Cinque Terre

প্রণবকান্তি দেব

১৮ জুন , ২০২০


শিক্ষক ও সংগঠক


বিদায় : বদরউদ্দিন কামরান

‘একটি মৃত্যুর শোকে/ আজকের ভোরবেলা ভরে গেল স্মরণীয়তায়।/ অনেক দিনের পরে/ রৌদ্রকেও মনে হলো শিল্পসচেতন।/ ঝাউবনে হাওয়ার বিলাপ

শুনেছো তো/ মানুষটি জ্বরে ঘুমোতে গিয়েছে?/ এতদিন আমাদের নাড়ী ও নক্ষত্রে মিলেমিশে/ এতদিন আমাদের পরবাস-যাপনের অলৌকিক পুরাণ শুনিয়ে/ এতদিন প্রিয়মুখস্মৃতিগুলি সরু টানে এঁকে/ দেবতার দুহিতাকে আমাদের রোজকার বৌ-ঝির সিঁথিতে সাজিয়ে/ বর্ণকে মন্ত্রের ন্যায় নিনাদিত করে/ ঘুমোতে যাওয়ার মতো/ মানুষটি চলে গেল আরো বড়ো স্বপ্নের ভিতরে।/ মৃত্যুর বর্ণাঢ্য শোকে/ আজকের ভোরবেলা ভরে গেল শিল্পমহিমায়।’(পূর্ণেন্দু পত্রী)

হ্যাঁ, তাই তো মনে হচ্ছে, ঘুমোতে যাবার মতো করেই যেন মানুষটি চলে গেলেন। শোকের এতো গভীর চাদরে যে তিনি ঢেকে দিয়ে যাবেন অগনিত মানুষের মন-তা তো কেউ ভাবেনি। একটি মানুষকে ঘিরে এ-ই যে এতো বিলাপ, এতো মাতম, এতো করুণ আর্তনাদ, স্মৃতির এতো এতো পাতার উড়াউড়িতে এই যে ঢেকে যাচ্ছে ডিজিটাল দুনিয়া, বুকের ভেতর এই যে তুমুল ভাঙন, এতো যে কাতর কথায় ভার হয়ে আসছে শত সহ¯্র প্রিয় জনের কন্ঠ-সে কী কেবল একজন রাজনীতিকের জন্য! না, বাতাসে ছড়িয়ে পড়া এ হাহাকার, এ নোনা ক্রন্দন একজন হৃদয়বান মানুষের জন্যও।

বদরউদ্দিন আহমদ কামরান, এখন কেবলই ঝরে যাওয়া এক অশ্রুধারার নাম। গত সোমবার চিরঘুমে যাবার পর থেকে তিনি কেবলই স্মৃতি হয়ে ঘুরছেন মানুষের মনের ফ্রেমে। না, আমার এই ক্ষুদ্র জীবনকালে একজন মানুষের জন্য অমন বিলাপ আর দেখিনি। ফেইসবুকের দেয়াল জুড়ে কেবলই কামরান, কামরান কান্না। হ্যাঁ, এই নগরীর নাড়ি, নক্ষত্রে তিনি এমন ভাবেই যে জড়িয়ে ছিলেন!

মানুষকে কাছে টানার এক মুগ্ধ যাদুকর ছিলেন কামরান। একবার যে তাঁর কাছে যেতে পেরেছে, সে ই তাঁর মায়ার বাধনে আটকা পড়েছে। আওয়ামী রাজনীতি করলেও তাঁর দরজা ছিল সবার জন্য খোলা। আমার মনে হয় কী জানেন,  কামরান চরিত্রের সবচেয়ে বড়ো দিকটি হচ্ছে তাঁর ধৈর্য্য এবং প্রতিহিংসার মনোভাব না থাকা। হাসিমুখে মানুষকে বুকে টেনে নেওয়ার অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল তাঁর এবং মানুষই ছিল তাঁর রাজনীতির আরাধ্য বিষয়বস্তু। আজকালকার স্যুটেড-বুটেড রাজনীতিকদের বিপরীতে পাজামা-পাঞ্জাবির মোহন মুগ্ধতা ছড়িয়ে কামরান পথ চলেছেন প্রতিদিন। 

