Cinque Terre

আশরাফুল আলম

২০ জুন , ২০২০


প্রাবন্ধিক


যাকাত : দয়া নয় দরিদ্রের হক

যাকাত ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। যাকাত কোন করুনা বা দয়া নয়। এটি গরিবের হক। লৌকিকতা, যশ-খ্যাতি ও পার্থিব স্বার্থের উদ্দেশ্য থেকে মুক্ত হয়ে একমাত্র মহান আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে যাকাত প্রদান করতে হয়। আল্লাহর রাসুল (সা.)  বলেন, ‘কোন ব্যক্তি যদি তার ধনসম্পদের যাকাত না দেয় তবে ওই সম্পদ কিয়ামতের দিন অজগর সাপের আকার ধারণ করে  তার গলদেশ বেষ্টন করবে।’ অথচ এই যাকাত নিয়ে আমাদের দেশের কিছু ধনী ও কিছু  যাকাতদাতা ব্যক্তিদের ধ্যান ধারণা কি রকম তা কিছু ঘটনা দিয়ে বর্ণনা করা যাক।

এক

বালি গ্রামের এক ধনাঢ্য ব্যক্তি ঢাকা শহরে বসবাস করেন। উনার বাবা জমিরউদ্দীন ছিলেন একজন কৃষক। ধনাঢ্য ব্যক্তির ঢাকা শহর ও নারায়ণগঞ্জ জেলায় চারটি  গার্মেন্টস কারখানা আছে। উনি প্রতিবছর রমজান মাসে আসলেই নিজগ্রাম সহ আশপাশ কয়েক গ্রামে গরিব মানুষের মধ্যে কাপড় দেন। কাপড় দেওয়ার আগে মসজিদে মসজিদে মাইকিং করা হয়। ঢাকা শহর থেকে যাকাতের কাপড় কিনে নিয়ে ঢাকঢোল পিটিয়ে যাকাতের কাপড় বিলি করেন। এই যাকাতের কাপড় নিতে এসে অনেক গরিব বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, শিশু মানুষের  পদদলিত হয়ে আহত হয়। দেখা যায়, ২০০-৩০০ টাকা যাকাতের কাপড়ের জন্য ৫০০টাকার ওষুধ লাগে। এই রকম দৃশ্য প্রতিবছর ঢাকা ও অন্যান্য  বড় শহরগুলোতে দেখা যায় যে, অসহায় ও গরিব মানুষরা একটা যাকাতের কাপড়ের আশায় সারাদিন প্রখর রোদে লাইনে দাঁড়িয়ে সন্ধ্যার সময় কাপড়ের পরিবর্তে  লাশ হয়ে বাড়িতে ফিরে। এই সব অসহায় মানুষের অসহায়ত্ব নিয়ে উচ্চদালানের মানুষরা যে খেলা করে তা সত্যিই  মানবজাতির জন্য লজ্জাকর! মানুষ বলাবলি করে এই বছর জমিরউদ্দীনের ছেলের যাকাত নিতে প্রচুর লোক এসেছিল। পরের দিন বিভিন্ন লোকাল পত্রিকায় ও অনলাইন পত্রিকায় বিভিন্ন বীরত্বসূচক উপমা দিয়ে গুণকীর্তন করে লেখা হয়। কিছু মানুষ তেল মর্দনের জন্য, কিছু মানুষ বুঝে না বুঝেই ফেইসবুকে জান্নাতের সার্টিফিকেট দেওয়ার জন্য আমিন আমিন কমেন্ট করে গুণকীর্তন করতে থাকে।

 

দুই

রাশেদ সাহেব সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন। ঢাকা উত্তরায় তার চারতলা বিল্ডিং আছে এবং রামপুরায় ছয় তলা বিল্ডিং আছে। রমজান মাস আসলেই একটা চিন্তা এসে পড়ে তা হল যাকাত। বাড়িভাড়া, ফিক্সড ডিপোজিট ও অন্যান্য আয়ের উৎসের জন্য বছরে দুইলক্ষ টাকা যাকাত আসে। উনি পাশের এতিমখানায় দশ হাজার টাকা আর পরিচিত কিছু  গরিব ব্যক্তিদের হাতে কিছু টাকা দিয়ে যাকাত আদায় করেন। উনি এই কাজ  করে নিজের দায়িত্ব শেষ হয়েছে মনে করেন। উনি কিন্তু টাকা, সম্পদের মায়ায় তার যাকাত সম্পূর্ণ আদায় করেননি নিশ্চয়।

