Cinque Terre

মুহম্মদ জাফর ইকবাল

২২ অক্টোবর , ২০২১


জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক, সায়েন্স ফিকশন লেখক ও শিক্ষাবিদ


এই দুঃখ কোথায় রাখি?

কয়দিন থেকে আমার নিজেকে অশুচি মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে আমি বুঝি আকণ্ঠ ক্লেদে নিমজ্জিত হয়ে আছি। শুধু আমি নই, এই দেশে আমার মত অসংখ্য মানুষের একই অনুভ‚তি, মনে হচ্ছে জাতির একটি বড় একটি অংশ বিষন্নতায় ডুবে আছে। 

কারণটি নিশ্চয়ই সবাই বুঝতে পারছে। যে দুর্গাপূজাটি হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় আনন্দোৎসব হওয়ার কথা সেই দুর্গাপূজাটি এবারে সবচেয়ে বড় তাণ্ডবের কেন্দ্রস্থল। আমি যে এটিকে একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে নিজেকে সান্তনা দেব সেটিও করতে পারছি না। কুমিল্লা থেকে শুরু হয়ে এটি শুধু কুমিল্লাতে থেমে থাকেনি, বলতে গেলে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। যার অর্থ সারা দেশের প্রতিটি আনাচে কানাচে ভয়ংকর সাম্প্রপ্রদায়িক মানুষ রয়েছে, তারা লুকিয়ে নেই তারা প্রকাশ্যে আছে, বুক ফুলিয়ে আছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী গত ৯ বছরে এই দেশে ৩৬৮৯ বার হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ওপর হামলা হয়েছে। যারা সংখ্যাটি কতো ভয়ানক অনুভব করতে পারছেন না তাদেরকে অন্যভাবে বলা সম্ভব, এই দেশে গড়ে প্রতিদিন একবার কিংবা তার বেশি দেশের কোথাও না কোথাও হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ওপর হামলা হয়েছে! এটি হচ্ছে প্রকাশিত তথ্যের কথা, প্রকৃত সংখ্যা আসলে আরো অনেক বেশি। এই দেশটি আমরা যেভাবে গড়ে তুলব বলে স্বপ্ন দেখেছিলাম দেশটি সেভাবে গড়ে উঠেনি। এই দেশের শতকরা দশভাগ হিন্দু ধর্মাবলম্বী, যদি তাদের জিজ্ঞেস করা হয় তারা কেমন আছেন, তাদের কেউ কী বলবেন যে তারা ভালো আছেন? একটা দেশ কেমন চলছে সেটা বোঝার সবচেয়ে সহজ উপায় হচ্ছে সেই দেশের সংখ্যালঘুদের জিজ্ঞেস করা তারা কেমন আছে। তারা যদি বলে ভালো নেই তাহলে বুঝতে হবে দেশটি ভালো নেই। 

সেজন্য আসলে আমরাও ভালো নেই। আমি কয়দিন থেকে আমার হিন্দু ধর্মাবলম্বী বন্ধুদের সাথে কথা বলতে সাহস পাচ্ছি না। তীব্র এক ধরনের লজ্জা এবং অপরাধবোধে ভুগছি। সাম্প্রতিক ঘটনার কারণে এই বিষয়টি নূতন করে সবার সামনে এসেছে, কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে এটি প্রথমবার হয়েছে, কিংবা এটি পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন ঘটনা কিংবা কেউ কেউ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এটি হঠাৎ করে ফেলেছে। এই ভয়ংকর সাম্প্রদায়িকতা এখানে বহুদিন থেকে শিকড় গেড়েছে, আমরা কেউ কেউ নিজেদের মিথ্যা সান্তনা দিয়ে এর অস্তিত্ব অস্বীকার করার চেষ্টা করছি, কেউ কেউ এটাকে খাটো করে দেখার চেষ্টা করেছি। কিন্তু আমরা যে আসলে আকণ্ঠ ক্লেদে নিমজ্জিত, কেন আমরা সেই সত্য অস্বীকার করার চেষ্টা করি? কেন ভান করি সবকিছু ঠিক ঠিক চলছে? বিষয়টির একটু গভীরে গেলেই আমরা টের পাই সবকিছু ঠিক ঠিক চলছে না। যে দুর্গাপূজায় একটি হিন্দু শিশুর আনন্দে আত্মহারা থাকার কথা কেন সেই দুর্গাপূজায় শিশুটির বুকে ভয়ের কাঁপুনি? আমরা কেন এই শিশুদের বুকে আগলে রক্ষা করতে পারি না?


