লিখন নাথ
১৭ জুলাই , ২০২০
শিক্ষার্থী, তাল্লিন, এস্তোনিয়া
এস্তোনিয়াতে এসেছিলাম অনেকটা সাজানো গোছানো সবকিছু ছেড়ে। বাবা-মা, ভাই-বোন, আত্বীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সবকিছু ছেড়ে অজানা এক পথে পা বাড়িয়েছিলাম। কোথায় যাব? কোথায় থাকব? কি খাব? কি হবে ভবিষ্যতে? কিছুই জানা ছিল না। তারপরও ছুটে চলা আকাশ পথে। পকেটে ছিল দেশ থেকে ঋণ করে আনা কিছু টাকা। অনেক লম্বা একটা পথ পাড়ি দিয়ে তাল্লিন এয়ারপোর্টে অবতরণ করলাম। বিমান থেকে নামার পর মনে হচ্ছিল, এই আমি কোথায় এলাম? কেন এলাম? আর দেশের জন্য, সবার জন্য এতোটা টান কখনো অনুভব করিনি। মনে হচ্ছিল আবার সঙ্গে সঙ্গে দেশে চলে যাই। ভেতরটা হু হু করছিল।
এখানে আমার পরিচিত তেমন কেউ ছিল না। থাকা খাওয়ার জায়গা ছিল না। এক প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির হোস্টলে গিয়ে ম্যানেজারকে অনেক অনুরোধ করার পর আমাকে থাকতে দিল ওই হোস্টেলে তিন দিন। কিন্তু তিন দিন পর যাব কোথায়? এই তিন দিনের মধ্যে আবার অনেক খুঁজলাম থাকার জায়গা। পেলাম না। পরে আবার ম্যানেজারকে অনুরোধ করে বললাম যে, আমার থাকার জায়গা নাই। যাওয়ার মতো কোন জায়গাও নাই। (ম্যানেজার সদয় হয়ে থাকতে দিলো তিন মাস) এক কক্ষে থাকতাম আমরা চারজন। আমার কক্ষসঙ্গীরা ছিল নাইজেরিয়ান, পাকিস্তানি এবং ইন্ডিয়ান। চারজন এক কক্ষে কখনো থাকিনি। অনেকটাই অসুবিধা হচ্ছিল। কারণ দেশে আমার থাকার জন্য আলাদা কক্ষ ছিল। আমি একাই এক কক্ষে থাকতাম। তাছাড়া এর আগে পরিবার ছাড়া কোথাও থাকো হয়নি। যাইহোক, ঈশ্বররের কৃপায়, সবার আশীর্বাদে কিছু দিন পর টাকা উপার্জন করার উপায় পেলাম। একটা কাজও পেলাম। কিছু দিনের মধ্যেই ঋণ করে আনা টাকা ফেরত দিলাম। এর কিছুদিন পর আমার ইউনিভার্সিটির হোস্টেল পেলাম। চলে গেলাম আমার ইউনিভার্সিটির হোস্টেলে। এক কক্ষে থাকতাম আমরা দুইজন। আর আজকে সৃষ্টিকর্তার দয়ায় যার থাকার জায়গাই ছিল না, সেই আমি একাই এক কক্ষে শুয়ে আছি। আজকে ১১ মাস পর মনে হচ্ছে আমি আমার দেশের বাসার থাকার কক্ষ ফেরত পেয়েছি। (গরংংরহম সু ংবিবঃ ৎড়ড়স, ৮৮, কঁধৎঢ়ধৎ , ঝুষযবঃ)
এই করোনাকালেও আজকে আমার কাজ আছে, থাকার মতো জায়গা আছে, অনেক কিছুই আছে। অথচ ১১ মাস আগে এই দেশে আমার কিছুই ছিল না। এই যে ভাল থাকা এর পেছনে যে কারণ আমি অনুভব করি, তা হলো অবশ্যই ইশ্বরের কৃপা। আমার বাবা মায়ের আশীর্বাদ, সবার দোয়া ও ভালোবাসা যা আমি সব সময় দূর থেকে অনুভব করতে পারি।
আমি সব সময় একটা জিনিস চাই সেটা হলো সামর্থ্যরে মধ্যে থেকে কাউকে হেল্প করা। যে কারণে হয়তো আমি যে জায়গায়ই যাইনা কেন কেউ না কেউ আমিও পাই, যে আমাকে হেল্প করার জন্য আগে থেকে বসে থাকে। আরেকটি হলো, আমি কাউকে কোনদিন জেনেশুনে ঠকানোর চিন্তাও করি না। এমন কেউই নাই যে বলতে পারবে আমার কারণে তার বিন্দু পরিমান এক টাকার হলেও ক্ষতি হয়েছে। যে জন্য হয়তো আমার চারিদিকে এমন কোন মানুষ থাকে না, যে আমাকে ঠকাবে। আজকে ১১ মাস পর বলব, ঈশ্বর আমাকে অনেক অনেক ভাল রাখছেন। সামনের দিনগুলগুলোর জন্য সবার দোয়া ও ভালোবাসা কামনা করি।
যাঁদের সাহায্য সহযোগিতায় আজকে আমি ‘ভাল আছি’ বলতে পারি, তাদের কাছে সব সময় কৃতজ্ঞ। এই দুঃসময় কেটে যাক। পৃথিবী করোনামুক্ত হোক। ভাল থাকুক সবাই। ভাল থাকুক পৃথিবী।