Cinque Terre

মোস্তফা সেলিম

১১ এপ্রিল , ২০২১


গবেষক ও প্রাবন্ধিক


অনন্তলোকে ভালো থাকুন শাহরিয়ার ভাই

বেশ ক’বছর আগে সাংবাদিক মকবুল হোসেন চৌধুরী স্মারক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়, এই সুত্রে বরেণ্য সাংবাদিক হাসান শাহরিয়ার এবং সালেহ চৌধুরীর সাথে আমার ভাব হয়, ক্রমেই সখ্য গড়ে ওঠে দুজনের সঙ্গে। বইটির প্রস্তুতির কাজে ঘনঘন দুজন আসতেন আমার অফিসে। এই মূল্যবান গ্রন্থের সম্পাদক সালেহ চৌধুরী। মকবুল হোসেন চৌধুরী হাসান শাহরিয়ারের পিতা, একারণে স্বপ্রণোদিত হয়ে একাজে তাঁর ছিল যুক্ততা। বিরাট গোফবিশিষ্ঠ সালেহ চৌধুরী দুর্দান্ত সাংবাদিক। মজলিসি একটা স্বভাবগত বৈশিষ্ঠ্য ছিল তাঁর আচরণে। ভরাট কণ্ঠস্বরের অধিকারী সালেহ চৌধুরী ছিলেন অনন্য কথক। এই গুণেই সম্ভবত তিনি তাঁর বয়সের তুলনায় অনেক ছোটো কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদের আড্ডা-আসরের নিয়মিত ছিলেন। এই গ্রন্থটার কাজ করতে করতে, চা-নাস্তা, খানাপিনায় অবসরে আমি দুই বনেদি মানুষকে আবিস্কার করি। স্বীকার করি, এর আগে এমন উচুমানের বনেদি স্বভারের মানুষের সঙ্গে আমার কোনো প্রত্যেক্ষ যোগাযোগ ছিল না। তাঁদের মতো এমন সুরসিক এবং কেতাদুরস্ত মানুষ সচরাচর খুঁজে পাওয়া মুশকিল। শাহরিয়ার ভাই লেবাসে, চেহারায় ধূপধূরস্ত। সেই তুলনায় সালেহ ভাই ছিলেন একটু আলুথালু। শাহরিয়ারভাই এবং সালেহ চৌধুুরীর সঙ্গে এই শুরু। তারপরও সম্পর্ক যে কখন নিবিড় বন্ধনে আটকে গেলো তা এখন আর মনে নেই। সালেহভাই কয়েক বছর আগে মারা গেলেন ক্যান্সারে। 

হাসান শাহরিয়ার হয়ে ওঠলেন আমার একান্ত আপনজন, আশ্রয়-প্রশ্রয়ের ভরসা। কারণে-অকারণে তাঁর সঙ্গ পেতে আমার মন উতলা হয়ে থাকে। শাহরিয়ারভাইও সাড়া দিতেন সানন্দে। আড্ডা পর আড্ডা চলত, দিনের পর দিন। তখন তাঁর কোনও বই বের হয়নি। আমার ওখানে আড্ডা দিতে দিতে তিনি বই প্রকাশের জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠলেন। শুরু হল তাঁর বই প্রকাশ। বেরুল তাঁর প্রবন্ধের বই অতীত, অতীত নয়। তারপর  নিউজ উইকে বাংলাদেশ : মুক্তিযুদ্ধ, বিজয় ও তারপর। অসাধারণ এক গ্রন্থ, প্রামাণ্যতার এক দলিল। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের অনন্য এক অধ্যায় উন্মোচন করা হয়েছে এই গ্রন্থে। সব ভালো তার শেষ ভালো যার এবং সবশেষ যারে দেখতে নারি তার চলন বাঁকা। বইগুলো প্রকাশের সূত্রে তাঁর সঙ্গে আমার সময় কাটানোর সুযোগ আরও বেড়ে যায়। তিনি সময় পেলেই চলে আসতেন আমার অফিস শাহবাগে। তাঁর কথাবার্তায় বলনে-চলনে তিনি আমাকে মুগ্ধ করে রাখেন। ক্রমেই আমি তাঁর নানা গুণ আবিস্কার করি। প্রাণখোলা, মজলিসি মানুষ। মানুষকে ভালোবাসেন নিঃস্বার্থভাবে। লোভ-লালসা কিংবা স্বার্থবুদ্ধি কোনোটাই তাঁর মধ্যে লক্ষ্য করিনি। প্রতিবছর আড়ম্বর করে তাঁর জন্মদিন পালন করতেন ঢাকা ক্লাবে। দেশের বরেণ্যজনেরা আমন্ত্রিত হয়ে অনুষ্ঠানকে ঝলমলে করে তুলতেন। তারকা সাংবাদিক এবং শিল্প সাহিত্যের মানুষের পাশাপাশি রাজনীতিবিদেরাও আসতেন। আমাকে প্রতিবছর দাওয়াত করতেন। এখানেও শিক্ষা নেওয়ার ছিল আমার, তিনি অনুষ্ঠানের ৬ মাস আগে আমন্ত্রণ জানাতেন। মাসখানেক আগে এবং অনুষ্ঠানের নিকটবর্তী সময়ে আরেকবার। এ থেকে বুঝতে কারও সমস্যা থাকে না, তিনি কত আন্তরিক হয়ে আমন্ত্রণ করতেন তাঁর অতিথিকে। আমাকে প্রতিবছর দাওয়াত করলেও আড়ষ্ঠতার কারণে আমি প্রথম দিকের দুটো দাওয়াতে উপস্থিত হইনি। আমাকে জবাবদিহি করতে হয়, আমি তাঁর জেরার মুখে বলি, অনুষ্ঠানের খাওয়া-দাওয়া আমি এড়িয়ে চলি। তিনি বললেন, এসব অনুষ্ঠান কেবল খাওয়া-দাওয়ার বিষয় নয়। এসবে যোগ দিতে হয় সামাজিকতার খাতিরে। জানান, এই যে বিশাল অনুষ্ঠান তিনি আয়োজন করেন, সেখানে তিনিও কিছুই খাওয়া-দাওয়া করেন না। সামাজিকতাকে কতটা গুরুত্ব দিলে পকেট উজাড় করে তিনি ফি-বছর এই আয়োজন করেন, এটা ভাবলে তাঁর মহত্বের প্রতি অবনত হয় মস্তক। 