 

তিন

কোন এক মসজিদের ঈমাম সাহেব ইসলাম বিষয়ে অভিজ্ঞ আলেম এবং জ্ঞানী  মানুষ। উনি রমজান মাস আসলেই যাকাত বিষয়ে প্রতি শুক্রবার কিছু সময় বয়ান করেন। উনার এই কাজের জন্য চার চারবার ঈমামতির চাকরি চলে গেছে। এই বিষয়ে বয়ান করায় ও মসজিদ কমিটির কিছু সদস্য ও কিছু মুসল্লি পছন্দ করে না। কিছু মুসল্লী আছেন হজ্জ ও উমরা একাধিক বার করেছেন কিন্তু যাকাত বিষয়ে উদাসীন। তাহলে এই হজ্জ ও ওমরা কি লোকদেখানো নাকি আল্লাহ সন্তুষ্টির জন্য! এইসব বিষয় ঈমাম সাহেবকে মনে কষ্ট দেয় আর চিন্তিত হয় এই ভেবে যে, এই সব মুসল্লীগণ মহান সুবহানাল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টির জন্য আমল না করা, দুনিয়াবি মানুষের প্রশংসা পাওয়া জন্য আমল করছে। তাই রমজান মাস আসলেই যাকাত নিয়ে ঈমাম সাহেব এখন কোরআন আর হাদিস বরাত দিয়ে যাকাতের গুরুত্ব বলে যান। অথচ উনার অনেক কলিগ চাকরি হারানোর ভয়ে যাকাত বিষয়ে এড়িয়ে  যান। সুরা বাকারার ২৬৪ নং আয়াতে বলা হয়েছে, ‘হে ঈমানদারগণ তোমরা অনুগ্রহ ফলিয়ে ও কষ্ট দিয়ে তোমাদের দান সদকাকে বিনষ্ট করো না।’ আমাদের দেশে লোক দেখানোর জন্য সম্পদ ব্যয় করে আর ঈমান রাখে না আল্লাহ ও আখিরাতের উপর, এমন লোকের অভাব নেই। যার কারণে এই মুসলিম প্রধান দেশে ২০.৫% মানুষ দরিদ্র সীমার নিচে বাস করে। হত দরিদ্রের  হার ১০.৫ %। সবাই যদি শরীয়ত মোতাবেক যাকাত দিত মুসলিম প্রধান বাংলাদেশে গরিব, দুঃখী, অসহায় মানুষ খুঁজে পেতে দূরবীন লাগত। সারা পৃথিবী আজ করোনার কারণে মহাদুর্যোগে আছে। বিশ্ব খাদ্য সংস্থার তথ্য মতে, বিশ্বে করোনার কারণে ১৩ কোটি  মানুষ খাবারের অভাবে মারা যাবে। অথচ এই বিশ্বের সকল সম্পদের ৫০%  মাত্র ১% ব্যক্তির অধীনে আছে। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়েলথ এক্সের গবেষণায় দেখা যায়, ধনীর বৃদ্ধির হারের দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বে তৃতীয়। (প্রথম আলো,১৯/০১/১৯)। করোনার কারণে সৃষ্ট মহাদুর্যোগ মুহূর্তে যাকাত নিঃসন্দেহে বাংলাদেশ সহ সারা মানবজাতির জন্য কল্যাণ  বয়ে আনবে।

যেমন : ১. প্রতিটি মানুষ যদি তার যাকাতের টাকা তার আশপাশ গরিব মানুষকে দান করেন অথবা স্বাবলম্বী করার জন্য যাকাতের টাকা দিয়ে ব্যবসা, খামারসহ অন্যান্য ব্যবস্থা করে দেন তাহলে রাষ্ট্রের উপর অতিরিক্ত চাপ কমে  যাবে আর অতিরিক্ত ট্যাক্স আরোপ করার প্রয়োজন হবে না। তাতে আমি, আপনি আপামর সবাই লাভবান হব।

২. সমাজে ধনী ও গরিবের মধ্যে বৈষম্য কমে আসবে। সামাজিক অস্থিরতা বিরাজ করবে না। আর্থসামাজিক উন্নয়নে রাষ্ট্রকে ভর্তুকি আর অতিরিক্ত অর্থ খরচ করতে হবে না। রাষ্ট্র   অবকাঠামোর  উন্নয়নসহ অন্যান্য কাজে সেই অর্থ ব্যয় করতে পারবে।

