Cinque Terre

অজয় কৃষ্ণ পাল

১৩ জুলাই , ২০২০


সহকারী শিক্ষক (আইসিটি)

ছাতক সরকারি বহুমুখী মডেল উচ্চ বিদ্যালয়


করোনাকালে অনলাইন স্কুল

একটি জাতির উন্নতির চাবিকাঠি হলো শিক্ষা। মেধা ও মননে আধুনিক এবং চিন্তা চেতনায় প্রাগ্রসর একটি সুশিক্ষিত জাতিই একটি দেশকে উন্নতির শিখরে পৌঁছে দিতে পারে। তাই শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড। আমাদের কোনো শিক্ষার্থীর জীবনকে একটি উদ্দেশ্যহীন পথে আমরা ঠেলে দিতে পারি না।

প্রত্যেক শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবনের মূল্যবান সময়ের ব্যবহার যথাযথভাবে বুঝিয়ে দিতে হবে। জোর জবরদস্তি করে শিক্ষাদান নয়, শিশুদের শিক্ষার পরিবেশ, পাঠদান পদ্ধতি ও বিষয়বস্তু আকর্ষণীয় ও আনন্দময় করে তুলতে হবে।

শিক্ষাক্ষেত্রে করোনা ভাইরাস (কোভিড-১৯) কেবল সাময়িক প্রভাবই ফেলেনি, এটি সৃষ্টি করেছে শিখনের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি। বিভিন্ন মিডিয়া, পত্রিকায় প্রকাশিত শিক্ষাবিদদের প্রবন্ধ থেকে জানা যায় ইউনেস্কোর তথ্যানুযায়ী বিদ্যালয় বন্ধ থাকার কারণে বিশ্বে একশ বাহাত্তর কোটি পঞ্চাশ লাখ শিক্ষার্থী শিখন বঞ্চিত হচ্ছে। বাংলাদেশের সব পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো ১৭মার্চ থেকে বন্ধ আছে। প্রায় চার কোটি শিক্ষার্থী শিখন ক্ষতির সম্মুখীন। এই শিখন ক্ষতি প্রকৃতপক্ষে জাতির যেকোনো ক্ষতির চেয়ে ভয়াবহ, এর প্রভাব দীর্ঘমেয়াদি। সঠিক ব্যবস্থা না নিলে দীর্ঘ মেয়াদে আমাদের চরম মূল্য দিতে হবে।

শিক্ষার্থীরা তাদের শিখন কার্যক্রম সম্পন্ন করে শ্রেণিকক্ষে। কিন্তু করোনাকালীন সময়ে এই শ্রেণিকক্ষের শিক্ষা তথা বিদ্যালয়ের শিক্ষা কঠিন চ্যালঞ্জের মুখে পড়েছে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে শিখন ক্ষতির আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। শিক্ষার্থীদের নতুন শিক্ষাবর্ষ তিনমাস পূর্ণ না হতেই প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলো বন্ধ

হয়ে যায়। এরই মধ্যে আগামী ৬ আগষ্ট পর্যন্ত বিদ্যালয়ের শ্রেণি কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। প্রথম আড়াই মাসে শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষে যা শিখেছিল দীর্ঘ বন্ধে তারও অনেক কিছু ভুলে গেছে। দীর্ঘদিন বিদ্যালয়ে না যাওয়ায় অনেকেরই পড়ালেখার ছন্দপতন ঘটেছে। এমন পরিস্থিতিতে আমরা

কেউই প্রস্তুত ছিলাম না। সর্বোপরি এ অবস্থায় আমাদের করণীয় কী তারও সঠিক দিক নির্দেশনা পাওয়া যাচ্ছে না। এ কারণে কাউকে কোনরূপ দোষ দেওয়া ঠিক হবে না। কারণ করোনার এ পরিস্থিতির সঙ্গে আমরা কেউ-ই পরিচিত নয়।

করোনা আঘাত এনেছে বারো লাখ এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার্থীদের উপর। তারা মানসিকভাবে তৈরি হয়েছিল পরীক্ষা দেবার জন্য। ১ এপ্রিল ছিল তাদের পরীক্ষা। পরীক্ষার জন্য তারা যেভাবে প্রস্তুতি নিয়েছিল তাতে ছেদ পড়েছে। পরীক্ষা কবে হবে সেই অনিশ্চয়তা তাদের মানসিকভাবে অস্থির করে তুলেছে।

বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েও সব ধরণের শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। ফলে শিক্ষার্থীরা সেশনজটে পড়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে যা শিক্ষার্থীদের পরবর্তীতে বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি করবে। করোনায় সৃষ্টি হয়েছে এসএসসি পরীক্ষার্থীদের ভর্তি অনিশ্চয়তা। শিক্ষার্থীরা কী করবে এখনও বুঝতে পারছে না। পহেলা জুলাই থেকে তাদের পুরোদমে ক্লাস করার কথা। কিন্তু করোনার জন্য দীর্ঘদিন শিক্ষার্থীরা বাসায় এক ধরনের বন্দি অবস্থায় আছে। করোনা তাদেরকে বাসায় বন্দি থাকতে বাধ্য করেছে। ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে মানসিক অস্থিরতার সৃষ্টি হয়েছে এবং স্বাভাবিক বেড়ে উঠাকে বাধাগ্রস্থ করছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীরা না যাওয়ার ফলে তাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর বড় রকমের প্রভাব ফেলেছে। বিশেষ করে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিক্ষার্থীরা এ অবস্থায় বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। করোনাকালীন সময়ে সরকার পড়াশুনা চালিয়ে যাবার জন্য বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। বিকল্প শিক্ষণ হিসাবে সংসদ টেলিভিশনের মাধ্যমে পাঠদানের ব্যবস্থা করেছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, বিদ্যালয়েও অনলাইনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের ক্লাস চালিয়ে যাবার নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু এভাবে ১০০% শিক্ষার্থীর নিকট পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে না। আর আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে এ কার্যক্রম এগিয়ে নেওয়া বেশ কষ্টসাধ্য ও চ্যালেঞ্জিং। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে। অধিকাংশেরই ভালো স্মার্টফোন নেই, তার সঙ্গে নেই উচ্চ মূল্যের ইন্টারনেট প্যাকেজ। আর দুর্বল নেটওয়ার্কের কারণে অনেক শিক্ষার্থীই পাঠে অংশগ্রহণ করতে পারে না। ফলে শিখন কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া বেশ কষ্টসাধ্য। ফলে শহরের তুলনায় গ্রামের শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে পড়ছে। এ অবস্থার পরিবর্তনের জন্য দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা আবশ্যক।

করোনা যে এ অবস্থা সৃষ্টি করবে তার জন্য আমরা মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। অনলাইন স্কুল পরিচালনার জন্য যে দক্ষতা প্রয়োজন হয় সেই পরিমাণ দক্ষ শিক্ষক আমাদের প্রতিটি বিদ্যালয়ে নেই। তাই অনলাইনে কীভাবে অনলাইন স্কুল পরিচালনা করতে হয় তার ওপর একটি ট্রেনিংয়ের আয়োজন করে উপজেলাভিত্তিক ক্লাসের আয়োজন করলে শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণ বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। করোনাকালীন শিখন ক্ষতি মেনে নিতেই হবে। জীবনের চেয়ে কোনো কিছুই অগ্রাধিকার পেতে পারে না। তবে যতটুকু ক্ষতির পরিমাণ কমানো যায় সেটাই বিবেচ্য।