Cinque Terre

সুমনকুমার দাশ

২০ জুন , ২০২০


লোকসংস্কৃতি গবেষক


ব্যক্তিগত স্মৃতিতে কামাল লোহানী

কামাল লোহানী ভাইয়ের সঙ্গে স্মৃতির তো আর শেষ নেই! তিনি যখন শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক, তখন বাংলাদেশের সপ্ত লোকসাধক স্মরণে সাত দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করেছিলেন। সে অনুষ্ঠানের উদ্বোধনী পর্বে আমাকে রেখেছিলেন মূল প্রবন্ধকার হিসেবে। উদ্বোধনী পর্ব শেষে সংস্কৃতিমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদের উপস্থিতিতে লোহানী ভাইয়ের কক্ষে পরিকল্পনা হয়েছিল, শিল্পকলা একাডেমির প্রকাশনা বিভাগের জন্য সিলেটের লোকসাধকদের নিয়ে একটি পাণ্ডুলিপি জমা দেব। সেটা আর দেওয়া হয়নি। এরপর যখনই তাঁর সঙ্গে দেখা হতো, তিনি ওই পাণ্ডুলিপি না-দেওয়ার বিষয়ে আক্ষেপ করতেন। আমারই শ্রদ্ধাভাজন ঘনিষ্ঠজন হান্নান ভাইয়ের (কবি ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব শুভেন্দু ইমাম) কাছে আমার পাণ্ডুলিপি জমা না-দেওয়ার বিষয়ে অনুযোগ করতেন! এ-রকম কত স্মৃতি আর কত আক্ষেপ আমার কাছে জমা রেখে তিনি না-ফেরার দেশে চলে গেলেন।

সিলেটে কামাল লোহানীর সঙ্গে লেখক।

 

লোহানী ভাই ২০১৮ সালে সিলেটে এসেছিলেন ‘ইনোভেটর’ আয়োজিত মুক্তিযুদ্ধের বইপড়া উৎসবে। বিমানবন্দরে নেমেই আয়োজকদের একজন প্রণবদার (কবি ও শিক্ষক প্রণবকান্তি দেব) কাছে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আমার সুমন আসবে তো অনুষ্ঠানে?’ প্রণবদা লোহানী ভাইকে গাড়িতে তোলে মুঠোফোনে আমাকে ধরিয়ে দেন। আমি তাঁকে জানাই, আমি অনুষ্ঠানস্থলেই আছি। যখন অনুষ্ঠানস্থলে তিনি পৌঁছলেন, তখন আমাকে দেখে অপার স্নেহে বুকে আগলে নেন। আমার স্নেহভাজন আলোকচিত্রী আনিস মাহমুদ পাশেই ছিল, একের পর এক ক্লিকে সেগুলো মুহুর্তেই সে স্মৃতিবন্দী করে ফেলে। এত ভালোবাসা আর স্নেহ পেয়েছি লোহানী ভাইয়ের কাছ থেকে, ঋণ শোধ করার মতো নয়! 

আমার একটি বই নিয়ে উচ্ছ্বসিত রিভুয়্যু লিখেছিলেন লোহানী ভাই, সেটা অসংখ্য সুখস্মৃতির একটি হয়ে থাকবে আমৃত্যু। এর বাইরেও কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে তাঁকে ঘিরে। যখন তিনি উদীচী কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি হলেন, তখন সারা দেশের উদীচীর সংগঠক-সদস্যদের নিয়ে ঢাকায় সম্ভবত কর্মশালা-জাতীয় কোনো অনুষ্ঠান আয়োজন করেছিলেন। আমাকে ফোন করে বললেন, ‘সুমন, তরুণ সংস্কৃতিকর্মীরা কীভাবে লোকায়ত সংস্কৃতিকে আত্মস্থ করে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গঠনে কাজ করতে পারবে, এ নিয়ে তোমাকে ঘণ্টা দেড়েকের একটা বক্তৃতা দিতে হবে।’ বক্তৃতার কথা শোনেই আমার পা থরথর। বরাবরের ঘরকুণো আমি লোহানী ভাইকে বলি, ‘আমাকে মাফ করে দেন। বক্তৃতা দিতে গেলেই আমি সবকিছু গুলিয়ে ফেলি। যেটা বলতে চাই, সেটা আর বলতে পারি না।’ সেই প্রথম ‘না-সূচক’ উত্তর দিতে গিয়ে আমার বড্ড কষ্ট লেগেছিল বুকে! লোহানী ভাই সেটা শেয়ার করেছিলেন উদীচী কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সহসভাপতি মো. আরশ আলী মামা ও উদীচী সিলেটের সাবেক সাধারণ সম্পাদক রতন দেবদার কাছে।

ঢাকায় মাঝেমধ্যে গেলে লোহানী ভাইয়ের বাসায় যাওয়া হতো। সর্বশেষ যখন তাঁর বাসায় যাই, তাও প্রায় দুই বছর আগে। সঙ্গী ছিলেন সেলিম ভাই (নাগরীলিপি গবেষক ও প্রকাশক মোস্তফা সেলিম)। খানিকটা অসুস্থ ছিলেন, এরপরও বসে ঘণ্টা দেড়েক আমাদের সঙ্গে আড্ডা দিলেন। কত কথা হলো তাঁর সঙ্গে। এর বাইরে অনেক স্মৃতির ভিড়ে লোহানী ভাইয়ের একটি স্মৃতি আমৃত্যু বহে বেড়াতে হবে আমাকে। এখন প্রাসঙ্গিক নয়, হয়তো অন্য এক পরিসরে বলা হবে কোনোদিন। লোহানী ভাই, আপনি শারীরিকভাবে না-থাকলেও আপনার স্মৃতি ও আদর্শ সতত বহন করব আমরা নিশ্চয়ই।