Cinque Terre

উজ্জ্বল মেহেদী

১৫ নভেম্বর , ২০২০


সাংবাদিক


স্মৃতির জার্নাল : ‘এক স্টেডিয়াম শোক’

২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর। মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় স্ত্রী-সন্তানসহ নিহত হন সুনামগঞ্জ পৌরসভার তৎকালীন তিন বারের চেয়ারম্যান, মরমি কবি হাসন রাজার প্রপৌত্র কবি মমিনুল মউজদীন। তাঁর অকালমৃত্যু স্মরণে ওই বছরের ৮ ডিসেম্বর সুনামগঞ্জ জেলা স্টেডিয়ামে সর্বদলীয় নাগরিক শোকসভা হয়েছিল। গণপরিসরের সেই শোকসভায় যোগ দিয়েছিলেন জাতীয় নেতারাও। তাদের দেওয়া ভাষণ সংকলিত করে ‘এক স্টেডিয়াম শোক’ নামে ভাষণ পরিক্রমার একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেছে ‘মাহদীয়া ক্রিয়েশন’ নামের একটি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান। ১৫ নভেম্বর কবি মমিনুল মউজীদনের ১৩ তম মৃত্যুবার্ষিকীকে সামনে রেখে এ কাজে হাত দেওযা। সুনামগঞ্জ জেলা স্টেডিয়ামে ২০০৭ সালের ৮ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত সর্বদলীয় নাগরিক শোকসভায় সভাপতিত্ব করেছিলেন প্রয়াত গণমানুষের নেতা বরুণ রায়। গণফোরাম নেতা ড. কামাল হোসেন, প্রয়াত জাতীয় নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ও দেওয়ান ফরিদ গাজী, সাবেক মন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, সাংসদ রাশেদ খান মেনন, সাংসদ হাসানুল হক ইনু, সাংসদ আসাদুজ্জামান নূর, সাংসদ সুলতান মনসুর, সাংবাদিক পীর হাবিবুর রহমানসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, সাংবাদিক ও লেখকেরা অংশ নিয়েছিলেন শোকসভায়। ‘এক স্টেডিয়াম শোক’ নামের ভাষণ পরিক্রমার প্রথম পর্বে প্রয়াত সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের ভাষণের ওপর নির্মিত তথ্যচিত্র।

২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর ঢাকা থেকে সুনামগঞ্জ ফেরার পথে ব্রাম্মণবাড়িয়ার সরাইলের নিকট মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনাটি ঘটেছিল। এতে মমিনুল মউজদীন, তাঁর স্ত্রী তাহেরা চৌধুরী ও ছোট ছেলে কহলিল জিবরান ও গাড়িচালক কবির মিয়া ঘটনাস্থলে নিহত হন। গুরুতর আহত হয়েছলেন মমিনুল মউজদীনের বড় ছেলে ফিদেল নাহিয়ান। সিঙ্গাপুরে দীর্ঘদিন চিকিৎসার পর তিনি সুস্থ হন।

সুনামগঞ্জ পৌরসভায় এক টানা তিন বার চেয়ারম্যান থাকাকালে মমিনুল মউজদীন ছিলেন দলনিরপেক্ষ জনপ্রতিনিধিত্বের প্রবর্তক একজন রাজনীতিবিদ। প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলোর নেতা-কর্মীদের নিয়ে তাঁর নেতৃত্বে গঠিত হয়েছিল ‘গণঐক্য’ নামের সর্বদলীয় এক রাজনৈতিক মোর্চা। দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলন, নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, মাদকবিরোধী সামজিক আন্দোলনসহ সৃজনশীল নানা কর্মযজ্ঞে দেশে ও বিদেশে তিনি এক নামে পরিচিত ছিলেন।

পৌর চেয়ারম্যান থাকাকালে মমিনুল মউজদীন প্রায় দেড় দশক জোছনা রাতে সুনামগঞ্জ পৌর শহরের সব স্ট্রিট লাইটের বাতি নিভিয়ে বিদ্যুৎ সাশ্রয় করতেন। তাঁর এই উদ্যোগটি তখন দারুণভাবে প্রশংসিত হয়েছিল। এ জন্য তিনি জোছনাবাদী কবি-জনপ্রতিনিধি বলে আখ্যায়িত হয়েছিলেন। ‘এ শহর ছেড়ে পালাব কোথায়’ ও ‘হৃদয় ভাঙার শব্দ’ নামে দুটো কাব্যগ্রন্থ রয়েছে তাঁর।

