Cinque Terre

মিনহাজুল ইসলাম জায়েদ

২৪ জুন , ২০২০


সিনিয়র সহকারী সচিব


সুমনকুমার দাশের ‘এপার-ওপার’ গান : হৃদয় গহীনের হাহাকার

সুমনকুমার দাশ। গবেষক ও সাংবাদিক। কর্মক্ষেত্র সিলেট হলেও প্রতিভাগুণে ইতিমধ্যে খ্যাতি কুঁড়িয়েছেন সমগ্র বাংলাদেশ থেকে কলকাতা অবধি। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে সমসাময়িক অনেকেই যখন ছুটেছেন সরকারি কিংবা উচ্চ বেতনের বেসরকারি চাকুরির পেছনে, কেউবা আবার উন্নত জীবনের আশায় পাড়ি দিয়েছেন ইউরোপ-আমেরিকায়, সুমন তখন বেছে নিয়েছেন সাংবাদিকতার জীবন। তবে, সাংবাদিকতার গতানুগতিক গ-ির মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ না রেখে জড়িয়েছেন গবেষণার কাজে। এখন দুই দশক পরে বলা যায়, সুমন ভুল করেননি। 

ভাটি বাংলা তথা সমগ্র বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে ও জানাতে তরুণ বয়স থেকে সুমন ছুটে চলছেন বাংলার গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। ২০০৭ সালে নিজের সম্পাদনায় প্রকাশ করেছেন ‘শাহ আবদুল করিম সংবর্ধন-গ্রন্থ’। কালনীপাড়ের এই বাউলসাধককে নিয়ে তাঁর জীবদ্দশায় এটিই হচ্ছে প্রথম মুদ্রিত গ্রন্থ। পরবর্তী সময়ে শাহ আবদুল করিমের জীবন, কর্ম ও সাধনা নিয়ে একাধিক বই রচনার পাশাপাশি প্রকাশ করেছেন অর্ধশতাধিক গ্রন্থ। বোহেমিয়ান জীবনাচরণে অভ্যস্ত বাউলদের জীবন, কর্ম এবং বাউলতত্ত্বের বৈশিষ্ট্যাবলীই বইগুলোর উপজীব্য। বাদ যায়নি যাবাবর জীবনের বাহক বেদে-বেদেনী সম্প্রদায়ের কর্মকা- ও জীবনসংগীতও। লোকসাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতি এই অনুরাগ তাঁকে পরিচিত করে তুলেছে দুই বাংলায়। তাই ঢাকা-সিলেটের পাশাপাশি কলকাতা বইমেলায়ও প্রকাশিত হচ্ছে সুমনকুমার দাশের বই। 

করোনার এই অবসরকালে সুমন নতুন করে মন দিয়েছেন গান রচনায়। ‘পাতাকাহিনি’ শিরোনামের তাঁর রচিত প্রথম গানটিতে প্রকাশ পেয়েছে যাপিত জীবনের নিত্যকার ঘটনাপুঞ্জি। সম্প্রতি লিখেছেন ‘এপার-ওপার’ শীর্ষক চব্বিশ চরণের নিচের হৃদয়স্পর্শী গানটি :

