Cinque Terre

সৈয়দ তানভীর আলম

২৭ জুন , ২০২০


ব্যাংক কর্মকর্তা


লকডাউন বুমেরাং

কিছু বাস্তবমুখী আর সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত হয়তোবা বদলে দিতো করোনা মহামারীতে আমাদের দুরাবস্থার গল্প। এই ভাইরাসকে পরাজিত করে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি স্বাভাবিক রেখে জীবনযাত্রা হতো চলমান। 

কিছু বিষয়ে ইতিমধ্যে আমাদের ধারণা পরিষ্কার হয়েছে যে, করোনা যেমন ভয়ংকর ছোঁয়াছে ঠিক তেমনই এই ভাইরাস হয়েছে এমন কারো সংস্পর্শ ছাড়া অন্য কারো করোনা হওয়ার সম্ভাবনা নেই। সেক্ষেত্রে কিছু কিছু বিষয় বিবেচনায় অন্যান্য অনেক রোগ থেকে করোনা কিছুটা কম মারাত্মক বলে আমরা আপাত দৃষ্টিতে ধরে নিতে পারি। তাহলে প্রশ্ন হলো এটা কেন পুরো পৃথিবীকে কাঁপিয়ে দিয়ে মহামারী রূপ ধারণ করল? কারণ এটা অতিমাত্রায় ছোঁয়াছে আর অনেক সময় সুপ্ত অবস্থায় এই ভাইরাস কোন উপসর্গ ছাড়াই আক্রমণ করে। ফলে বহনকারী নিজেও জানেনা যে সে সংক্রমিত হয়েছে। আরেকটি উল্লেখযোগ্য  বৈশিষ্ট হলো ১৫ থেকে ২০ দিনের মধ্যে সংক্রিমত ব্যক্তি সেরে উঠেন কিংবা চূড়ান্ত ফল ভোগ করে মারা যান। 

আমরা দেখেছি প্রথমদিকে চীন,ইতালি আমেরিকা যখন এই ভাইরাসের আক্রমণে টালমাটাল হয়ে গিয়েছিল তখন আমাদের জীবন যাত্রা স্বাভাবিক ছিল আর তাদের করুণ পরিস্থিতি আমরা অবলোকন করে গিয়েছি এবং নিজেদেরকে ব্যস্ত রেখেছি এটা ভেবে যে হয়তো করোনা আমাদের কাছে আসবে না। অথচ তখনই এই ভাইরাসের প্রকৃতি সম্পর্কে আমরা অনেক অগ্রিম ধারণা পেয়েছিলাম।

সে মুহূর্তে কঠোর সতর্কতা, সাবধানতা অবলম্বন করে যদি আমরা কিছু তড়িৎ সিদ্ধান্ত নিতে পারতাম তাহলে আমাদের গল্পটাও হয়তোবা হতে পারত অন্যরকম। একটা দেশের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নিয়ামক হতে পারে কিন্তু কখনোই প্রভাবক হতে পারেনা বরং কিছু ক্ষেত্রে বুমেরাংও হয়ে যেতে পারে। অথচ আমাদের মতো ছোট আয়তনের দেশে সরকারি অনেক সিদ্ধান্ত ইদানীং অনেকখানি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রভাবিত হয়। এই স্পর্শকাতর পরিস্থিতিতে লকডাউন, সাধারণ ছুটি, পদস্থ কর্মকর্তার সমালোচনা, অব্যাহতি এসব বিষয়ে এই মাধ্যম বিরাট প্রভাব রেখেছে যেটার ভালো দিকের চেয়ে মন্দ দিকটাই বেশি। কারণ ফেক আইডি, অপ্রাপ্ত বয়ষ্ক আইডিসহ অনেক ধরনের জালিয়াতি এসব মাধ্যমে পরিলক্ষিত হয়।

আমরা অন্তত এটা বুঝতে পারছি যে আমাদের দেশে কীভাবে করোনা ভাইরাস সংক্রমিত হয়েছে। আমাদের অন্য অনেক বড় বড় বাজেটের তুলনায় অল্প বাজেটে তখন বিদেশ ফেরতদের জন্য একটা কোয়ারেন্টাইন পিরিয়ড ধরে যদি সরকারি ব্যবস্থাপনায় কোয়ারেন্টাইনের সুব্যবস্থা করতে পারতাম যাতে দেশে এসে সবাই পনের থেকে বিশদিন একটা মোটামুটি ভালোমানের সরকারি ব্যবস্থায় ফিল্টারিং হয়ে  দেশের সামাজিক সংস্পর্শে এবং নিজেদের পারিবারিক সংস্পর্শে যেতে পারেন। এজন্য সরকারি বরাদ্দে কোন কোয়ারেন্টাইন হোম  তৈরি করা বা ভাড়া নেওয়ার জন্য যথেষ্ট সময় ছিল। নির্দিষ্ট সময় পরে সুস্থরা পরিবারে ফিরে যেত আর অসুস্থদের কে আইসোলেশনে পাঠানো যেত। হয়তো এই সময়ের জন্য একটা ন্যূনতম ফি নেওয়ার ব্যবস্থা করা যেত। কত ভাবেই তো আমরা ভ্যাট ট্যাক্স আদায় করছি। 

