আব্দুল ওয়াছেহ চৌধুরী জুবের
০৩ জুলাই , ২০২০
আইনজীবী
নিজের জীবিকার তাগিদ আর রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় থাকার কারণে হকভাইর সঙ্গে দীর্ঘ দিন যোগাযোগ ছিল না । অথচ ৯০ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত প্রায় প্রতিদিনই সকালে তাঁর ফোনে ঘুম থেকে উঠতাম। অনেক বিনিদ্র রজনী কেটেছে তাঁর বাসায়। ব্যবসা বা রাজনীতির কারণে তিনি যখন ঢাকা যেতেন, প্রায় সময়ই তাঁর সফরসঙ্গী থাকতাম আমি। রাজনীতির অনেক উত্থান-পতনের স্বাক্ষী ছিলাম এজন্য। তাঁর সম্পর্কে আমার উপলব্ধি, তিনি অত্যন্ত পরোপকারী ও সাদা মনের মানুষ ছিলেন।
গত ৩ জুলাই সকালে সেই মানুষটি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন না ফেরার দেশে। এ সংবাদ শোনার জন্য আমরা অনেকেই প্রস্তুত ছিলাম না। এরপরও মেনে নিতে হবে। তাই কায়মনে প্রার্থনা করি, মহান আল্লাহ যেন হকভাইকে জান্নাতের সর্বোচ্চ স্থানে জায়গা করে দেন। আমীন।
আজ থেকে প্রায় তিন দিন আগে ৩০ জুন রাত পৌঁনে বারোটার দিকে ছোটভাই রাব্বি আমাকে ফোন করে জানতে চায়, হক ভাইর সর্বশেষ খবর জানি কি না? আমি না সূচক উত্তর দিয়ে জানতে চাই কেন? তখন সে বলে, আমার কাছে খবর আছে তাঁকে করোনার উপসর্গ নিয়ে নর্থ ইষ্ট মেডিকেলে ভর্তি করা হয়েছে। বিষয়টি নিশ্চিত হতে আমি ফোন করি আমার বন্ধু ও সিলেট জেলা ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি মিজানুর রহমান চৌধুরীকে। মিজান বলে, সে এরকম কিছু জানে না। আমি বলি জেনে জানাতে। পাঁচ মিনিট পর মিজান আমাকে ফোন করে জানায়, হক ভাইর ছেলে আদনান এর সঙ্গে তার কথা হয়েছে। হক ভাইকে নর্থ ইষ্ট হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তবে তিনি যে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন তা তখন নিশ্চিত ছিল না। আমি বিষয়টি রাব্বি এবং দৈনিক সিলেট মিরর সম্পাদক আহমেদ নূর ভাইকে অবহিত করি। গত ১ জুলাই একমাত্র সিলেট মিরর হকভাইর অসুস্থতার খবর ছাপে। ২ জুলাই আবারও মিজানের সঙ্গে কথা হয়। কথা হয় সিলেট মহানগর ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি বন্ধু জিয়াউল গণি আরেফিন জিল্লুরের সঙ্গে। দুজনেই জানায় হক সাহেব ভালো আছেন। কিন্তু ২৪ ঘন্টাও অতিবাহিত হলো না, এরই মধ্যে তিনি সবাইকে ছেড়ে চলে গেলেন।
হকভাইর সঠিক মূল্যায়ন করার মতো জ্ঞান আমার নেই। লেখার পরিধি বাড়াব না। কারণ পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লিখেও সিলেট বিএনপির রাজনীতিতে তাঁর যে ‘কনট্রিবিউশন’ তা শেষ করা যাবে না।
স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন শেষে ৯১ সালে যখন বিএনপি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসে তখন দলে দলে নানা দলের লোক ভিড় করে বিএনপিতে। শুরু হয়ে যায় নেতৃত্বের অসম প্রতিযোগিতা। বিশেষ করে ছাত্রদলে। যা ৯৩-৯৪ সালে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ বা নিত্যযুদ্ধে রূপ নেয়। নানা গ্রুপ উপগ্রুপে বিভক্ত ছাত্রদলকে মদদ দিতে থাকেন বিএনপি নেতারা। অবিশ্বাস্যভাবে কেন্দ্রের কোনো কোনো নেতাও এতে সম্পৃক্ত হন। কিন্তু ব্যতিক্রম ছিলেন হক ভাই। তিনি সমঝোতার রাজনীতির অংশ হিসেবে সবার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে। এ নিয়ে মুখরোচক সমালোচনা হতো তাঁর। তিনি ছাত্রদলকে এক করার যে মিশন নিয়েছিলেন, সে মিশনে একসময় শরীক হন সাবেক অর্থমন্ত্রী এম.সাইফুর রহমান। ৯৬ সালের শুরুতে সেই মিশন কাজ করতে শুরু করে। হক সাহেবের প্রচেষ্টা আর এম. সাইফুর রহমানের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটাতে নগরের রায়নগরে বিএনপির এক শীর্ষ নেতার বাসায় নির্ধারিত কিছু বিএনপি নেতা আর ছাত্রদলের বিবাদমান প্রধান দুটি গ্রুপের গ্রুপ প্রধান বৈঠকে বসেন। যার ধারাবাহিকতায় ৯৬ সালের ২৬ অথবা ২৭ ডিসেম্বর সবাইকে অবাক করে দিয়ে কোনো প্রকার প্রকাশ্য বিদ্রোহ ছাড়া সিলেট জেলা ছাত্রদলের কমিটি গঠন হয়। যা ওই সময়ের পরিস্থিতিতে কল্পনা করাও ছিল বিলাসিতা। আজ সেই হক ভাই নেই। তাই বলতে হয়, সিলেট বিএনপি ক্রমশ মুরব্বি ছাড়া সংগঠনে পরিণত হতে চলেছে। বিএনপির বাইরেও হক ভাইর আলাদা এক গ্রহনযোগ্যতা গড়ে উঠে। তাই বিএনপির সকলের হক ভাই কিংবা বন্ধু সংগঠনের শুধু হক ভাই নয়, ক্ষেত্র বিশেষে ‘হক সাহেব’ হতে পেরেছিলেন। জয়তু হক ভাই-পরপারেও ভালো থাকবেন।