৩. করোনা আসার পর এই পৃথিবীর ধনীদের ভোগবিলাস করার জন্য ফাইভস্টার হোটেল, বার, নাইটক্লাব, নামি-দামি শপিং মল, সিনেমা হল, পর্যটন স্পট, নামীদামী ব্রান্ডের গাড়ি, আকাশদাপানো উড়োজাহাজ তথা খরচ করার সব পথ বন্ধ হয়ে গেছে। করোনার কারণে ধনী গরিব সবাই আজ ঘরে লকডাউন হয়ে আছে। পৃথিবীর মানুষ আজ উপলব্ধি করতে পারছে, বেঁচে থাকার জন্য মানুষে মানুষে সহযোগিতা খুব প্রয়োজন। কোন ধনী ব্যক্তি যদি আজ করোনা আক্রান্ত হয় তাহলে তার নিকট আত্মীয় স্বজনরাও দূরে পালিয়ে যাবে। আগে টাকার লোভে অথবা সুবিধা নেওয়া  লোভে মন্ত্রী বা এমপি বা বিত্তশালী ব্যক্তিদের পিছনে পিছনে যারা এতদিন  ঘুরত আর তেল দিত তারাও নিজেদের জীবনের মায়ায় দূরে চলে গেছে। অর্থাৎ টাকার মূল্য নেই। একটি অনলাইন পত্রিকায় দেখলাম, একজন অতিরিক্ত সচিব চিকিৎসার জন্য বিভিন্ন হাসপাতালের দুয়ারে দুয়ারে গিয়েছিলেন কিন্তু করোনা সন্দেহে কেউ জায়গা দেয়নি। পরে জানা যায় উনি হার্ট অ্যাটাক করে মারা যান। করোনা ভাইরাসের কারণে শিক্ষা, অর্থ, প্রাচুর্য, ক্ষমতা কোন কিছুই আজ কাজে আসছে না। হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে ব্যাংকে জমা থাকলেও আজ ঘুরেফিরে মানুষের সহযোগিতা প্রয়োজন। আমাদের সমাজে এমন মনমানসিকতা তৈরি হয়েছিল যে, ধনী না হতে পারলে জীবনটাই ষোল আনা বৃথা, ধনী হবার স্বপ্ন করতে গিয়ে কখন যে মনুষ্যত্ব আর বিবেক বির্সজন দিয়েছি আমরা চিন্তাই করতে পারিনি। একবারও  মানুষ মনে করে না যে, ‘একদিন মাটির ভিতর হবে ঘর, রে মন আমার, কেনো বান্ধ দালান ঘর।’

যে মুঘলরা সারা ভারতবর্ষে প্রায় ৪০০ বছর শাসন করেছে, সেই মুঘল সা¤্রাজ্যের  বংশধরেরা আজ দিল্লির একটি বস্তিতে বসবাস করছে। পৃথিবীতে দাপটের সঙ্গে যেসব শাসক শাসন করেছে তাদের  রাজপ্রাসাদ হয়ত আজ আছে কিন্তু মানুষ, পাইক-পেয়াদা, অর্থ, ক্ষমতা, জৌলুস কিছুই নেই বরং ঝোপঝাড় আর জঙ্গলের কারণে ওই সব রাজপ্রাসাদে দিনদুপুরে যেতে ভয় লাগে। ২০০ বা ৩০০ বছর আগে যা ছিল উন্নত নগরী আজ তা ধ্বংস বা নিদর্শন নগরী হিসাবে সবার কাছে পরিচিত। তাই যে নিচু জাতকে গালি দিয়ে নিজের ক্ষমতা প্রকাশ করতাম আজ সেই নিচু  লোকের অভাবে নিজের চুল, দাড়ি নিজেই বাড়িতে কাটি। রিকশা বা বাসের অভাবে ঘন্টা পর ঘন্টা হাঁটি। ঘরের থালাবাসন, ঘর পরিষ্কার নিজেই করি। আজ হাড়ে-মজ্জায় উপলব্ধি করতে পারছি মানুষ মানুষের জন্য কত প্রয়োজন।