দুই

যখন পূজার সময় আসে, সারা দেশে প্রতিমা তৈরির কাজ শুরু হয় তখন থেকে আমি নিজের ভেতর এক ধরনের চাপা অশান্তি অনুভব করি। অবধারিত ভাবে খবর পাই দেশের এখানে সেখানে সেই প্রতিমা ভেঙ্গে দেওয়া হচ্ছে। যখন পূজা শুরু হয় তখন আমি নিঃশ্বাস বন্ধ করে থাকি, যারা শোলাকিয়া ঈদের জামাতেও বোমা মারতে প্রস্তুত তারা পূজার অনুষ্ঠানে না জানি কী করার চেষ্টা করে। যখন সবকিছু শেষ হয় আমি শান্তির নিঃশ্বাস ফেলি।

আমার মত অতি সাধারণ একজন নাগরিকের ভেতর যদি পুরো ব্যাপারটা নিয়ে এক ধরণের চাপা অশান্তি থাকে তাহলে কী এই দেশের আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর এই সময়টিতে ঘুম নষ্ট হয়ে যাওয়ার কথা নয়? দুঃখটা আমার এখানে, আমি জানি তারা চাইলেই একটা তাÐব থামাতে পারে। আজকাল এই দেশের পুলিশ বাহিনী অনেক করিৎকর্মা, আমার হিসেবে এই বিষয়গুলো তারা আমাদের থেকে আরো অনেক ভালো করে জানে। তাই কুমিল্লার অবাস্তব ষড়যন্ত্রটির খবর ভোর সাতটার সময় পাওয়ার পরও বেলা এগারোটায় তাণ্ডব শুরু হতে দেওয়ার ঘটনাটি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছি না। বিশেষ করে যখন আমরা জানতে পেরেছি ভোরবেলা থেকে ওসি স্বয়ং সেখানে উপস্থিত ছিলেন। এই দেশে আগে অনেকবার এরকম ঘটনা ঘটেছে কাজেই বিষয়গুলো কীভাবে দানা বাঁধে সেটি এখন আর কারও জানতে বাকী নেই। আফগানিস্তানে তালেবানদের বিজয়ের পর এই দেশের ধর্মান্ধ গোষ্ঠি যে নূতন করে উজ্জীবিত হয়ে আছে সেটি তো কারো অজানা নয়। পাকিস্তান, আফগানিস্তানে শুক্রবারে জুম্মার নামাজে বোমা হামলা প্রায় নিয়মিত ঘটনা। আমাদের দেশেও কোনো একটা ধর্মান্ধ ষড়যন্ত্র দানা বাঁধলেও যে শুক্রবার জুম্মার নামাজের পর তার একটা শো-ডাউন হয় সেটাও তো আমরা বহুকাল থেকে দেখে এসেছি। কমন সেন্সের এতোগুলো বিষয় আমরা সবাই জানি কিন্তু আইন শৃঙ্খলা বাহিনী জানে না, এবং সেভাবে প্রস্তুতি নিতে পারে না এটা আমরা কীভাবে বিশ্বাস করি? হতদরিদ্র একজন জেলের সহায় সম্পদ সবকিছু পুড়ে নিঃস্ব হয়ে যাওয়ার পর রাষ্ট্র যদি নূতন করে তার ঘরবাড়ি তৈরি করেও দেয়, তারপরেও কী তার বুকের ভেতরের যে আতংক, হতাশা, দুঃখ, কষ্ট এবং অসহায় অভিমানের জন্ম হয় আমরা কী তার এক বিন্দুও দূর করতে পারব? এই দেশের নাগরিক হয়ে শুধুমাত্র নিজের ধর্মের কারণে তাদের একটি অসহায় আতংকে জীবন কাটাতে হবে সেটি কেমন করে মেনে নেওয়া যায়?

