Cinque Terre

ফয়সল আহমদ চৌধুরী

০৭ এপ্রিল , ২০২০


চেয়ারম্যান

বারাকা ফ্যাশন লিমিটেড


‘মেইড ইন বাংলাদেশ’কে বাঁচিয়ে রাখুন

পৃথিবীর মানুষ এক কঠিন সময় অতিক্রম করছে, আর আমরা জীবনের কঠিন সময় প্রত্যক্ষ করছি। আমাদের প্রজন্ম কেন, দূর অতীতের কেউ এটা প্রত্যক্ষ করেনি। অদৃশ্য এক শক্তির আক্রমনে শুধু আমরা কেন, বিশ্বে যারা পরাক্রমশালী তারাও আজ কুপোকাত। আত্মসমর্পণ করে বসে আছে, আর উপায় খুঁজছে বাঁচার।

বিশ্বব্যাপি করোনা ভাইরাস যে তাণ্ডব শুরু করেছে তাতে সবাই শঙ্কিত এবং একই সঙ্গে দিশেহারা। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা এখন যেখানে সবচেয়ে জরুরি সেখানে পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশ হচ্ছে বাংলাদেশ। যেখানে বেশির ভাগ দারিদ্র পীড়িত খেটে খাওয়া মানুষ, দিনমজুর, রিকশা বা অটোরিকশা চালক। এরমধ্যে ৪০ লাখেরও ওপর রয়েছে গার্মেন্টস শ্রমিক। দেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি খাত এই গার্মেন্টস শিল্প আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। এই গার্মেন্টস খাতই তাদের তৈরি পোষাক বিদেশে রপ্তানি করে দেশের অর্থনীতির চাকাকে রেখেছিল সচল। বর্তমান পরিস্থিতির উন্নয়ন না হলে বন্ধ হয়ে যেতে পারে বেশিরভাগ কারখানা। শ্রমিক ছাড়াও এর সঙ্গে জড়িত প্রায় কোটি মানুষ বেকার হয়ে যেতে পারে। বিশ্ব মন্দার কারণে এমনিতেই গত ছয় মাসে পাঁচশ এর ওপর গার্মেন্টস বন্ধ হয়েছে। বিশ্ব বেনিয়ারা Compliance এর নামে নানা শর্ত জুড়ে দিয়ে মালিকদের কোটি কোটি টাকা খরচ করিয়েছে কিন্তু তৈরি পোষাক এর মূল্য বাড়ায়নি। আমাদের দেশে কৃষক যেভাবে ধানের মূল্য পায় না তেমনি তৈরি পোষাক শিল্প পায় না সঠিক মূল্য। যে কারণে ভিয়েতনাম আমাদের দ্বিতীয় স্থানটি আজ কেড়ে নিয়েছে। এরপরও মালিকেরা প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন পোষাক শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে। কিন্তু করোনা ভাইরাস যেন যমদূত হিসেবে আবির্ভুত হয়েছে। সিদ্ধান্তহীনতা নতুন নতুন সংকট সৃষ্টি করছে।

গার্মেন্টস শ্রমিকের পেটে ভাত নেই। কাজ হারানোর ঝুঁকি সে নিতে পারে না। তাই ফ্যাক্টরি খোলার সংবাদ পেয়ে পায়ে হেঁটে হলেও তারা কর্মস্থলে যোগ দিতে চলে এসেছে ঢাকা, নারায়নগঞ্জ, টাঙ্গাইল, চট্টগ্রাম বা অন্য কোথাও। ক্ষুধার রাজ্যে তাঁদের কাছে পৃথিবী গদ্যময়, পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি। সামনে রোজা, ঈদ। বেতন বোনাস সবকিছু আটকে আছে। তাই তাদের কাছে ভাইরাস-টাইরাস কিছু না। 

অন্যদিকে গার্মেন্টস মালিকদের মাথায় হাত। বাড়ি, গাড়ি, সম্পত্তি সব হারাতে বসেছেন। সরকার প্রধানের পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনার ঘোষণা তাদের মধ্যে যেমন আশার সঞ্চার করেছে তেমনি তা সুদসহ ঋণে পরিবর্তন হলে বিনামেঘে বজ্রপাত ঘটানোর সামিল হবে বলে চিন্তিত। কারণ ইতিমধ্যে সমস্ত অর্ডারগুলো ক্যানসেল হয়েছে। গত মাসের তৈরি বেশিরভাগ পোশাক শিপমেন্ট হয়নি যে কারণে বায়ার কোনো টাকা দিবে না, এ অবস্থায় শ্রমিকের বেতন-ভাতা, বোনাস কীভাবে দেওয়া হবে তার চিন্তা করে মালিকের নাভিশ্বাস উঠছে। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যে শ্রমিকরা দেশের অর্থনীতির চাকাকে সচল রেখেছিল তাদের বেতন ভাতা দেওয়াই এখন বড় চ্যালেঞ্জ। 

