনন্তকালের তরে নতুন আসনে বসতে খুব বেশি দ্রুত পৌঁছে গেলেন! 

বিশ সালের ১৫ই জুন প্রতিবার ফিরে আসবে, কিন্তু যে বিষ ছড়িয়ে যাচ্ছে গোটা পৃথিবীময় সেটি একটি অতি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অনুজীব এবং তা ল-ভ- করে দিচ্ছে কতো স্বপ্ন-বিবর্ণতায় ছেয়ে গেছে কতো ক্যানভাস-সেই কথা ভাবলেই মন শিউরে উঠে। তেমনি এক চিত্রশিল্প আজ বিবর্ণ, চিত্রকর আর কোন রঙ দিয়েই ‘কামরান ভাই’ নামক ভালোবাসার চিত্র রাজপথ থেকে বৈঠক খানা কিংবা কোন বৈঠকি আসরে গেয়ে উঠবেন না ‘বন্ধু হতে চেয়ে তোমার শত্রু বলে গণ্য হলাম।’ না কামরান ভাই আপনি শত্রু নয় বরং পরম মিত্র ছিলেন আপন দলের ও সাধারণ মানুষের। আর এখন মিত্র হয়ে সিলেটের তরুলতা দোলে দোলে বলছে- রাজনীতি দোষের নয় বরং এটি মানুষকে ভালোবাসার সুরম্য অট্টালিকায় রাজপুত্রের আসনে বসায় যদি সেই পথ বেয়ে হেঁটে যেতে পারেন আর ছড়াতে পারেন নিস্কলুষ প্রেম। 

হ্যাঁ কামরান ভাই, আপনি সেটি পেরেছেন। যে কারণে বিএনপি আপনার কট্টর বিরোধী দল হয়েও ভালোবাসা ছড়িয়ে দিচ্ছে সঙ্গে অন্যান্য বিরোধী মত পথ সব এক মোহনায় মিলিত হয়ে নতুন ¯্রােতের রিনিঝিনিতে জানান দিয়ে গাইছে- অনন্ত প্রেমের রাগ ভৈরবী।

একই সময়ে আরও বহু বড় রাজনৈতিক নেতা প্রয়াত হয়েছেন এবং সেই প্রতিক্রিয়া মিশ্র  হলেও থামানো যায়নি। যদিও ক্ষোভ অভিমানের সঙ্গে বলা সেই সব অনুভূতির দাসত্ব আমি মানিনি কিন্তু রোধ করতে পারিনি যেমন আমরা সকলে তেমনি রাষ্ট্র যন্ত্র দিয়েও দমন করা যায়নি অনাকাঙ্খিত আচরণ। অবাক করা বিষয় দু’জনের রাজনৈতিক প্লাটফর্ম এক, তাই মন সায় দেয় কোন প্লাটফর্ম দোষের নয় বরং অপরাধী কেবল ওই বিচ্ছিন্ন ঘটনার চরিত্র যারা হয়তো আপনার মতো মহানায়ক হতে পারতেন। কে জানে অদৃশ্যের নিয়ন্ত্রণ যার হাতে সেই মহান রব সবাইকে কবুল করেন না। 

হাজার বছরের ঐতিহ্য চিরঞ্জীব হয়ে আছে সিলেটের সম্প্রীতির সংস্কৃতি এবং এই ঐতিহ্যের লালন করে ফেরি করে বেড়িয়েছেন সব শতকে কোনো না কোনো ফেরিওয়ালা যার ধারাবাহিকতায় এ শতকের যে ক’জন নিপুণভাবে আলো ছড়িয়েছেন তার আপাত শেষ আলোর ফেরিওয়ালা ছিলেন আপনি ‘কামরান ভাই'। বলবেন কি কার হাতে রেখে গেছেন সেই পেলব মসৃণ মিষ্টি সরল হাসির সম্প্রীতির পতাকা?Ñ হয়তো পেয়ে যাবো আরও কোনো দ্যুতিময় হাতে, কিন্তু সেই হাসি সেই মাধুর্য আর কোথায়! এই হেথা না অন্য কোথা কে জানে! কারণ ক্রমেই ছোট হয়ে আসছে সিলেটের বিশাল প্রেমময় ক্যানভাস। তাই আপনার প্রস্থানে মন এখন শঙ্কিত, বিশ্বাস রাখতে ভয় হয় পাছে হোঁচট খেয়ে বসি! তবুও সিলেটের আবহমান সংস্কৃতি হতাশ করেনি কখনও, হয়তো এবারও কেউ না কেউ আলোর মিছিলের অগ্রভাগে রেখে যাওয়া পতাকা বুকে ধরে এগিয়ে যাবে। এগিয়ে নেবে, সে-তো ভবিষ্যৎ। কিন্তু আপনি কেমন করে এতো হাসি ছড়াতেন যদি বলে যেতেন! কি যাদুকরী হাসির সঙ্গে আপনার ডান হাত উঠে যেত সালাম জানাতে জনতার প্রতি, হে জনতার কামরান তা ভেবে মন কেনো যে উদাস হয়ে যায় সেকথা কি আপনি শুনছেন! 

