Cinque Terre

সঞ্জয় কুমার নাথ

০১ জুলাই , ২০২০


লেখক : গদ্যকার


‘তাদের মিল যে ছিল বড়’

বাসার এক চিলতে ছাদ। সকাল-বিকাল এখানেই হাঁটাহাঁটি করি। প্রতি পদক্ষেপে মুক্তির জাল বুনি। প্রতিদিনের দৃশ্যপট প্রায় একই রকম। উত্তরদিকে ঝুলে থাকা পাশের বাড়ির গাছে কাঁচা-পাকা আম। দক্ষিণ দিকে লাল টিনশেডের সুন্দর ঘরগুলো পেরিয়ে চোখ-ভরা সবুজের হাতছানি। পূর্বে থালার মতো সূর্যটা উঠার প্রতীক্ষায় থাকি ভোরে। বিকেলে একইভাবে উঁচু দালানের কাঁচের জানালায় গোধুলি বেলার সূর্য-কিরণ উপচে পড়ে। শাঁখ-ঘন্টি বাজার শব্দ পাই। দূর থেকে দেখি সন্ধ্যা-প্রদীপ দিচ্ছে কেউ। পশ্চিমে বড় মসজিদ থেকে যখন আজান ভেসে আসে, তখন মন কেমন আকুলি-বিকুলি করে। ধীরে ধীরে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে। আবছা আঁধার নামে চারপাশে। কী এক বেদনায় যেন বিশ্ব-সংসার ¤্রয়িমান হয়ে যায়। অতঃপর চায়ের খালি কাপ, বই, মেলে দেওয়া ভিজে-শুকনো কাপড় নিয়ে নিচের দিকে সিঁড়ি ভেঙে চারদেয়ালে বন্দী হতে হয়। বন্দীদশায় বসতে হয় ডিভাইসের সামনে।

এখন বদলে যাওয়া সময়ে পাল্টে গেছে জীবনের গৃহস্থালী। ভাবনা আর স্বপ্নের ঘটেছে রকমফের। কাছের-দূরের বন্ধু-স্বজন কে কোথায়, কেমন আছেÑকেবল প্রযুক্তির প্রয়াসে হাই-হ্যালো। চিকিৎসক মঈন উদ্দিন যখন করোনায় আক্রান্ত হলেন, তখন তাঁকে আমাদের ঘরের ছেলে ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারিনি। গোটা সিলেট তখন মঈন উদ্দিনের ঘর। সকল মনোযোগ আর প্রার্থনা ছিল তাঁকে ঘিরে। যেদিন চলে গেলেনÑঅভিন্ন কষ্টে সিলেটবাসীর অশ্রু সুরমা বেয়ে সারা বাংলার মানুষের কান্নায় সামিল হয়ে মেশে বঙ্গোপসাগরে।

জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান, জামিলুর রেজা চৌধুরী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানী, রাজনীতিবিদ মোহাম্মদ নাসিমসহ একইভাবে প্রতিদিন চলে যাওয়া প্রতিটি মানুষের জন্য প্রতিনিয়ত হাহাকার নিয়ে আমাদের চলছে করোনাকালীন দিনরাত্রি। শবমিছিল ক্রমেই দীর্ঘ হচ্ছে। যেদিন সিলেটের রাজনীতির আইকন বদরউদ্দিন আহমদ কামরান করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন, আমাদের মনে হলোÑএর চেয়ে নিষ্ঠুর সংবাদ আর কী হতে পারে! অথচ অসুস্থতা আর চিরতরে হারিয়ে যাওয়ার খবর শুনতে শুনতে আমরা অনুভূতিহীন হয়ে পড়ছি। আমাদের গন্তব্য কোথায়, কোথায় থামব আমরা কেউ জানি না।