‘তোমার-আমার এই জনমে

হয় না দেখাদেখি

নিজের মতো মনের মধ্যে

তাইতো ছবি আঁকি ॥

এই পাড়েতে আমি থাকি

ওই পাড়েতে তুমি

মধ্যে কত বিধি-নিষেধ

এক ভাষা, এক ভূমি ॥

একই আকাশ, একই গান

একই মোদের বুলি

এক নদী, এক ধান

এক ঠাকুরমার ঝুলি ॥

তোমারে ছেড়ে এলাম আমি

আমারে ছেড়ে তুমি 

কত টান, কত মায়া

শূন্যে তোমায় চুমি ॥

কত বিচ্ছেদ, কত দুঃখ

কত কত স্মৃতি

বুকের ভেতর কত অসুখ

ডোরে বাঁধা পিরিতি ॥

পুবেতে (পশ্চিমে) বসিয়া আমি

পশ্চিমের (পুবের) গান রচি

বুকের ভেতর আছো তুমি

এই আশাতেই বাঁচি।

বিরাশি শব্দের গানটি নিছক কোনো গান নয়, দুই পারের মানুষের হৃদয়ের গহীনে থাকা অনন্ত হাহাকারের বাস্তব প্রতিধ্বনি। ইংরেজরা আমাদেরকে কেবল দুইশো বছর শাসনই করেনি, ভারত ত্যাগের পূর্বে বিভক্ত করে গেছে হাজারো বছরের ঐতিহ্যম-িত ঐতিহাসিক বাংলাকে। বিশ্ব ইতিহাসে বাংলা নামে যে অখ- ভূ-খ- ছিল ক্লাইভ লয়েডের উত্তরসূরিরা তার বুকে ছুরি চালিয়ে-ভাগ করে দিয়েছে। সাত শতক পরও নাড়ি বিচ্ছিন্নের সেই রক্তক্ষরণের জ্বালা ভুলতে পারেনি উভয়পারের বাঙালিরা। সিলেটবাসীর জন্য শিকড় ছিন্ন হওয়ার দুঃখগাথাটা তুলনামূলক বেশি। 

১৯৪৭ সালের গণভোটে তৎকালীন আসাম প্রদেশের সমগ্র সিলেট জেলা (সিলেট সদর, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, দক্ষিণ সিলেট বর্তমান মৌলভীবাজার এবং করিমগঞ্জ মহকুমা) একসঙ্গে থাকার পক্ষে রায় দিলেও জনরায়কে অবজ্ঞা করে র‌্যাডফ্লিকের দেওয়া অনৈতিক ও অবিচেক সিদ্ধান্তের কারণে সমগ্র সিলেটবাসীর এক সঙ্গে থাকা হয়ে উঠেনি। সে সময়কার সিলেটের সাড়ে তিন থানা (পাথারকান্দি, রাতাবাড়ি, বদরপুর এবং করিমগঞ্জের কিয়দংশ) বিছিন্ন হয়ে যায় সিলেট থেকে। এক সময় একই জেলা এমনকি একই থানার বাসিন্দা হওয়া সত্ত্বেও সীমান্ত রেখার নির্মম এই বাঁধা বিচ্ছিন্ন করেছে একই মায়ের সন্তানদের, অতি আপনজনদের। একই ভাষা, সংস্কৃতি, বর্ণমালা, রীতিনীতি ধারক-বাহক হয়েও আজ আমাদের ভিন্ন পরিচিতি, ভিন্ন জাতীয়তা। সীমান্ত পারের মানুষদের এই হাকাকার কখনো ঘুচাবার নয়। 

‘এপার-ওপার‘ গানে সুমনকুমার দাশ খুব সাবলীলভাবে, সহজ ও প্রাঞ্জল ভাষায় তুলে ধরেছেন দেশভাগের ফলে দুই পারের মানুষের হৃদয়ের সেই মর্মবেদনা। অনেক সময় গীতিকাব্যে রূপক, উপমা ব্যবহার করা হয়, যা হয়ত কারো কারো কাছে বোধগম্য হয়ে উঠে না। তবে সুমন এক্ষেত্রে ব্যতিক্রমতা দেখিয়েছেন। কোনো ধরনের রূপক, উপমা প্রয়োগ না করে দুর্বোধ্য কোনো শব্দ চয়ন  ছাড়াই রচিত হয়েছে আলোচ্য গানটি। ফলে গানের প্রতিটি কথা সহজেই যে কারো কাছে অনুধাবনযোগ্য।  

কোনো গানের কথা যতই সুন্দর, অর্থবোধক কিংবা হৃদয়গ্রাহী হোক না কেন, সুর আর গায়কী সঠিক না হলে তা শ্রোতার মনে দাগ কাটতে পারে না। ওপার বাংলার শিল্পী শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদারের সুর আর কণ্ঠ গানটিকে দিয়েছে শিল্পের মর্যাদা। পরে সিলেটের শিল্পী লিংকন দাশের দরদী কণ্ঠও শ্রোতাদের মন ছুঁয়েছে। লিংকনের বিরহী কণ্ঠের ছোঁয়া কেবল সীমান্ত রেখার কারণে আপনজন বিচ্ছিন্ন হওয়াদের নয়, স্পর্শ করেতে বাধ্য দুই বাংলার যেকোন আবেগী শ্রোতাকে। লিংকনের গাওয়া গানের ভিডিও নির্মাণে অন্যান্য কারিগরি ব্যবস্থাপনাও প্রশংসার দাবি রাখে। 

আলোচ্য গানের কথা, শব্দচয়ন, নির্মাণ-কৌশল বলে দিচ্ছে সাংবাদিকতা ও গবেষণার ন্যায় গীতিকার হিসেবেও সুমনকুমার দাশ অচিরেই দুই বাংলায় নিজের শক্ত স্থান করে নেবেন।