সুনামগঞ্জে স্টেডিয়ামে নাগরিক শোকসভায উপস্থিত হওয়া জাতীয় নেতাদের ভাষণের অডিও রেকর্ড থেকে একটি প্রকাশনার কাজ করছিলাম। চৈতন্য প্রকাশন মুদ্রণ কাজটি করার কথা। আগামী বইমেলার জন্য কাজ, তাই ঢিমেতালেই করছিলাম। এরই মধ্যে প্রয়াত জাতীয় নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের ভাষণ শুনে কাজটি বিস্তৃত রূপে করার ইচ্ছা জাগ্রত হলো। বইয়ের সঙ্গে ভাষণ-পরিক্রমাও রাখতে চাই। দুদিনের প্রস্তুতিতে চূড়ান্ত রূপ দিলেন শিল্পী অরূপ বাউল। যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশি সাংবাদিক আ স ম মাসুম তার তথ্যচিত্রের ফুটেজ ব্যবহারের অনুমতি দিলেন।

শুরুটা তাড়াহুড়ো করে হলেও ভাটির প্রবাদ প্রসিদ্ধ রাজনীতিবিদ সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের উচ্চকিত সেই কণ্ঠ শোনার অতৃপ্তি ঘুচবে নিশ্চিত। সেই সময়ের আবেগ আর আপ্লুত হওয়ার সময়ক্ষণ দেখার সাক্ষী ছিলাম। তাই পুরো এই কাজটির নাম দিয়েছি ‘এক স্টেডিয়াম শোক’। 

আবার আমরা আরেকটি মউজদীন তৈরি করব : সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত

‘সময় নাই, সময় আছে পাঁচ মিনিট। কথা অনেক। ১৫ তারিখে গোটা বাংলাদেশে সিডরের আক্রমনে বাংলার দক্ষিনাঞ্চল লন্ডভণ্ড হয়ে গেছে। বরগুনায় আমি একবার নয়, দুই-দুইবার গিয়েছি আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে। নিরন্ন হাহাকারওয়ালা মানুষ. সে তাণ্ডব দেখে সহ্য করা যায় না। আর আজকে একই ১৫ তারিখের তা-বে সুনামগঞ্জের মানুষের হৃদয় ছিন্ন বিচ্ছিন্ন বিদীর্ণ হয়ে গেছে। আমাদের মউজদীনের এই অকাল প্রয়াণ আমরা কেউ তৈরি ছিলাম না। এই মৃত্যুকে কেউ গ্রহণ করেনি, আমরাও নই। কিন্তু সুনামগঞ্জবাসী, আমরা বাস করি দেখার হাওরের পারে, সুরমা নদীর পারে, আমরা বাস করি খাসিয়া-জৈন্তা পাহাড়ের পারে। মউজদীন কেবল জন্মায়নি মউজদীনের জন্ম দিয়েছেন কেবল আপনারা। মউজদীনের অনুপ্রাণ, মউজদীনের আদর্শ সৃষ্টি করেছে সুনামগঞ্জের মানুষ। আমরাই যারা মউজদীন তৈরি করেছি, আজ সুনামগঞ্জের মানুষকে প্রতিজ্ঞা করতে হবে হাজার হাজার মউজদীন আমাদের সৃষ্টি করতে হবে। আগামী ভবিষ্যতের জন্যে আলোর পর আলো জ্বালিয়ে আমরা সুনামগঞ্জের সমস্ত অন্ধকার দূর করে দেব। ইতোমধ্যে আমরা ও আওয়ামী লীগের সভাপতি, যিনি আজীবন বাংলাদেশের মানুষের পাশে থেকে আজীবন রাজনীতি করেছেন, আমার বন্ধু আবদুজ জহুর, তাঁকে হারিয়েছি। জহুর সাহেব যিনি আমাদের এমপি ছিলেন, আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন, তাঁর শোকসভা আমরা করতে পারিনি। আমরা আরেকজন অনিরাপদ সড়কের কারণে তাহিরপুরের চেয়ারম্যান, তাঁকেও আমরা হারিয়েছি। জয়নাল মিয়া, আমরা হারিয়েছি অনেক। আপনারা এই সুনামগঞ্জের মানুষ এককালে জন্ম দিয়েছিলেন করুণা সিন্ধু রায়। সুনামগঞ্জের মানুষ আজকের সভাপতি বরুণ রায়কে জন্ম দিয়েছেন। জন্ম দিয়েছিলেন আনোয়ার রাজা, হেসেন বখত, আলফাত মোক্তারসহ অনেক বিপ্লবী নেতাকে। আমাদের উত্তারাধিকার সততার উত্তরাধিকার, আমাদের উত্তরাধিকার আবেগের উত্তরাধিকার। আমাদের উত্তরাধিকার সততা নিষ্ঠা ও দেশপ্রেমের উত্তরাধিকার। জেনে যান জাতীয় নেতৃবৃন্দ, মউজদীন একদিনে সৃষ্টি হয়নি। তিলে তিলে আমাদের পাজর কেটে কেটে আমরা তৈরি করেছি। আমরা আবার জেগে ওঠব, আবার আমরা দাঁড়াব, আবার আমরা সৃষ্টি করব। এখানে আমরা অসাম্প্রদায়িক শহরকে, অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে, সততার চেতনাকে আমরা রক্ষা করব। সুতরাং আজ আমরা যাঁদের হারিয়েছি, আমরা মুক্তিযোদ্ধা নেককে হারিয়েছি। হারিয়েছি অনেক নেতৃবৃন্দকে। সবাইকে নিংড়িয়ে আজকের এই যুবক মউজদীনকে আমরা হারিয়েছি। এর বেদনা, এর ক্ষত আমাদের অনেক বেশি।