এখন করোনা ছাড়া আর তেমন কোনো বিষয় আলোচনায় আসে না। টিভি স্ক্রলে যখন দেখি স্বীয় কর্মক্ষেত্রে প্রতিথযশা প্রিয় মানুষগুলো আক্রান্ত, তখন আতঙ্কে থাকি-এরপর তবে কে? নিজের কথাই আগে মনে আসে। মনে হয় এই সময়ে সুস্থ থাকার চেয়ে বড় চাহিদা নেই, বেঁচে থাকার চেয়ে বড় প্রাপ্তি নেই। জনস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, ক্রিকেটার মাশরাফি বিন মর্তুজা, শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যাসহ দেশের অমূল্য সম্পদ থেকে শুরু করে পরিচিত-অপরিচিত সকল শ্রেণির মানুষের আক্রান্ত হওয়ার সংবাদে বিচলিত হই। অপেক্ষায় থাকি তাঁদের সুস্থতার সংবাদ শোনার জন্য। একই সঙ্গে অনলাইনের সংবাদে ইতিউতি খুঁজি বেঁচে থাকার বারতা। ফেসবুক ঘাঁটি। তবে প্রায়ই বিরস হতে হয়।     

এই সময়ে আনন্দের খবরগুলোও থাকে বেদনায় মোড়ানো। তবু কিছু কথা- কবিতা-গান, কিছু ঘটনা ও উদ্যোগ বেঁচে থাকার রসদ জোগায়। মানবিক হওয়ার শিক্ষা দেয়। শিল্পমনকে জাগ্রত করে। আলোর পথ দেখায়। সম্প্রতি লোকসংস্কৃতি গবেষক সুমনকুমার দাশের লেখা ‘পাতাকাহিনি’ শিরোনামের একটি গান ভাবিয়ে তুলে। ‘তাদের মিল যে ছিল বড়’Ñএ কথাটি মনকে ভীষণ দোলা দেয়। আসলেই তো এই যাপিত জীবনের আনন্দ-বেদনার কাব্যে আমরা জড়িয়ে আছি পরস্পরের সঙ্গে। একইভাবে তাঁর ‘এপার-ওপার’ গানটিও ছেড়ে যাওয়ার, চলে যাওয়ার করুণরসে সিক্ত করে। এই গানটির সঙ্গে সুরমা-বরাক উপত্যকার মানুষের আত্মিক সম্পর্ক রয়েছে। এই মুহূর্তে তার প্রভাব আরও প্রবল। এ দুটি গান যেন এ সময়ের কথাই বলছে। বিশ্বজুড়ে এমন রচিত গান-কবিতা আমাদেরকে এই দুঃসহ সময়ে মানবিক হতে শিক্ষা দিচ্ছে। করোনা পরিস্থিতি বিশ্বকে বদলাবে নিঃসন্দেহে, তবে মানুষকে যদি বদলায় তাহলে অন্তত সব হারিয়েও কিছু পেয়েছি বলে গর্ব করতে পারব।   

অবশ্য মুখভরে বলছি, মানষের জন্য মানুষ এখনো সবচেয়ে বড় বন্ধু। তার  নজির মানুষ প্রতিদিন গড়ছেন। গভীর শ্রদ্ধায় স্যালুট জানাতে হয় সামনের সারির যোদ্ধাদের। চিকিৎসক, সেবিকা, সেবাকাজের কর্মী, আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্য, সাংবাদিক ও জনপ্রতিনিধিরা মানুষের সেবায় নিয়োজিত আছেন নিরলস নিঃস্বার্থভাবে। আক্রান্ত কিংবা মৃত্যুভয়ে তাঁরা ভীত নন। 

