Cinque Terre

আফসার আজিজ

২১ জুন , ২০২০


সভাপতি

আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবকলীগ

সিলেট জেলা


হারিয়ে গেল সেই হাসিমুখ

যাদের দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে আমার রাজনীতিতে আসা তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেনÑবদরউদ্দিন আহমদ কামরান। স্বভাবতই তাঁর মৃত্যুতে আমি গভীর বেদনাহত। কত স্মৃতি আজ মনে পড়ছে, তা ভাষায় রূপ দেওয়া কঠিন। গত সোমবার থেকে আজ পর্যন্ত শোক যেন কাটিয়ে উঠতে পারছি না।

লেখার চেষ্টা করেও বারবার বিফল হচ্ছি। কারণ যখনই ভাবি কোনো বিপদে কিংবা প্রয়োজনে পরামর্শের জন্য এই মহীরুহের কাছে আর যাওয়া যাবে না, তখনই মনটা বিষাদে ছেয়ে যায়। তাঁর কাছে আমি ও আমাদের ঋণের শেষ নেই। তাঁর ¯েœহের প্রতিদান কোনোদিন দিতে পারিনি। এখন তাঁর নীতি আর আদর্শই আমাদের পাথেয়।

রাজনীতির মাঠ অনেক কঠিন। আমরা প্রতিদিন নানা সঙ্কটে পড়ি। একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে যখন নিজের মূল্যায়ন করি, তখন কামরান ভাইয়ের হাসি মুখটি ভেসে ওঠে। আজ হারিয়ে গেল, সেই হাসি মুখ। তাঁর মতন এমন দিলখোলা হাসি আর ভালোবাসা আমরা সহকর্মী কিংবা মানুষের জন্য কতটুকু বিলাতে পারি! তাঁর ধৈর্য্য আর দূরদর্শিতা ছিল বড় সম্পদ। আমরা সবাই মনে করতাম আমাকেই বুঝি বেশি ভালোবাসেন। কিন্তু মূলত তাঁর মূল্যায়ন ছিল সর্বদা যথাযথ।

আমার রাজনীতির চলার পথ কখনই মসৃন ছিল না। তিনি একান্তে অনেকদিন আমাকে ধৈর্যশীল হওয়ার উপদেশ দিয়েছেন। যখনই কোনো সমস্যায় পড়েছি সোজা তাঁর কাছে চলে গিয়েছি। কখনো বিরক্ত হননি। হাসিমুখে বলেছেন, ‘তুমি আমার মায়ার ভাই, কও কিতা করতাম।’

বদরউদ্দিন কামরান ছিলেন রাজনীতির চলমান এক প্রতিষ্ঠান। তাঁর শিক্ষা ছিল চলনে, বলনে। তিনি যা বলতেন অন্তর থেকেই বলতেন। তাই তাঁর প্রতি আজ যে শ্রদ্ধা, তা অকৃত্রিম। তিনি চাইতেন কর্মীদের মধ্য থেকে নেতা উঠে আসুক। এমন প্রমাণ আমি বহুবার পেয়েছি। মেয়র থাকাকালিন বা মেয়র না থাকা অবস্থায় তাঁর অবস্থানের পরিবর্তন হয়নি। এমন অনেক বড় মাপের মানুষের সামনে তিনি বহুবার বলেছেন, আফসরকে আমি পছন্দ করি। তাঁর এই কথার অনেক নজির তিনি রেখেছেন। আজ একান্ত ব্যক্তিগত দুটি ঘটনার বর্ণনা দিয়ে লেখা শেষ করব।

 

২০০৬ সাল। আমার বিয়ের কার্ড নিয়ে তাঁর বাসায় গিয়েছি। দেখা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একজন কর্মচারীকে বললেন, যাও মিষ্টি নিয়ে এসো। আমার ভাইকে মিষ্টি মুখ করাবো। জীবনের নতুন এক অধ্যায় সে শুরু করতে যাচ্ছে। আমি তো অবাক। চিঠি দেওয়ার আগেই তিনি বিয়ের খবর জানলেন কীভাবে? আসলে তিনি আমাদের খোঁজ-খবর রাখতেন সর্বদা। পরে বললেন, তোমার ভাবি কাল রাতেই বলেছেন আমাকে। কারণ তোমার শ্বশুর লায়ন্স ক্লাব করেন, এই সূত্রে তাঁদের সঙ্গে ঘনিষ্ট। তোমার বিয়ের দিন আমার ডায়েরিতে উঠে গেছে।