এখানে রাষ্ট্রের অনেক বড় দায়িত্ব, কিন্তু আমরা যখন রাষ্ট্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত বড় বড় রাজনৈতিক নেতাদের বক্তব্য শুনি তখন একধরণের হতাশা অনুভব করি। কিছু একটা ঘটলেই তারা চোখ বন্ধ করে মুহূর্তের মাঝে বিরোধী রাজনৈতিক দলের উপর দোষ চাপিয়ে ঝাড়া হাত পা হয়ে যান। যদি এর মাঝে সত্যতা থাকেও তাদের এই ঢালাও রাজনৈতিক বক্তব্যের কারণে সেটি তার নিজের দলের মানুষও আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করে বলে মনে হয় না। সাধারণ মানুষ তখন অনুমান করে নেয় রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রনেতারা এই সমস্যা সমাধানের জন্য আন্তরিক নয়, হয়তো তারা এটাকে একটা রাজনৈতিক ইস্যু হিসেবে দেখিয়ে তার থেকে কোনো একটা সুবিধা নিতে চান। অথচ মূল কথাটি খুবই সহজ, কেন এটি ঘটেছে তার খুব ভালো একটা ব্যাখ্যা জেনে কোনো লাভ নেই, ঘটনাটি না ঘটলে অনেক লাভ আছে।

একটা সমস্যা সমাধান করতে হলে সবার আগে মেনে নিতে হয় যে, সমস্যাটা আছে। তারপর সমস্যাটা বুঝতে হয় তাহলে নিজ থেকেই সমস্যা সমাধানের পথ বের হয়ে যায়। আমরা যদি সমস্যাটাই অস্বীকার করি তাহলে সেটা সমাধান করব কেমন করে? কিছু দুর্বৃত্ত হঠাৎ করে এটা করে ফেলেছে বললে সমস্যাটাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া হয়। সেই দুর্বৃত্তরা যে এখানে তাদের কাজকর্মের জন্য একটা অভয়ারণ্য পেয়েছে সেটি তো সবার আগে স্বীকার করে নিতে হবে। 

এই সরকার মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার, স্বাভাবিকভাবেই তাদের উপর আমাদের দাবী অনেক বেশি। হেফাজতের হুমকি শুনে পাঠ্যবইয়ের সাম্প্রদায়িক পরিবর্তন আমাদের চরমভাবে হতাশ করেছিল, কাজেই দেশের এই সাম্প্রদায়িক রূপটিকে ঠিক করার ব্যাপারে তাদের কতোটুকু সদিচ্ছা আছে সেটা নিয়ে আমাদের কারো কারো ভেতরে যদি এক ধরনের দুর্ভাবনা থাকে কে আমাদের দোষ দিতে পারবে?


তিন

আমি আজন্ম আশাবাদী মানুষ। জীবনের চরম দুঃসময়েও আশায় বুক বেঁধে অপেক্ষা করেছি এবং দেখেছি একদিন আমার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। কাজেই এবারেও আমি আশাবাদী থাকতে চাই, স্বপ্ন দেখতে চাই যে এই দেশটি থেকে সাম্প্রদায়িকতার বিষবৃক্ষকে একদিন শিকড়-সহ উৎপাটন করে ফেলা হবে। তবে এটি এমনি এমনি শুধু মুখের কথায় হবে না, তার জন্য কাজ করতে হবে। আমার হিসেবে বাংলাদেশের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এখন এটি। 

আমি আমার জীবনে যে কয়টি সত্য আবিষ্কার করেছি তার একটি হচ্ছে পৃথিবীর সৌন্দর্য হচ্ছে বৈচিত্র্যে। একটি দেশে যখন নানা বর্ণের, নানা কালচারের, নানা ধর্মের, নানা ভাষার মানুষ পাশাপাশি থাকে, একে অন্যের সাহচর্যে সুখে দুঃখে বড় হয় সেটি হচ্ছে সত্যিকারের সৌন্দর্যময় জীবন। আমাদের দেশের মানুষের মাঝে বৈচিত্র্য খুব কম, কাজেই আমাদের জীবনধারায় যেটুকু বৈচিত্র্য আছে সেটাই আমাদের বুক আগলে রক্ষা করতে হবে, আমাদের শিশুদের সেটা শিখাতে হবে। নিজ ধর্মের বিধি বিধান শেখার আগে তাদের অন্য ধর্মের সৌন্দর্য্যরে কথা জানতে হবে যেন তারা সকল ধর্মের জন্য এক ধরনের শ্রদ্ধাবোধ নিয়ে বড় হয়। 