কিন্তু আমরা হোম কোয়ারান্টাইনের কথা বলে বিদেশ ফেরতদের আমাদের শহওে, গ্রামে, গঞ্জে সামাজিক সংস্পর্শে ছেড়ে দিয়ে প্রথম ভুলটা করলাম। আমি কিন্তু আমার  দেশের রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের দেশে ফিরতে বাধা দিতে বলিনি বরং কাউন্সিলিং এর মাধ্যমে সরকারি ব্যবস্থায় কোয়ারেন্টাইনের কথা বলছি। সরকারের সিদ্ধান্তের সমালোচনা যতই হোক দেশের বৃহত্তর স্বার্থে আমরা প্রতিটি জনগণই তা মানতে বাধ্য।

পরবর্তী সময়ে যখন আমরা বুঝতে পারলাম করোনা আক্রান্ত রোগী আমাদের দেশে ধরা পড়ছে এবং সংক্রমণ হওয়া শুরু হয়েছে তখন ও আমাদের কিছু সঠিক সিদ্ধান্ত আমাদেরকে স্বাভাবিক অবস্থায়, সচল অর্থনৈতিক কর্মকা-ে চলমান রাখতে পারতো।

কিন্তু আমরা আবার ভুল করলাম। সেনাবাহিনী, পুলিশ নিয়োজিত করে যে লকডাউন আর সাধারণ ছুটি দিলাম তা ছিল খুব শিথিল একটা ঘোষণা আর কিছু আম জনতার মুর্খতা এবং সরকারি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অবাধ্যতা। এই লকডাউন বা রাসটান আর সীমিত পরিসর কিছু কিছু ক্ষেত্রে জনসমাগম আর ভীড় আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল। 

আমরা এখন এলাকাভিত্তিক জোন করে সতর্কতার কথা বলছি আর বিধিনিষেধ আরোপ করছি। ব্যাপারটা খুবই হাস্যকর এবং একদম অনুর্বর। আমরা এখন পর্যন্ত সঠিকভাবে টেস্ট করতে পারছিনা, সঠিক আক্রান্ত নির্ধারণ করতে পারছিনা। সেখানে আমাদের এলাকাভিত্তিক জোন নির্ধারণ করা কতটুকু যুক্তিযুক্ত? যে দেশের জনগণ মাছের ড্রামে করে লুকিয়ে ফাঁকি দিয়ে এলাকা পরিবর্তন করে, কন্টেইনারে করে বাড়ি যায়, রেড জোন সীমানার বাসার সামনের গেট দিয়ে ঢুকে পেছনের গেট দিয়ে গ্রীণ জোনে প্রবেশ করে, করোনাভাইরাসের নাম শুনলে মশকরা করে সে দেশে এই জোন বিভক্তির ফর্মুলা কতটুকু কার্যকর হবে আমাদের ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে কাজ করেনা।

সবুজ জোন যে কালকে লাল জোন হবেনা সে নিশ্চয়তা কে দিবে?

অপরদিকে সারাদেশে একযোগে কঠোরভাবে  পনের বিশ দিনের জন্য গৃহবন্ধীর মত লকডাউন করে দিলে আশা করা যায় একটা ফলাফল পাওয়া যেত। যাদের হয়ে ইতিমধ্যে করোনা হয়ে গেছে তারা সুস্থ হয়ে যেত, কিছু লোক হয়তো মারা যেতেন, তবে নতুন করে কারো সংক্রমণ হতোনা এটা বলা যায়। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য কেনার জন্য দুই একদিনের সময় দিয়ে সবকিছু বন্ধ করে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে ভালো ফলাফল আমরা আশা করতে পারতাম।

আর বিদেশফেরত সবাইকে ১৫ দিনের সরকারি ব্যবস্থাপনায় কোয়ারেন্টাইনে রাখতে পারলে আজকে আমারাও হয়তো অনেক দেশের জন্য উদাহরণ হতে পারতাম। 

তবু কামনা করি-সুস্থ থাকুক জনগণ। স্বাভাবিক হয়ে যাক সবকিছু। সবার নিশ্চয় এটিই চাওয়া।

 

মতামত বিভাগে প্রকাশিত মতামত ও লেখার দায় লেখকের একান্তই নিজস্ব, এর সঙ্গে সিলেট মিরর সম্পাদকীয় নীতিমালা সম্পর্কিত নয়। দৈনিক সিলেট মিরর সকল মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তবে মুক্তমতে প্রকাশিত লেখার দায় সিলেট মিরর -এর নয়।