কিছু সৌভাগ্য আমারও হয়েছে তাঁকে দেখার, তাঁকে উপলব্দির, তাঁকে বুঝার। দেখেছি, রাজনীতির ময়দানে উত্তাল এক পুরুষকে স্নেহ বিগলিত একজন বাবা হিসেবে, দেখেছি শুধু বাইরের নয় নিজের পরিবার, স্বজনদের প্রতি সমান দায়িত্বশীল এক মানুষ হিসেবে।  বিরোধী দলে থাকা অবস্থায় রাজনীতির উত্তাল দিনগুলোতে একজন স্নেহাদ্র বাবা হিসেবে ছেলে শিপুলকে মিছিলে, মিটিংয়ে যেতে বারণ করতেন যেন তার গায়ে কোনো আঁচড় না লাগে। কামরান যখন এই নগরীর তুমুল ক্ষমতাবান, তখন ছেলে মেয়েদের শেখাতেন বিনয়, শেখাতেন মানুষ হওয়ার পাঠ। কামরান কখনো ক্ষমতার দম্ভ দেখিয়েছেন-এটা কেউ বলতে পারবেন না। আর এভাবেই তিনি প্রতিদিন যে এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে গেছেন তা টের পাওয়া গেল গতকাল মৃত্যুর পর। আমি বলি, সতীর্থদের মূল্যায়ন আর তরুণ কর্মীদের উজাড় করা ভালোবাসা-ভাবাবেগ কামরানকে তাঁর গণমুখী রাজনীতির বদলা দিয়েছে। যে কামরান রাজনীতির বাইরে সিলেটের শিল্প, সাহিত্য, ক্রীড়া, সংস্কৃতি-প্রত্যেকটি অঙ্গনের মানুষের কাছে  ‘আপনজন’ হয়ে উঠেছিলেন, তাঁকে হারিয়ে সেই মানুষদের হৃদয় ছেঁড়া হাহাকার, শোক আর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন তাঁকে, তাঁর কর্মকে অনন্য মর্যাদা দিয়েছে। তাঁর মৃত্যুও পর থেকেই দেখছি, কেবলই দেখছি আর্জেন্টিনার জার্সি গায়ে, করিমের গানে, শেখ হাসিনার মঞ্চে, কতো শতো সভায়, ব্যক্তিগত অ্যালবামে-কোথায় ছিলেন না তিনি!

তিনি এমনই এক নেতা ছিলেন, এমনই এক বন্ধু ছিলেন তাঁর সঙ্গে কার যে স্মৃতি নেই সেটা বলা দুস্কর! 

কামরানের জীবনে না পাওয়ার মাঝে কেবল একটাই দেখি, নৌকা প্রতীক নিয়ে মেয়র হতে না পারা! ভোটের হিসাব, রাজনীতির মারপ্যাঁচ বড়ো জটিল কিন্তু এ-ই না পাওয়া তাঁর জীবনে ছন্দপতন ঘটিয়েছে বলে মনে হয় না। কেননা ভোটে পরাজিত হওয়া মানে তো আর ভালোবাসায় পরাজয় নয়। মানুষ তাঁকে হৃদয় উজাড় করে ভালোবেসেছে বার বার।

বদরউদ্দিন আহমদ কামরান-আপনাকে সহজে ভুলা যাবে না, মানুষের মনে আপনি যে দখলদারিত্ব নিয়েছেন  সেখান থেকে আপনাকে উচ্ছেদ করা এতো সহজ না। আপনি তো মিশে আছেন এই নগরীর প্রতিটি ধুলিকণায়, মানুষের কান্না-হাসিতে। আপনার এই আকস্মিক চলে যাওয়া বেদনার যে ঝড় তুলেছে মানুষের মনে, সে ঝড় সহজে থামবে না। এ শহর কাঁদবেই, মেহেদী কাবুলদের কান্না খুব সহজে থামানো যাবে না। 

সুরমার বহমান জলের ধারার মতোন কামরানের গল্পও ফুরাবে না কোনো দিন। দিনে দিনে দিন চলে যাবে, ব্যস্ত হয়ে উঠবে মানুষ হয়তো কিন্তু মানুষের মুখে মুখে ঘুরে ফিরে থাকবেন কামরান। মানুষের বিপদে, সমাজের সংকটে, সম্প্রীতির দুর্দিনে আপনার নাম উচ্চারিত হবেই হৃদয়ের গহীন থেকে। এই ক’দিনে সেটি প্রমাণ হয়ে গেছে। 

ওপারে ভালো থাকবেন ‘জনতার কামরান’, মানিক পীরের শীতল বিছানায় খুব শান্তিতে ঘুমাবেন, গাছের ছায়ার আড়াল থেকে প্রিয়জনদের দেখবেন। 

বিদায়!