গোলাম রব্বানী চৌধুরী
১৯ অক্টোবর , ২০২৫
ব্যবসায়ী ও বিশ্লেষক
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাস্টমস গোডাউনে ১৮ অক্টোবর শনিবার ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। যা জাতীয় পর্যায়ে গভীর উদ্বেগের জন্ম দেয়। বিমানবন্দরের ‘কার্গো ভিলেজ’ এলাকায় এ অগ্নিকাণ্ড কেবল অবকাঠামোগত ক্ষতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না; এটি দেশের অর্থনীতি, জাতীয় নিরাপত্তা এবং আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তিতেও বড় ধরনের প্রভাব ফেলেছে। প্রশ্ন উঠেছে— এটি কি নিছক দুর্ঘটনা, নাকি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত একটি নাশকতা?
কার্গো ভিলেজে অবস্থিত একাধিক গুদামে আমদানি ও রপ্তানিকৃত পণ্য সংরক্ষণ করা হয়। ঘটনার দিন বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে একটি কুরিয়ার গুদাম থেকে আগুনের সূত্রপাত ঘটে, যা দ্রুত আশপাশের এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। ফায়ার সার্ভিসের ৩৭টি ইউনিট, বিমানবাহিনী এবং অন্যান্য সংস্থার যৌথ প্রচেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে কয়েক ঘণ্টা সময় লেগে যায়। এর মধ্যে বিপুল পরিমাণ মূল্যবান পণ্য পুড়ে ছাই হয়ে যায়।
লেখকের পূর্বের কলাম- সিলেট-ঢাকা মহাসড়ক : জনদুর্ভোগে প্রান্তিক জনগণ |
সরকারিভাবে অগ্নিকাণ্ডের নির্দিষ্ট কারণ এখনো প্রকাশিত হয়নি। তবে বিভিন্ন সূত্র ও সংবাদমাধ্যমে উঠে আসা তথ্যের ভিত্তিতে সম্ভাব্য কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হচ্ছে: বৈদ্যুতিক ত্রুটি বা শর্ট সার্কিট, দাহ্য ও রাসায়নিক দ্রব্যের অনিরাপদ সংরক্ষণ, অব্যবস্থাপনা, দুর্বল নিরাপত্তা ও পরিকল্পিত নাশকতা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, কার্গো ভিলেজে প্লাস্টিক, টেক্সটাইল এবং বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য সংরক্ষিত ছিল, যা আগুনকে দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে সহায়তা করে এবং নিয়ন্ত্রণকে কঠিন করে তোলে।
দুর্ঘটনা না পরিকল্পনা?— বিশ্লেষণ:
পক্ষে (দুর্ঘটনার সম্ভাবনা): অতীতে বাংলাদেশে গার্মেন্টস কারখানা, মার্কেট এবং অন্যান্য বাণিজ্যিক স্থাপনায় অনিচ্ছাকৃত অগ্নিকাণ্ডের নজির রয়েছে। বৈদ্যুতিক ব্যবস্থার ত্রুটি এবং অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার দুর্বলতা অনেক সময় দুর্ঘটনার জন্ম দেয়। বিমানবন্দরের মতো উচ্চচাপের পরিবেশে নিরাপত্তা অবহেলা নতুন কিছু নয়।
বিপক্ষে (পরিকল্পিত কর্মকাণ্ডের ইঙ্গিত): ঘটনাস্থলটি দেশের গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক কেন্দ্র হওয়ায় এটি কাকতালীয় মনে হয় না। আগুনের গতিবেগ এবং সংরক্ষিত দাহ্য উপকরণের ধরন সন্দেহের জন্ম দেয়।বিগত কয়েক মাসে একাধিক শিল্প এলাকায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে, যা একটি সুস্পষ্ট প্যাটার্ন নির্দেশ করতে পারে। আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে দিতে দেশের প্রধান রপ্তানিমুখী খাতকে লক্ষ্য করে পরিকল্পিত নাশকতার আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
এই অগ্নিকাণ্ডে দেশের গুরুত্বপূর্ণ আমদানি ও রপ্তানি পণ্য ধ্বংস হয়েছে, যা সরাসরি বৈদেশিক বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। বিমানবন্দর-ভিত্তিক লজিস্টিক ও কার্গো অপারেশন ব্যাহত হওয়ায় অর্থনৈতিক প্রবাহে বড় ধরনের বিঘ্ন ঘটেছে।
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে ঘটনাটি গুরুত্বের সঙ্গে প্রচারিত হওয়ায় বিদেশি ব্যবসায়ীদের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে পোশাক শিল্প সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলো আশঙ্কা প্রকাশ করেছে যে, বিদেশি ক্রেতাদের আস্থা দুর্বল হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
সরকারি পদক্ষেপ: অর্থ মন্ত্রণালয় একটি পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করেছে, যারা ঘটনার প্রকৃত কারণ, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এবং ভবিষ্যৎ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন দেবে। পাশাপাশি, কাস্টমস এবং কার্গো এলাকায় বিদ্যমান অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
ঢাকা বিমানবন্দরের কাস্টমস গোডাউনে অগ্নিকাণ্ড নিছক একটি দুর্ঘটনা নাকি সুপরিকল্পিত নাশকতা— তা এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে বাস্তবতা হলো, প্রশাসনিক অব্যবস্থাপনা ও নিরাপত্তার দুর্বলতা এই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তিকে উৎসাহিত করছে। তাই স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও পেশাদার তদন্তের মাধ্যমে ঘটনার প্রকৃত উৎস খুঁজে বের করা এবং ভবিষ্যতের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ এখন সময়ের দাবি।
সুপারিশসমূহ: নিরপেক্ষ তদন্ত: আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ও স্বাধীন তদন্ত কমিটির মাধ্যমে ঘটনার প্রকৃত কারণ নির্ধারণ।নিরাপত্তা জোরদার: কাস্টমস ও কার্গো অঞ্চলে আধুনিক অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা ও পর্যবেক্ষণ প্রযুক্তি স্থাপন।জনবল প্রশিক্ষণ: সংশ্লিষ্ট কর্মীদের জন্য নিয়মিত নিরাপত্তা প্রশিক্ষণ ও মহড়া চালু রাখা। নীতি বাস্তবায়ন: বিমানবন্দর ও রপ্তানিমুখী স্থাপনাগুলোর জন্য ‘ক্রিটিক্যাল ইনফ্রাস্ট্রাকচার সিকিউরিটি নীতি’ প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন।আন্তর্জাতিক আস্থা পুনঃস্থাপন: কূটনৈতিক ও পেশাদার যোগাযোগের মাধ্যমে বৈদেশিক অংশীদারদের আস্থা ফিরিয়ে আনা।
এএফ/০৬