Cinque Terre

গোলাম রব্বানী চৌধুরী

০৯ এপ্রিল , ২০২০


ব্যবস্থাপনা পরিচালক

বারাকা গ্রুপ 


কতটা প্রস্তুত সিলেট?

সারাবিশ্বে এখন এক আতঙ্কের নাম করোনাভাইরাস। চীন থেকে শুরু হওয়া এই দুর্যোগ এখন সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। ইতালি, স্পেন, যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যে এখন মৃত্যুর মিছিল। প্রতিদিনই এই সংখ্যা বাড়ছে। বাদ যায়নি আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশও। করোনা হানা দিয়েছে এখানেও। আজ ৮ এপ্রিল পর্যন্ত দেশে আক্রান্তের সংখ্যা দুই শতাধিক। মারা গেছেন ২০জন। তিনদিন আগে সিলেটেও করোনা আক্রান্ত একজন শনাক্ত হয়েছেন। পেশায় তিনি একজন চিকিৎসক। ধারণা করা হচ্ছে রোগীর সংস্পর্শ থেকে তিনি আক্রান্ত হয়েছেন। এটা সিলেটবাসীর জন্য নতুন করে শঙ্কা ও উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

সিলেটে করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার জন্য শহীদ শামসুদ্দিন আহমদ (সদর হাসপাতাল) হাসপাতালকে প্রস্তুত করা হয়েছে। গত মার্চ মাসে এ হাসপাতালে পরপর দুজন রোগী করোনাভাইরাস সন্দেহে ভর্তি করা হয়েছিল। দুঃখের বিষয় তারা দুজনেই মারা যান। মৃত্যুর পর করোনাভাইরাস পরীক্ষায় তাদের অবশ্য ফলাফল নেগেটিভ এসেছিল। হয়ত সান্ত¦না এইটুকু ছিল, তারা করোনাভাইরাসে মারা যান নি। তবে মনে রাখতে হবে, সামনে হয়ত কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলার প্রয়োজন পড়বে। এ জন্য আমাদেরকে তৈরি থাকতে হবে।

বর্তমানে একজন চিকিৎসক করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ওই হাসপাতালে আইসিইউতে আছেন। যদিও শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত বুধবার (৮ এপ্রিল) বিকেলে ওই চিকিৎসককে ঢাকায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ অবস্থায় গোটা পৃথিবী যখন করোনাভাইরাসের মহামারীতে বিপর্যস্ত তখন বাংলাদেশ এই দুর্যোগ মোকাবিলায় কতটুকু প্রস্তুত সেটাই এই সময়ে বড় বিবেচ্য। বিশেষ করে যেহেতু আমি সিলেটের সন্তান সেহেতু সিলেটের বাস্তবতা নিয়ে আমার উদ্বেগ থাকাটা স্বাভাবিক। তাই আমাদের কথা হলোÑসিলেট শহীদ শামসুদ্দিন আহমদ হাসপাতালে করোনা রোগীদের জন্য সার্বিক ব্যবস্থা কি পর্যাপ্ত? তাছাড়া চিকিৎসার প্রস্তুতির ব্যাপারে চিকিৎসকসহ হাসপাতালটি কতটুকু প্রস্তুত এ বিষয়টি সবার অবগতির জন্য নিশ্চিত হওয়া একান্ত জরুরি।

হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, এই হাসপাতালে সর্বোচ্চ ১৫০ শয্যা রাখার ব্যবস্থা রয়েছে। ছিল মাত্র দুইটি ভেন্টিলেটর। আজ (৮ এপ্রিল) যখন এই লেখাটি লিখছি তখন জানতে পারলাম আরও ৫টি ভেন্টিলেটর এনে এই সংখ্যা মাত্র সাতে উত্তীর্ণ করা হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই বলা যায়, এটি পর্যাপ্ত নয়। কারণ করোনা আক্রান্তদের পরিস্থিতি অবনতি হলে ভেন্টিলেশন অতি জরুরি। এছাড়া এই হাসপাতালে আইসোলেশনে চিহ্নিত বা সন্দেহভাজনদের চিকিৎসার ক্ষেত্রে কতটুকু সতর্কতা অবলম্বন করা হচ্ছে কিংবা একটি বিশেষ শ্রেণীর ভাইরাস হওয়ায় এর বিস্তার রোধে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া এবং বিধি বিধান প্রতিপালিত হচ্ছে কিনা সেটাও একটা বড় বিষয়।