মনে পড়ে কতো স্মৃতি-কোনটা বলি বা কার কথা কই, তাই নিয়ে ভাবছি। কারণ জাতীয় রাজনৈতিক ঝঞ্জাও আপনাকে টলাতে পারেনি নিজের একান্ত আদর্শ থেকে। এ নিয়ে খোদ নিজের দলেই কতো অনাকাক্সিক্ষত প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে, সে কথা রাজনৈতিক ও গণমাধ্যমে স্পষ্ট, তব্ওু জনতার কামরান ‘দলকানা’ হয়ে উঠেননি বলেই আজ আমি আমরা, সে, তাহারা সবাই বলছে, কাঁদছে। এটিই আপনার বিজয়। এখানেই আপনি অমর হয়ে গেলেন ‘কামরান ভাই’। আর এই বিজয় পালক কেড়ে নেওয়া যায়না। শুধু এ মিছিলে শরিক হয়ে বলা যায়- হে রাজনীতি এজন্যই বোধহয় তুমি এক নেশা, যার হয়, তার হয়, সব বিলিয়ে শেষে সে-ই জয়ী হয়।  

বেশ মনে পড়ছে আমার পিতার মৃত্যুর পর সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এসে সান্ত¡না দেওয়া, জানাজায় শরিক হওয়া, অতপর কাঁধে হাত রেখে মমতা ভরা কণ্ঠে এমন করে বলা যেন বিশাল এক পাহাড়ের গায়ে হেলান দেবার নির্ভরতা দিয়ে মনকে সারিয়ে তোলা! এই কাঁধে হাত রাখার গল্প যে কতো সিলেটির প্রাণ জুড়িয়ে যেতো সে কথা কি আপনি বুঝতেন কামরান ভাই!!  

আচ্ছা কেউ কি বলতে পারেন মেয়র কামরান, চেয়ারম্যান কামরান বা কমিশনার কামরান ভাইÑকার অনুষ্ঠান বাদ দিতেন!  তিনি কোন দল করেন, বাম ডান না-কি পক্ষ-বিপক্ষ এসব আমলেই নিতেন না। বরং তাঁর উপস্থিতি সরব জানান দিতো তিনি জনতার কামরান। 

এই-যে নির্দলীয় ভাবমূর্তি, এটি দিয়েই জিতে নিতেন সব নির্বাচনী ট্রফি কিন্তু প্রকৃতির বিধানেই কি-না জানিনে, না-কি দেশিয় রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট আপনাকে শেষ নির্বাচনী  বিজয় উপহার দিতে পারেনি। আপনার প্রিয় সিলেট সিটি করপোরেশন আর তা বিশ্লেষণের আজ মোটেই দরকার নেই এবং জরুরিও নয়। 

বরং যে বিজয় আপনি ১৫ই জুন মাত্র গতকাল অর্জন করে চির বিদায় নিলেন, তা সিলেটের মানুষের মনের রাজ সিংহাসনে চিরস্থায়ী হয়ে রইল, ঠিক যেন জনতার কামরান-সম্প্রীতির কামরান, জনতার হৃদয়ে কেঁদে গেলো, দোলে উঠল বনানী। তাতে একটি সুরই মূর্ছিত হলো- এ কান্না সম্প্রীতির ফেরিওয়ালার জন্যে, এ কান্না আমাদের সকলের।