সুনামগঞ্জবাসী, আমার জীবনে আমি অনেক সভা দেখেছি। অনেক সভার অনেক মিছিলে আমাকে থাকতে হয়েছে। সুনামগঞ্জ আমার জন্মের শহর, সুনামগঞ্জ আমার স্বপ্নের শহর, সুনামগঞ্জ আমার কবিতার শহর। সুনামগঞ্জ অন্ধকার দূর করার শহর। সুনামগঞ্জে এই রকম ব্যতিক্রমধর্মী সভা আমি আর কখনো দেখিনি। সুতরাং আজকের এই সভা থেকেই আমাদের এগিয়ে যাওয়ার শপথ নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। আমি দেখে এসেছি দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ, তাঁরাও ঘুরে দাঁড়িয়েছে। ছয়জন-সাতজন-আটজন করে একেক পরিবারে মৃত্যু হয়েছে। তারপরে বলেছে বাবা আমাদের চাল দাও, তারপরে বলেছে বাবা আমাদের নৌকা দাও, হাল দাও আমরা আবারও দাঁড়াব। আজকে সুনামগঞ্জের মানুষ অকাল মৃত্যু বলীদান হিসেবে আবার আমরা শপথ নেই, আমরা একদিন মউজদীনকে তৈরি করেছি। আবার আমরা আরেকটি মউজদীন তৈরি করব। যুগে যুগে মউজদীন আসবে-যাবে, কিন্তু নির্মাতা হিসেবে এই শহরের মানুষ, এই জেলার মানুষ সুনামগঞ্জ ভাটি বাংলা আজ ফাইবারপাস। সুনামগঞ্জ ভাটি বাংলার যে লোকসংগীতের আসর এটি হাসন রাজা-রাধারমণ থেকে শুরু করে নির্মলেন্দু চৌধুরী, শাহ আবদুল করিমসহ মরমি কবি ও লোক সংগীতের সংস্কৃতির শহর। এই শহরের মানুষ কালচারড, সংস্কৃত। এই শহরের মানুষ মিথ্যাকে মিথ্যা বলতে পারে। এই শহরের মানুষ সত্যকে সত্য বলার সাহিসকতা আছে। একইভাবে সুনামগঞ্জের ভাটি বাংলার প্রত্যেকটি মানুষ, সেটা দিরাই-শাল্লাই হোক, সেটা ছাতক-দোয়ারাবাজারই হোক, সেটা জগন্নাথপুর-দক্ষিণ সুনামগঞ্জই হোক, আর সেটা তাহিরপুর-ধরমপাশা-মধ্যনগর আর জামালগঞ্জই হোক, আমরা সকলেই মিলেই সুনামগঞ্জ। সকলেই মিলেই আলফাত মোক্তার, সকলে মিলেই আমরা হোসেন বখত, সকলেই মিলেই বরুণ রায়।

জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু। আমার বক্তব্য এখানেই শেষ করছি। মউজদীনের স্মৃতি অমর হোক।’

(ভাষণের স্থায়িত্ব ৫ মিনিট ৩৪ সেকেন্ড। ৮ ডিসেম্বর, ২০০৭, সুনামগঞ্জ স্টেডিয়াম)।