সিলেটে করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীদের জন্য দ্বিতীয় অস্থায়ী হাসপাতাল হিসেবে ভাবা হচ্ছে, শাহী ঈদগাহ এলাকায় অবস্থিত সিলেট সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালকে। যতটুকু জানি সেটি এখনো প্রস্তুত করা হয়নি। বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের এখন তৃতীয় পর্যায় (যদিও কারো কারো মতে চতুর্থ পর্যায়) শুরু হয়ে গেছে। তাই আগামী অন্তত চার সপ্তাহ কীভাবে এই মহামারী দুর্যোগ মোকাবিলা করতে হবে সেটিই বড় বিষয় বলে মনে করি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী গত মঙ্গলবার সিলেট ও চট্ট্রগামের বিভাগীয় পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে এক ভিডিও কনফারেন্সেও এমন উদ্বেগ এবং আশঙ্কার কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন এপ্রিল মাস আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সুতরাং করোনার বিরুদ্ধে এই যুদ্ধে সিলেটকে কীভাবে রক্ষা করা যায়-সে ব্যাপারে আমি কিছু প্রস্তাবনা রাখছি।

১. প্রথমেই বলতে চাই, সিলেট স্বাস্থ্য বিভাগের উদ্যোগে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের শীর্ষ ব্যক্তিদের নিয়ে জরুরিভিত্তিতে সভায় বসতে হবে। সবাই মিলে একক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা, করোনা রোগীদের জন্য অন্তত চারশ শয্যার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।

২. এই দুর্যোগময় মুহূর্তে দুইশ সদস্যের ডাক্তার, সেবিকা ও সহায়তাকারীদের নিয়ে  একটি সার্বক্ষণিক ‘চিকিৎসা সেবা দল’ গঠন করা দরকার। স্বেচ্ছাসেবীদেরও এ দলে অর্ন্তভুক্ত করা যায়।

৩. এই দলের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী (পিপিই), ঝুঁকিভাতা, সার্বক্ষণিক পরিবহন সুবিধা, খাবার এবং আলাদা থাকার ব্যবস্থা (প্রয়োজনে যেকোনো হোটেলে) রাখতে হবে। সরকারের উচিত অন্যান্য রোগীদের জন্য কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতালে আইসিইউ এর ব্যবস্থা করে দেওয়া।

৪. এখনই সিলেটের ২-৩টি বেসরকারি হাসপাতালকে করোনা রোগীদের জন্য প্রস্তুত করা-যেগুলোতে আইসিইউ সুবিধা রয়েছে। 

৫. জেলার বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে যে পরিমাণ ভেন্টিলেটর আছে তার অর্ধেক সাধারণ রোগীদের জন্য  রেখে বাকিগুলো করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসায় ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। এগুলো করোনা চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত হাসপাতালে এনে স্থাপন করা জরুরি।

৬. সিলেটে করোনা পরীক্ষা শুরু হয়েছে মাত্র। এখন প্রয়োজন যত বেশি পরীক্ষা করা যায় তা নিশ্চিত করা। কারণ দ্রুত বেশি সংখ্যক মানুষকে পরীক্ষার আওতায় আনতে না পারলে প্রকৃত চিত্র বুঝা যাবে না। তাছাড়া সন্দেহজনক যে কারো হোম কোয়ারেন্টিন, প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিন এমন কি হাসপাতালে পর্যবেক্ষণ নিশ্চিত করার জরুরি। 

৭. করোনা মোকাবেলায় আগামী তিন সপ্তাহ কঠোরভাবে লকডাউন থাকা বাঞ্চনীয়। বিশেষ জরুরি সেবা ছাড়া এই সময় লকডাউন মেনে চলতে বাধ্য করাতে হবে।

করোনা যেভাবে গোটা বিশ্বে হানা দিচ্ছে তাতে করে আমাদের দেশে আরও অনেক কিছুই করা উচিত নিশ্চয়ই। কিন্তু আমাদের বাস্তবতা অনুধাবন করতে হবে। সুতরাং যে বিষয়গুলো না করলেই নয় সেগুলো আগে নিশ্চিত করা জরুরি। আমি মনে করি, উপরে উল্লেখিত বিষয়গুলো শিগগির বাস্তবায়ন করা দরকার।

আমরা মনে করি, এখনো আমাদের হাতে সময় আছে। বাঁচার উপায় আছে। এই উপায়টি হচ্ছে অন্যান্য সচেতনতার পাশাপাশি করোনা রোগীর উপযোগী হাসপাতাল ও চিকিৎসা সেবা প্রস্তুত রাখা। আর এই প্রস্তুত রাখার জন্য চিকিৎসকদের প্রণোদনাসহ রোগীবান্ধব হাসপাতালের বিকল্প নেই।

 

আসুন দ্রুত আমরা সিদ্ধান্ত নিই। দ্রুত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করি। আমাদের মনে রাখতে হবে, আমাদের যেকোনো গাফিলতি কিংবা ভুল সিদ্ধান্ত করুণ বিপর্যয় ডেকে আনবে। আশা করি আমরা সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে এই পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে পারব। আমরা আমাদের প্রজন্মকে রক্ষা করতে পারব।