এই দেশের মানুষ ঐতিহ্যগতভাবে উগ্র মানসিকতার মানুষ নয়, জীবনের কোনো ক্ষেত্রেই তারা বাড়াবাড়ি পছন্দ করে না। সারা পৃথিবীর ধর্মান্ধতার উত্থানের ঢেউ এখানেও এসেছে এবং কিছু মানুষ সেটি ব্যবহার করার চেষ্টা করেছে। ফেসবুক নামে ‘মানসিক বর্জ্য ক্লেদ সংরক্ষণ ও বিতরণ’-এর যে পদ্ধতি বের হয়েছে সেটি ব্যবহার করে যেটি আগে কখনও সম্ভব হয়নি এখন সেটিও করে ফেলা যাচ্ছে। যে মানুষটির কথাকে আগে বিন্দুমাত্র গুরুত্ব দেওয়ার সুযোগ ছিল না, এখন সেই মানুষটি তার ভয়ানক আপত্তিকর বক্তব্য সবাইকে শোনাতে পারছে, শুধু তাই নয় দ্রæততম সময়ে দুর্বৃত্তদের একত্র করে একটা অঘটন ঘটিয়ে ফেলছে। শুধু বাংলাদেশে নয়, সারা পৃথিবীতেই এটি অনেক বড় একটি সমস্যা। পৃথিবীর অন্য দেশ কী করবে জানি না, কিন্তু আমাদের দেশে আমাদের প্রয়োজনে এর একটা সমাধান এখন খুব দরকার। শুধু তাই নয়, এক সময় যেকোনো সা¤প্রদায়িক সমস্যা হলে সব রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক সংগঠন, ছাত্র-ছাত্রী শিক্ষক পথে নেমে আসতো, এখন সবাই ফেসবুকে একটা বক্তব্য দিয়ে তারা তাদের দায়িত্ব শেষ করে ফেলতে চায়।

আমরা যখন ছোট ছিলাম, তখন এ দেশের গ্রামে গ্রামে যেটুকু সংস্কৃতির চর্চা ছিল এখন সেটি নেই। বাসায় বাসায় হারমোনিয়ামে শিশুর গলায় গান শোনা যায় না, রাত জেগে কেউ যাত্রা কিংবা পালা গান শুনতে যায় না। মাঝ নদী থেকে মাঝির গলায় ভাটিয়ালি গান শুনি না, স্কুলে স্কুলে কিংবা পাড়ার ছেলেমেয়েরা হ্যাজাক লাইটের আলোকে জরির কাপড় পরে সিরাজদ্দৌলার নাটক করে না। মাঠে রঙ্গীন জার্সি পরে তুমুল উত্তেজনায় ফুটবল খেলা হয় না। নদীতে নৌকা বাইচ হয় না। বাউল হওয়া এখন অনেক সময় অপরাধ, তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়। এক কথায় আমরা আগে যেটুক বাঙালি ছিলাম এখন আমরা আর সেই বাঙালি নেই। আমাদের সাংস্কৃতির জগতে যে শুন্যতা তৈরি হয়েছে সেই শুন্যতা দ্রæত পূরণ করতে আসছে ধর্মান্ধ গোষ্ঠি।

কাজেই এখন ভাবনা চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিয়ে আবার আমাদের বাঙালি হওয়ার সময় এসেছে। একসময় বাঙালি হয়ে আমরা আমাদের ভাষাটিকে পেয়েছিলাম, তারপর আবার বাঙালি হয়ে আমাদের দেশটিকে পেয়েছিলাম। এখন আবার বাঙালি হয়ে সেই দেশকে অসাম্প্রদায়িক করার সময় এসেছে।

ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল : শিক্ষাবিদ ও লেখক