করোনার শুরু থেকেই বিবেকবান মানবিক মানুষ মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। নিজের শহর সিলেটের কথাই বলি। সম্মিলিত নাট্যপরিষদ সিলেট মানবিকতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। মানুষের পাশে থাকার মহৎ কাজে নাট্যপরিষদের সদস্যরা নিজের জীবনের ঝুঁকিকে তুচ্ছ করেছিলেন। স্যানিটাইজার তৈরি ও বিতরণে দিনরাত কাজ করেছেন। ম্যাসেঞ্জার গ্রুপে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রেখেছেন তারা। অনলাইনে সাংস্কৃতিক কর্মকা- সচল রেখেছেন সিলেটের সাহিত্য ও সংস্কৃতিকর্মীরা। দুস্থ শিল্পীদের সহায়তায় আর্থিক সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছেন। আর্থিক সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছেন সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবিরা। শিক্ষকরা এগিয়ে এসেছেন। শিক্ষা কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এগিয়ে এসেছেন। সবাই বেতনের টাকা থেকে সরকারি ফান্ডে অর্থ দিয়েছেন। শিক্ষকরা অনলাইনে ক্লাস করছেন। মুঠোফোনে শিক্ষার্থীদের খোঁজ নিচ্ছেন। ব্যবসায়ীরা ব্যবসা বন্ধ থাকলেও তাদের কর্মচারীদের সাধ্যমতো বেতন ভাতা মিটিয়ে দিচ্ছেন। খুদে ব্যবসায়ীরা দোরগোড়ায় পৌঁছে দিচ্ছেন নিত্য-প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি। এমন অনেক পেশার মানুষ রয়েছেনÑযাঁরা নীরবে-নিভৃতে কাজ করছেন মানুষের জন্য। এমন অনেক রয়েছেন, যাঁরা তাদের বন্ধু, স্বজন কিংবা পরিচিতদের গোপনে সহায়তার হাত বাড়িয়েছেন। এসব শুদ্ধ সমাজের সুনাগরিকদের দায়িত্ব ও কর্তব্যও বটে। 

এই চিত্রের বিপরীতে ভয়াবহ আর হৃদয় বিদারক ঘটনাও আমাদের বোধ আর সত্ত্বাকে কলঙ্কিত করছে। সন্তান করোন আক্রান্ত পিতা-মাতাকে রাস্তায় ফেলে দিচ্ছে। যাদের সেবা দেওয়ার কথা, তারা অসহায়-দরিদ্রদের ত্রাণ আত্মসাৎ করছেন। কিছু জনপ্রতিনিধি নির্লজ্জ স্বজনপ্রীতি করছেন।

শেষ কথা হলো, এসব  থাকবেই। নয়ত মানুষ আর অমানুষের পার্থক্য নির্ণয় হবে কীভাবে? সবচেয়ে দুঃখের বিষয় হচ্ছে, আমরা প্রথম থেকেই উদাসীন ছিলাম। প্রবাসীদের যথাযথভাবে কোয়ারেন্টাইন করা হয়নি। বর্তমানেও করোনার ভয়াবহতা নিয়ে মানুষ আতঙ্কগ্রস্থ হলেও মোটেই সচেতন নয়। বিশেষ করে সিলেটে আক্রান্ত ও মৃত্যুর লেখচিত্র দেখলেই বোঝা যাবে আমরা কী ভুল করছি। বাজারে, রাস্তায় মানুষের ঢল। স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না কেউ। 

সরকার, প্রশাসন, ব্যক্তিগত উদ্যোগ সব ব্যর্থ হয়ে যাবে, যদি সচেতন মানুষগুলো এক না হয়ে করণীয় নির্ণয় না করেন। কেবল হ্যাঁ-হুতাশ করে যুদ্ধে জয়ী হওয়া যায় না। 

মৃত্যু যখন দুয়ারে দাঁড়িয়ে, তখন বেঁচে থাকার শেষ চেষ্টাটুকু চালিয়ে যেতে হয়। সর্বক্ষেত্রে একতা, সম্প্রীতি আর দূরদৃষ্টির বিকল্প নেই। বিমূঢ় হয়ে বসে থাকা পরাজয়। এই বিচিত্র দেশে প্রাপ্তি আসে প্রতিবাদে। সিলেটের কথাই ধরি, আমাদের অভিন্ন এক সুর আছে সংগ্রামের, মিলনের। সেই সুরটি ধরতে হবে। হারি-জিতি বড় কথা নয়। বদলে যাওয়া পৃথিবীর অনাগত প্রজন্ম  যেন বলতে পারে, ‘তাদের মিল যে ছিল বড়’।