Cinque Terre

শাহ ফখরুজ্জামান

০৩ ফেব্রুয়ারী , ২০২১


আইনজীবী ও সাংবাদিক


প্রধানমন্ত্রীর প্রণোদনা প্যাকেজ : প্রান্তিক ক্ষতিগ্রস্তরা বঞ্চিত কেন?

করোনাভাইরাস পরিস্থিতি সারাবিশ্বে যেভাবে প্রভাব ফেলেছে, স্থবির করে দিয়েছে সব। বড় বড় অর্থনীতি ভেঙে পড়েছে। সেই দুর্যোগ বাংলাদেশে তুলনা মূলক কিছুই করতে পারেনি। বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা ঘুরেছে ঠিক উল্টো দিকে। তা সম্ভব হয়েছে শুধু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্ব এবং তার গৃহীত বিভিন্ন কৌশলে। এরমধ্যে  দুর্যোগ মোকাবিলায় তাৎক্ষণিক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ১,০৩,০০০ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা অন্যতম উদ্যোগ। এই প্যাকেজ ঘোষণার পরও আমাদের রেকর্ড পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ হয়েছে। রেমিটেন্স প্রবাহের গতি দ্রæতগতিতে বেড়েছে। বেড়েছে রপ্তানি আয়ও। আবার বেড়েছে মাথাপিচু আয়ও। অর্থনীতির এই অগ্রগতিতে অবাক সারাবিশ্ব। দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের সঙ্গে আমাদের এই অগ্রগতি নিয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে নিয়মিতই আলোচনা হচ্ছে।

করোনার প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য প্রধানমন্ত্রী ৪ শতাংশ সুদে ২০ হাজার কোটি টাকার জন্য প্রণোদনা ঘোষণা করেছেন। ডিসেম্বরের মধ্যে এ প্রণোদনা বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা দিয়ে বিভিন্ন ব্যাংক ও অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। এর আগে প্রত্যেক ব্যাংক ও অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানকে এই ২০ হাজার কোটি টাকা ভাগ করে দেওয়া হয়। আবার স্ব স্ব ব্যাংক তাদের শাখার মাধ্যমে এই লক্ষ্যমাত্রা ভাগ করে নেয়। বাংলাদেশ ব্যাংক তদারক হিসেবে নিবিড়ভাবে নজর রাখছে কার্যক্রমে। বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগে এই প্যাকেজের অগ্রগতি নিয়ে আয়োজন করা  দুটি ভার্চ্যুয়াল মিটিংয়ে গণমাধ্যমকর্মী হিসেবে অংশ নেওয়ার সুযোগ হয় আমার। এ মিটিং থেকে এবং বিভিন্ন ব্যাংকে থাকা আমার ঘনিষ্টজনদের কাছ থেকে আলোচনা করে প্রণোদনা প্যাকেজ সম্পর্কে কিছু আশার খবর পেলেও পেয়েছি অনেক হতাশার তথ্যও। এ ব্যাপারে পর্যবেক্ষণ তুলে ধরার জন্যই  মূলত এ লেখা।

করোণার প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের জন্য ৪ শতাংশ সুদে প্রধানমন্ত্রী ২০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করলেও ডিসেম্বরের শেষ নাগাদ বিতরণ হয় মাত্র সাত হাজার কোটি টাকা। অথচ ডিসেম্বরেই এ ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। এরমধ্যে হবিগঞ্জের অনেক ব্যাংক লক্ষ্যমাত্রা অর্জন দূরে থাক কোনো টাকাই বিতরণ করেনি। এরপরও এ ঋণ বিতরণে সিলেট বিভাগে হবিগঞ্জ জেলা ছিল শীর্ষে! তাহলে বিভাগের অন্যান্য জেলার চিত্র সহজেই অনুমেয়। আবার কেউ কেউ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অধিক পরিমাণ ঋণ বিতরণ করে বিশেষ কৃতিত্বও প্রদর্শন করেছে। প্রণোদনার এই ঋণ বিতরণে ১৫ শতাংশ নারী উদ্যোক্তাকে দেওয়ার কথা বলা হলেও এ শর্তও পূরণ হয়নি। চুনারুঘাট উপজেলার একজন আলোচিত নারী উদ্যোক্তা ব্যাংকে দৌড়াদৌড়ি এবং সব শর্ত পূরণ করার পরও পাননি এ ঋণ। বাংলাদেশ ব্যাংক পরবর্তীতে যারা লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারেনি তাদের জন্য মার্চ পর্যন্ত সময় বাড়িয়েছে। তবে এ যারা ঋণ পেয়েছেন, তা এবং ঋণের পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। কয়েকটি বিষয়ের জন্যই  মূলত নির্ধারিত সময়ে প্রণোদনার টাকা ব্যবহার সম্ভব হয়নি।

আমার পরিচিত এক উদ্যোক্তা লন্ডন অ্যাগ্রো ফার্মের মালিক মাওলানা লুৎফুর রহমান তার হতাশার কথা আমাকে জানালেন। করোনা ও বন্যায় তার ফিশারি ও ডেইরি ফার্মের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বিভিন্ন ব্যাংকে প্রণোদনা প্যাকেজের ঋণ পাওয়ার জন্য অনেক চেষ্টা করেও পাননি। তার মতো আরও অনেক ক্ষতিগ্রস্ত উদ্যোক্তা সরকারের এ সুবিধা থেকে বঞ্চিত। শুধু পরিচিত উদ্যোক্তারাই এ সুবিধা পেয়েছেন। অনেকে আবার একাধিক ব্যাংক থেকেও ঋণ পেয়েছেন।