তিনি খাওয়াতে ভালোবাসতেন। সুনামগঞ্জের হাওরের বড় মাছটি যখন তাঁর বাসায় আসতো তিন একা খেতেন না, ডাক পড়ত আমাদের। তাঁর এই বনেদি ভাবটি তিনি পেয়েছিলেন পারিবারিক সূত্রে। তাঁর পিতা মকবুল হোসেন চৌধুরী ছিলেন আসাম প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য। বরেণ্য এই রাজনীতিবিদ বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন সংবাদপত্র যুগভেরীর প্রতিষ্ঠা সম্পাদক। এক অভিজাত পরিবারের এই চিরকুমার সদস্যটি তাই জীবনের শেষদিন পর্যন্ত ছিলেন রাজপুত্রের মতো বড় হৃদয়ের মানুষ। বাংলাদেশের সংবাদপত্র জগতে যে কজন মানুষ প্রজ্ঞায়, সততায়, গুণে নিষ্ঠায় ছিলেন সুুপারস্টার হাসান শাহরিয়ার তাঁদের একজন। কাজ করেছেন নিউজ উইক থেকে খালিসস্থান টাইমে। জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি যেমন নির্বাচিত হয়েছেন তেমনি নির্বাচিত হয়েছিলেন কমনওয়েলথ জার্নালিস্ট এসোসিয়েশসের সভাপতিও। এই অনুকরণীয় ব্যক্তিত্বের হাসান শাহরিয়ার বিগত কয়েকবছর থেকে ক্যান্সারের সাথে যুদ্ধ করে বেঁচেছিলেন। শেষতক, করোনা তাঁকে কেড়ে নিল আমাদের থেকে। 

শাহরিয়ারভাই জরাকেও জয় করেছেন হাসিমুখে। তিনি যে ক্যান্সারের সাথে যুঝে চলেছেন সেটা তিনি কখন কাউকে বুঝতে দিতেন না। হাসিখুশি থেকে তিনি জীবনকে উপভোগ করেছেন, অন্যের জীবনকে আনন্দময় রাখতে চেয়েছেন। নিপাট ভদ্রলোক, উচ্চমানের পেশাজীবী, সততার ভাস্মর ছিল হাসান শাহরিয়ারের জীবন। শাহরিয়ারভাই আমাদেরকে দিয়েছেন অনেক। তিনি সমাজের সাধারণ মানুষ থেকে তাঁর সগোত্রীয় সকল মহলে আন্তরিক শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসায় মূল্যায়ন পেয়েছেন আমৃত্যু। আমি উদ্যোগী হয়ে তাঁর কর্মময় জীবনকে মূল্যায়নের জন্য ২০১৮ সালে প্রকাশ করি হাসান শাহরিয়ার ; সাংবাদিকতায় জীবন্ত কিংবদন্তি গ্রন্থটি। বিশাল আয়তনের এই গ্রন্থটি সম্পাদনা করেছিলেন ড. মীজানুর রহমান শেলী। এই মূল্যায়ন সংকলনে তাঁকে নিয়ে লিখেছেন বিশিষ্টজনেরা। সকলেই তাঁর কৃতি এবং কীর্তির প্রশংসা করেছেন অকুণ্ঠ হয়ে। বাংলা একাডেমি তাঁকে ২০১৮ সালে ফেলোশিপ প্রদান করেছে। এছাড়া তাঁকে আনুষ্ঠানিক আর কোনও সম্মান জানানোর সুযোগ হয়নি সংশ্লিষ্টদের। আমরা আশা করব, সাংবাদিকতায় সামগ্রিক অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে তাঁকে মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত করা হবে। 

ইত্তেফাকের চাকুরি শেষে আর কোথাও তেমন কাজ করেননি শাহরিয়ারভাই। কয়েকবছর আগে তিনি ডেইলি সানে যোগ দিলেও অল্প সময়ের মধ্যে ওই চাকুরি ছেড়ে দিয়েছিলেন। বলতেন, সাংবাদিকেরা অবসরে যায় না, আমৃত্যু তারা কাজ করে, তিনি ব্যতিক্রম। তিনি সুযোগ থাকার পরও অবসরে আছেন। তিনি সাংবাদিকদের অবসর নেওয়ার উদাহরণ তৈরি করেছেন বলে শ্লাঘা করতেন। সেই অবসরের মেয়াদ শেষে তিনি গতকাল আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন অনন্তলোকে। নিশ্চয়ই তিনি সেখানেও ভালো থাকবেন। তাঁর প্রতি রইল গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।