Cinque Terre

কান্তা জামান

২১ জুন , ২০২০


কবি ও অভিনয় শিল্পী


বাবা তোমার কষ্ট হয়?

বাবা পেশায় আলোকচিত্রী ছিলেন। ‘সিলেট ফটোগ্রাফার্স’ নামে তাঁর সিলেটের স্টুডিওটি আজও অনেকের মনের কোণে বেঁচে আছে। বাবার সবচেয়ে বড় ‘দোষের’ দিক ছিল তাঁর নীতিবোধ। কেমন সেটা? বাবা দিবসে সেই বর্ণনা দিয়েই লেখাটা শুরু করা যাক।

প্রাথমিকের পাঠ চুকে যাওযার পর মাধ্যমিকে ভর্তি হব বলে ভর্তি পরীক্ষা দিতে গেলাম সিলেটের ঐতিহ্যবাহী একটি বিদ্যালয়ে। পরীক্ষা শেষে আমি অবাক বিস্ময় নিয়ে বিশাল স্কুলটি (আমার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তুলনায়) ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম। হ্যান্ডবল কোর্টে এসে নিজেকে হ্যান্ডবল খেলোয়াড় হিসেবে ভেবে নিলাম কিছুক্ষণ। কয়েকটা শ্রেণি কক্ষও উঁকি দিয়ে দেখে নিলাম। কোনটা আমার সেকশন হতে পারে সে বিষয়ে এত ভাবনায় গেলাম না কারণ কোনো একটা তো হবেই। ঘুরতে ঘুরতে একসময় মূল ফটকে চলে এলাম। দেখি, অভিভাবকদের প্রচ- ভিড়। তাদের মাঝে বাবাও দাঁড়িয়ে চিন্তিত মুখে।

আমি এক পলকে বিষয়টাকে মনের ফ্রেমে গেঁথে নিলাম। কারণ কিছুদিনের মধ্যে এটাই হবে প্রতিদিনের দৃশ্য। বাবা আমাকে নিতে স্কুলের ফটকে দাঁড়িয়ে থাকবে। 

আমার হাতে ছোট্ট কিছু একটা টিফিন ধরিয়ে দিয়েছিল বাবা, এখন আর মনে নেই। হাতে নিয়ে খেতে খেতে আমি তখনও মনে মনে ওই স্কুলের প্রতিটি কোণ হেঁটে বেড়াচ্ছি।  

তোর পরীক্ষা কেমন হলো? বাবা কণ্ঠে খানিকটা উৎকণ্ঠা।

বাবার প্রশ্ন আর রিকশার ঝাঁকুনি মনে হয় একসঙ্গেই এলো, খাবার গিলতে বিষম খেলাম। সামলে নিয়ে বললাম, ‘ভালো হয়েছে বাবা। বৃত্তি পরীক্ষার মত কিছু প্রশ্ন এসেছিল। আমি পেরেছি।’ এরপর পাল্টা জানতে চাইলাম, ‘কিন্তু বাবা, আমি কোন শিফটে ভর্তি হবো? আমাদের বাসা (আমরা তখন লিচুবাগান থাকতাম) তো অনেকদূর?

বাবা নির্লিপ্ত কণ্ঠে বললেন, ‘দেখা যাক, আমরা হয়তো বাসা বদল করব।’

আমার জন্মদিন ১৩ই জানুয়ারি, পরীক্ষার রেজাল্টও হবে এদিন। খুব সকাল সকাল বাবা স্টুডিওতে চলে গেল। এক সঙ্গে দুটো উপলক্ষ উদযাপন করব এমন প্রস্তুতি নিচ্ছি মনে মনে। কিন্তু বিকেল চলে যাচ্ছে বাবা আসার খবর নেই। কেন জানি আমিও অন্য কিছুতে মন বসাতে পারছিলাম না। বাবার অপেক্ষায় অপেক্ষায় আমি জেগে থাকলাম। বাবা বাসায় ফিরলেন মধ্যরাতে। কিন্তু আমি কেন জানি বাবার সামনে যেতে দ্বিধাবোধ করছিলাম। কারণ ততক্ষণে বুঝে গেছি, বাবা কোনো কারণে মনে খুব কষ্ট পেয়েছেন। নিজে থেকেই বাবা এক সময় জানালেন, ‘কান্তা ভর্তি পরীক্ষায় পাশ করেছে।’

কিন্তু তাতে আমরা কেউ খুশিতে হেসে উঠতে পারলাম না। কারণ বাবার মুখটা তখনও গম্ভীর। নিশ্চয়ই সাংঘাতিক কিছু একটা ঘটেছে। সেই ঘটনা শোনার অপেক্ষায় মা, আমি, সবাই।

গম্ভীর মুখে বাবা জানালেন, প্রিন্সিপাল ম্যাডাম তিনটা সিলিং ফ্যান আর কিছু চেয়ার টেবিল স্কুলের ভর্তি ফি’র সঙ্গে দিতে বলেছেন বাবাকে। এমন কথা শুনে বাবা প্রিন্সিপাল ম্যাডামের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, ‘আমার মেয়ে পাশ করেছে?’ 