আজ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আর পত্রিকায় নানা জন গার্মেন্টস ব্যবসায়ীদের নিয়ে বিষোদগার করে লিখে চলেছেন। লিখুন তারা, এতে তো আর ট্যাক্স লাগে না। বায়াররা বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের অর্ডার ক্যানসেল করছে তাতে তাদের কোনো রা নেই, সত্যিকার অর্থেই প্রকৃত অবস্থা ভয়াবহ। শ্রমিকদের বেতন না দিলে তারা সংসার চালাতে পারবে না। অভুক্ত শ্রমিকদের ঘরে বেশি দিন আটকিয়ে রাখা যাবে না। ক্ষুধা এমন এক নির্মম সত্য তা থেকে পরিত্রাণের কোনো উপায় নেই। যে মা-বাবা দেখবে তাদের সন্তানের পাতে খাবার নেই, তাদের করোনার ভয় দেখিয়ে লাভ নেই। শিপমেন্ট না করতে পারলে মালিকরা বেতন চালিয়ে নিতে পারবে না, তা যতই চেঁচামেচি করা হউক না কেন। বেশিরভাগ গার্মেন্টস কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়ে লে-অফ ঘোষণা করে কারখানা বন্ধ করে দিতে পারে। এতে লাখ লাখ লোক বেকার হবে, সামাজিক অস্থিরতা বেড়ে যাবে। এমনি পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটাতে পারে সরকার অথবা বায়ার। তারা মজুরির ব্যবস্থা করতে পারেন। আপদকালিন সময় বিবেচনা করে শ্রমিকদের ভর্তুকির মাধ্যমে সরকার বেতন ব্যবস্থা করতে পারেন এবং বায়াররা যেসব অর্ডার বাতিল করেছেন পরিস্থিতি ভালো হলে সেগুলো গ্রহণ করতে পারেন।

গার্মেন্টস শিল্প আমাদের গর্বের ধন। বহির্বিশ্বের বড় বড় বিপনী বিতানে কাপড় কিনতে গিয়ে আমার মতো অনেকেই যখন দেখি ষ্টিকার লাগানো রয়েছে Made in Bangladesh তখন বুকের ছাতিটা অনেক বড় হয়ে যায়। তাই এটাকে টিকিয়ে রাখতে হবে দেশের স্বার্থে, দেশের অর্থনীতিকে বাঁচাতে। যে শিল্প দিনের পর দিন আমাদের অর্থনীতিকে সচল রেখেছিল, আজ যখন এটি রুগ্ন অবস্থায় পতিত তখন এই শিল্পকে আমাদের স্বার্থেই পরিচর্যা করতে হবে। প্রয়োজনে ভর্তুকি দিয়ে টিকিয়ে রাখতে হবে। শেয়ার বাজার বা ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়ে যাওয়া যেমন আমরা সইতে পেরেছি তা হলে কেন আমরা ভর্তৃকি দিয়ে হলেও পোষাক শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে পারব না? 

সামনে মহাবিপদ। এমনি পরিস্থিতিতে কারখানা খোলা রাখা যাবে না। দেশের সব শ্রেণি পেশার মানুষকে মিলে একে মোকাবিলা করতে না পারলে প্রাণে বাঁচাই দায় হয়ে যাবে। প্রাণ বাঁচানোই এখন সবচেয়ে কঠিন কাজ। তাই মানবিক এই বিপর্যয়ের সময় সবার সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। সকলে মিলে যে যার অবস্থান থেকে এ বিপর্যয়ে সাধ্য অনুযায়ী কাজ করে যেতে হবে। কোনো মন্ত্রী , আমলা বা প্রজাতন্ত্রের চাটুকার কর্মকর্তা যেন উপযাজক হয়ে খুঁজতে না যায় ব্যক্তির পরিচয়। যারা এটা করবে নিশ্চয়ই একদিন তাদের জাতির কাছে জবাবদিহি করতে হতে পারে। সামগ্রিক উন্নয়নে সরকার দায়িত্ব নিক, আর আমরাও যেন সরকারকে আস্থায় নিতে পারি। ক্ষতি অনিবার্য। এখন প্রশ্ন হলো, কতটা আমরা কমাতে পারি।