আজ রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে ধনী গরিব বৈষম্য দিন দিন বেড়েই চলেছে। গরিব মানুষের  ছেলেমেয়েরা খাদ্য, পুষ্টি, শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়ে বড় হচ্ছে। যাকাতের অর্থ দিয়ে যদি প্রত্যেক যাকাত প্রদানকারী ব্যক্তি একটি শিশুর পড়াশোনা দায়িত্ব নেয় তাহলে এই দেশে একটি শিশুও অনাহারে, অশিক্ষায় বড় হবে না বরং দেশের বা সমাজের সম্পদ হবে এক একটি শিশু।

এতে একদিকে যাকাতও দেওয়া হলো, অন্যদিকে দেশে ও সমাজের দায়িত্ব পালন করা হল। ধর্ষণ, খুন, রাহাজানি, মারামারি, মামলা মোকদ্দমা আজ সমাজে দিন দিন বাড়ছে কেন? শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপর দোষ চাপিয়ে  রাষ্ট্রের বা সমাজের প্রতি নিজের দায়িত্ব ও কর্তব্য অবহেলা বা এড়িয়ে গেলে চলবে না। কারণ মনে রাখতে হবে, সমাজের ক্ষয় বা পঁচা শুরু হলে আমাকে বা আপনাকে  দুর্গন্ধ সহ্য করতে হবে। ক্ষয়ক্ষতি আমার আগে হলে আপনার হয়তো পরে হবে কিন্তু ক্ষতি সবারই হবে।

আসুন, আপনার আমার সম্পদের উপর গরিবের যে হক রয়েছে তা তাদের দিয়ে দেই। তা না হলে শত শত করোনা মত ভাইরাস এসে আপনার বা আমার জীবন ধ্বংস করে দিতেও পারে। আমরা অনেকে হয়তো জানি, আলেকজান্ডার দি গ্রেট  মৃত্যুর আগ-মুহুর্তে বলেছিলেন যে, আমি আমার জীবনের বিনিময়ে তিনটি বিষয় শিখেছি। এই তিনটি বিষয় মানবজাতিকে জানানোর জন্য তার সেনাপতিদেরকে তাঁর মৃত্যুর পর তিনটি ইচ্ছে পালন করার জন্য অনুরোধ করেন। এর মধ্যে একটি ইচ্ছে হলো, আমার শবদেহ বয়ে নিয়ে যাবে যে পথে সেই পথে আমার অর্জিত সব সোনা, রুপা, মণিমুক্তা, ধনরতœ ছড়িয়ে দিবে। সবাই যখন উনার এই ইচ্ছার ব্যাখ্যা জানতে চাইল তখন  তিনি বলেন, আমি সারাটিজীবন ব্যয় করেছি সম্পদ অর্জনের পেছনে কিন্তু তার কিছুই সঙ্গে করে নিতে পারছি না। উনার তৃতীয় এবং শেষ ইচ্ছা ছিল, শবদেহ বহনের সময় আমার হাত দুটো কফিনের ভিতরে থেকে বাহিরে বের করে রাখবে। কারণ আমি বিশ্বকে জানাতে চাই ,আমি শূন্য  হাতে পৃথিবীতে এসেছিলাম আবার যাবার সময় শূন্য হাতে ফিরে যাচ্ছি।

নিশ্চয়ই আল্লাহ মশা বা তার চাইতেও তুচ্ছ বিষয় (ভাইরাস বা জীবাণু) দিয়ে উদাহরণ বা তাঁর নিদর্শন প্রকাশ করেন। আসুন, নিজে বাঁচি, নিজের সন্তানকে সুন্দর একটি পৃথিবী উপহার দিই। তা না হলে সন্তানের লাশ কাঁধে নিয়ে কবরে যেতে হতে পারে। কারণ উন্নত প্রযুক্তি, শক্তিশালী অর্থনীতি ও আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি থাকার পরও মৃত্যুর মিছিল দেখে উন্নত রাষ্ট্রগুলো  অসহায় দৃষ্টিতে আকাশের কাছে সাহায্যের জন্য তাকিয়ে আছে। এরপর কোভিড-১৯ এর চেয়ে ভয়াবহ ও শক্তিশালী জীবাণু মানবজাতির ধ্বংসের জন্য আসতেও পারে।

তাই, নিজের ও নিজের পরিবারের কল্যাণে যাকাতদিই, অন্যদেরকে দিতে অনুপ্রাণিত করি। যাকাত দয়া নয় বরং আমার বা আপনার সম্পত্তির ওপর গরিবের হক।