ম্যাডাম বললেন, ‘হ্যাঁ’।

বাবা ম্যাডামকে মুখের উপর বলে দিলেন, ‘কিন্তু আমি আমার মেয়েকে আপনার স্কুলে ভর্তি করাব না। ওকে অন্য কোনো একটা স্কুলে ভর্তি করাবো।’

চান্স পাওয়া সত্ত্বেও বাবা আমাকে অভিভাবকদের জন্য বহু প্রত্যাশিত ওই বিদ্যালয়ে ভর্তি করালেন না। অথচ আমি এই একটা স্কুলেই ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছিলাম। আর কোথাও দেইনি। 

এরপর কয়েকটা দিন বাবার চিন্তিত মুখটা দেখে দেখে আমি মনে মনে ঠিক করে ফেলেছিলাম এ বছর আমার তাহলে ড্রপ যাচ্ছে। যাক আমি আগামী বছর অন্য একটা স্কুলে ভর্তি পরীক্ষা দিব।

একদিন দুপুরে বাবা বাসায় ফিরে ঘর মাথায় তুলে জোরে জোরে ডাকতে লাগল, ‘কৈতরি, কৈতরি (বাবা-মা আমাকে আদর করে এ নামে  ডাকতেন) এক্ষুণি পড়তে বস, কালকে তোর ভর্তি পরীক্ষা। একটা স্কুল আছে, ওদের পরীক্ষা কালকে আর এটাই এ বছরের শেষ পরীক্ষা।’ তারপর শান্তনা দেওয়ার মতো করে বললেন, ‘তবে মন খারাপ করিস না স্কুলটা এতো নামকরা নয়। কিন্তু তোর পড়াশোনা খুব ভালো হবে।’

আম্বরখানা বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজ। আমি খুব বেশি ঘুরে দেখার মত কিছু পেলাম না। পরীক্ষা দিলাম। উৎরেও গেলাম। ভর্তি হলাম। প্রথমদিন ক্লাসে ঢুকে মন খারাপ হয় গিয়েছিল, কেঁদেছিলাম। সেখানেই আমার মাধ্যমিকের পড়াশোনা। প্রতি বছরই বার্ষিক পরীক্ষায় মেধা তালিকায় থাকতাম। প্রাথমিক পড়েছিলাম দুটি স্কুলে প্রথমে দ্বীপশিখা প্রি ক্যাডেট স্কুলে, এরপর সরকারি বৃত্তি পরীক্ষা দেবো বলে খাসদবীর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হই গিয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে। দুটি স্কুলেই আমি পি টি করাতাম। এখানেও ভর্তি হয়ে তাই করিয়েছি। ক্লাস ক্যাপ্টেন হিসেবেও জনপ্রিয় ছিলাম। শেষ পর্যন্ত এ স্কুলটি আমাকে ভীষণ আত্মবিশ্বাসী শিক্ষার্থী হিসেবে গড়ে তুলেছিল। 

দিনটির কথা এখনও ভুলতে পারিনা মুহূর্তের জন্য। ১৯৯৬ সালের ৩১ অক্টোবর। আমি তখন নবম শ্রেণিতে। প্রচ- বর্ষণের জলে সিলেট টইটম্বুর। বাবা বেশ কিছুদিন ধরে খুব অসুস্থ। লিভার সিরোসিস ধরা পড়েছে। লাস্ট স্টেজ। প্রতিদিন স্কুলে যাবার সময় বাবা আমার কপালে চুমু এঁকে দেবেন এটা মোটামুটি নিয়মে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। স্কুলের দেরি হয়ে যাচ্ছে ওদিকে বাবা বার বার বিছানা থেকে নামা-উঠা করতে চাচ্ছে। আমার আর সেদিন বাবার চুমু নিয়ে বের হওয়া হলো না।

অবশেষে জীবনের কঠিনতম সময়ের মুখোমুখি হলাম সেদিন। রাত আটটার দিকে বাবা আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। ক্লাস নাইনে থাকতেই মোটা একটি টেস্ট পেপার ছিল বাবার কিনে দেওয়া শেষ বই।

বাবা আমাকে সবসময় জীবনে ভালো মানুষ হওয়ার শিক্ষা দিতে চেয়েছেন, দিয়ে গেছেন। জীবনে বড় কিছু হই সে প্রার্থনা করতেন। বাবা-ওপারে তোমার নিশ্চয়ই কষ্ট হয় আমার ব্যর্থতা দেখে...।