২০১৭ সালের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা আছে। বিষয়টি প্রকাশ করা কতটুকু যুক্তিযুক্ত জানি না, তবু আমাদের জীবনে একজন কামরান ভাই কী ছিলেন, তা জানাতে বলা বাঞ্ছনীয় বলে মনে করি।

আমি তখন সবে স্বেচ্ছাসেবক লীগের সিলেট জেলার সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছি। কাজের পরিধি বিস্তৃত।  কেন্দ্রসহ জেলার নানা কাজে ব্যস্ততা চলছে। এমনি সময় রসময় মেমোরিয়াল উচ্চ বিদ্যালয়ের পরিচালনা কমিটি নিয়ে একটি কঠিন পরিস্থিতি চলছে। আমি ওই বিদ্যালয়ের ছাত্র। আমার পরিবারের প্রায় সকল সদস্য ওই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিল। তখনকার প্রধান শিক্ষক সেলিম উদ্দিনও ছিলেন আমার সরাসরি শিক্ষক। সাবেক শিক্ষার্থী, এলাকার বিদ্যালয়অনুরাগীসহ অনেকেই পরিচালনা কমিটিতে আমাকে রাখার জন্য নানাভাবে বলছিলেন। আমি কাজের চাপে প্রথমে এই গুরু দায়িত্ব নিতে না চাইলেও শিক্ষক ও অভিভাবকদের অনুরোধে পরে একসময় না করতে পারিনি। বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি গঠন হলে আমাকে শিক্ষানুরাগী সদস্য পদে রাখা হয়। আমিও বিদ্যালয়ের উন্নয়নের স্বপ্ন দেখতে শুরু করি। নিজের ছেলেবেলার স্কুলের প্রতি ছিল অদম্য এক টান। কিন্তু শিক্ষাবোর্ড কোনো কারণে এই কমিটির অনুমোদনের ব্যাপারে বিলম্ব করছিল। ভেতরের বিষয়টি অনুল্লেখই থাকুক। 

একদিন স্বেচ্ছাসেবক লীগের তৎকালীন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এমদাদ রহমান ও আমি কামরান ভাইর বাসায় অবস্থান করছিলাম। কাজের কথা শেষ হলে আমরা আমাদের ব্যক্তিগত বিষয়ে কথা বলছিলাম। এক পর্যায়ে রসময় স্কুলের পরিচালনা কমিটির বিষয়ে কথা ওঠে। আমি তাঁকে বললাম, শিক্ষাবোর্ডে তা আটকে আছে। তিনি বললেন, ফোন লাগাও। আমি বলি, না। আমার ফোন থেকে আপনি কথা বললে উনারা ভাববেন, আপনাকে দিয়ে তদবির করাচ্ছি। তিনি তখন বললেন, কার সঙ্গে কথা বলতে হবে মোবাইল নম্বর দাও।’ আমি দিলাম। তিনি সরাসরি ফোন করে, কমিটির বিষয়ে জানতে চাইলেন। বেশি কিছু বললেন না। তাঁর পরিচয় দিয়ে কেবল বললেন, ‘আমার বিশ্বাস এই কমিটি স্কুলের জন্য ভালো কাজ করবে।’ পরে কমিটি অনুমোদন হয়ে আসে।

তাঁকে কখনও ‘অন্যায় অনুরোধ’ করতে দেখিনি। যেখানে যা বলা দরকার শুধু তা বলতেন। যা করলে মানুষের মঙ্গল হয় তা-ই করতেন। সেদিন কামরান ভাই বলেছিলেন, এমন কাজ করো যেন আমরা তোমাকে একদিন ওই বিদ্যালয়ের সভাপতি করতে পারি। পরে বিদ্যালয়ের সভাপতি পদেও মনোনীত হই। তিনি দেখা হলে বলেছিলেন, ‘কাজ করলে ফল মিলে।’ 

আজ ভাবি, আমরা কি তাঁর মতো উদার আর সম্প্রীতির রাজনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারব? সত্যি সিলেটবাসীর অনেকের মতো এই প্রশ্ন ও আকাক্সক্ষা আমারও। কামরান ভাই পরপারে ভালো থাকুন, মহান আল্লাহর কাছে এই প্রার্থনা করি।