বৈশ্বিক করোনা মহামারির কারণে বিশ্বের সব দেশের ব্যবসায়ীই ক্ষতিগ্রস্ত। কার্যত লকডাউন তথা সাধারণ ছুটি ঘোষণা হওয়ার পর ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সব ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকাÐ কয়েক মাস প্রায় স্থবির হয়ে পড়ে। সব শ্রেণির ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। এরমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর করোনার ধাক্কা কাটিয়ে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর ঘুরে দাঁড়ানোর যে প্রচেষ্টা, তা থেকে বাদ পড়েছে হোটেল-রেস্তোরাঁ, মুদির দোকান, খুচরা-পাইকারি দোকান, মিষ্টির দোকান, সেলুন, মার্কেট ও বিপণি বিতানের ছোট ব্যবসায়ীরা। অথচ দেশে এই খাতে প্রায় ২০ লাখ ব্যবসায়ী রয়েছেন। তাদের যেমন প্রণোদনার আওতায় আনা হয়নি, তেমনিভাবে তাদের এ প্রণোদনা আদায় করার মতো ডকুমেন্টসও নেই। এ নিয়ে অনেক দেনদরবার হওয়ার পর নীতি নির্ধারণী পর্যায় থেকে অনেক আশারা বাণী শোনা গেলেও বাস্তবে তেমন কার্যক্রম আমাদের চোখে পড়েনি।

ব্যবসা ও শিল্পের জন্য একজন উদ্যোক্তা ঋণের পেছনে ছুটে বেড়ান। সেখানে মাত্র ৪ শতাংশ সুদে ঋণ পাওয়া ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের জন্য বড় প্রাপ্তি হলেও এখানে যে পদ্ধতি দেওয়া হয়েছে, তা হলো ঋণ পাওয়ার পরই পরবর্তী মাস থেকে ১২ মাসের মধ্যে আসল ও সুদের টাকা কিস্তিতে ফেরত দেওয়া। এ শর্ত থাকায় কোনো ব্যবসায়ী বা উদ্যোক্তা ঋণ নিয়ে ক্ষতি কাটিয়ে লাভের মুখ দেখার আগেই পড়ে যাবেন কিস্তি দেওয়ার যন্ত্রণায়। এমনকি এ অল্প সময়ে পরিবর্তনের কোনো সুযোগ নাও আসতে পারে। ফলে যারা ঋণ নিয়েছেন, তাদের অনেককেই ভোগান্তিতে পড়তে হতে পারে। এ ভয়ে অনেকে চাইছেনও না এ ঋণ।

সরকারের উদ্দেশ্য ছিল প্রান্তিক ক্ষতিগ্রস্তদের টিকিয়ে রাখা। কিন্তু ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ঋণ আদায়ের নিরাপত্তার স্বার্থে এ ধরনের ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের ঋণ দিতে সাহস করছে না। আবার প্রান্তিক পর্যায়ের ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের ঋণ গ্রহণের জন্য যে পেপার ওয়ার্ক প্রয়োজন, তা না থাকায় ঋণ নিতে পারছেন না অনেকে। যারা এ প্রণোদনার ঋণ নিয়েছেন, তাদের অধিকাংশই নিয়মিত ঋণ গ্রহীতা। ফলে তাদের পেপার ওয়ার্ক আগে থেকেই প্রস্তুত থাকায় সহজেই ঋণ নিতে পেরেছেন। কেউ কেউ একাধিক ব্যাংক থেকেও নিয়েছেন। তাদের ব্যবসা এমনিতেও চাঙ্গা থাকায় এ ঋণ নিয়ে তাদের অবস্থার আরও উন্নতি হচ্ছে। ব্যাংকগুলোও এ ধরনের ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাকে ঋণ দিয়ে নিরাপদে কিস্তি আদায় করতে পারছে। ফলে যেটা হয়েছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না, তেলা মাথায় তেল দেওয়ার মতো। অথচ প্রান্তিক ও প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তরা বেকায়দায় থেকে ব্যবসা ছেড়ে দিচ্ছেন বা ব্যবসা হারিয়েছেন। চলতে না পেরে অনেকেই শহর ছেড়ে গ্রামে চলে গেছেন। যদিও শহরে উদ্যোক্তারা শুধু উৎপাদনই করেন না, তারা কর্মসংস্থানও সৃষ্টি করেন।

এ পর্যবেক্ষণ থেকে আমার পরামর্শ থাকবে প্রধানমন্ত্রীর এ প্রণোদনা প্যাকেজ যেন করোনার কারণে অধিক ঝুঁকিতে পড়ে যাওয়া প্রান্তিক ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তারা পায় সেদিকে নজর দেওয়া। পাশাপাশি ঋণ আদায়ের সময় এক বছর না করে সেটিকে আরও বড় মেয়াদে করা। ব্যাংকগুলো যেন রক্ষণশীলতা এড়িয়ে প্রান্তিক ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তার পাশে দাঁড়ায়, তা নিশ্চিত করতে হবে। ট্রেডিং-এর চেয়ে যেন উৎপাদকরা বেশি ঋণ পান সেদিকেও বিশেষ নজর দিতে হবে। মূলত এ প্রণোদনা যদি খাদের কিনারে থাকা কোনো ব্যবসায়ী বা উদ্যোক্তাকে ঘুরে দাঁড়ানোর পথ দেখাতে পারে, তাহলেই প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগ সফল হবে।