Cinque Terre

আহমেদ নূর

২৬ অক্টোবর , ২০২৫


সম্পাদক

সিলেট মিরর


সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : একজন বিরল মানুষের প্রস্থান


অবেলায়, অকস্মাৎ চলে গেলেন তিনি। এই সময়ে, এই বয়সে এখন কেউ এভাবে হুট করে চলে যায়! কিছু কিছু মানুষ আছেন যারা বৈরী পরিবেশে অবস্থান করেও নিজের অনন্য ব্যক্তিত্বের গুণে নিজেকে অন্য সবার থেকে আলাদা করে ফেলতে পারেন। শুধু আলাদাই যে করেন তা নয়, নিজেকে শ্রদ্ধার আসনেও আসীন করতে পারেন। সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম এমনই এক বিরল মানুষ। 

সেই অনন্যসাধারণ মানুষটি এমনই এক সময়ে আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন যখন তাঁর মতো একজন ব্যক্তিত্বের প্রয়োজন ছিল। সামনে অনেক কাজ। এই সময়ে, এই বয়সে চিরতরে তাঁর চলে যাওয়াটা আমাদের জন্য খুবই বেদনাদায়ক ঘটনা। তাঁর বয়স হয়েছিল মাত্র ৭৪ বছর। দেশবরেণ্য কথাসাহিত্যিক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম গত ১০ অক্টোবর আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন, এটি বিশ্বাস করতেও কষ্ট হচ্ছে।

তাঁর সাথে আমার সম্পর্ক ছিল বহুমাত্রিক। লেখক-পাঠকের সম্পর্কের বাইরে জন্মভূমি সিলেটের সম্পর্ক ছিল বড়। আমার সমসাময়িক সবার কাছে তিনি ছিলেন ‘মনজুর স্যার’। আমার ‘মনজুর ভাই’। ছোটভাইয়ের আসনে ঠাঁই দিয়ে ‘ভাই’ ডাকার এই অধিকার তিনিই দিয়েছিলেন। তারপরও আড্ডায় ভাই ডাকলেও জনসমক্ষে তাঁকে স্যারই ডাকতাম। এই ‘ভাই’ ও ‘স্যার’ মিলেই তাঁর সাথে আমার সম্পর্কের রসায়ন। 

মাস চারেক আগে বলেছিলেন-‘নূর শিগগির সিলেট আসব। তোমাকে আগে জানাব। সময় দিতে হবে। অনেকক্ষণ কথা হবে।’ এরপর বেশ কদিন দীর্ঘ সময় ফোনে কথা হয়। অনেক প্রসঙ্গ। দেশ-সমাজ, ব্যক্তি ভাবনা। আমি শুধু শুনি। অল্পকথায় উত্তর দিই। কিছু কথা ছিল সময়ের জন্য স্পর্শকাতর। বলি, সামনাসামনি কথা হবে। তিনি রাজি হন। কিন্তু আমাদের আর কথা হলো না। বড় অসময়ে তিনি চলে গেলেন। তিনি ছেলেন সিলেটের কৃতী সন্তান,  যাঁকে নিয়ে সিলেটবাসীর গর্বের কোনো শেষ ছিল না। 

প্রায় দু-সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও তাঁকে নিয়ে কিছু লিখতে না পারার যন্ত্রণাটা কেবলই বাড়ছিল। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতেই এই বিক্ষিপ্ত পঙ্ক্তিমালা। 


এক.

সিলেটে এলে সবসময় আগেই জানিয়ে রাখতেন। আসতেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজে। কখনও শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, কখনও মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটি কিংবা সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির একাডেমিক বিষয়াদি নিয়ে। সারাদিন তিনি ব্যস্ত থাকতেন। কিন্তু সন্ধ্যার পর অফুরান সময়। সিলেটে তাঁর বাল্যবন্ধু (তিনি এই শব্দই ব্যবহার করতেন) নাট্যজন নিজামউদ্দিন লস্কর ময়না (তিনি অনেক আগেই এভাবে হুট করে চলে গেছেন) আমরা আড্ডায় বসতাম। ময়নাভাইও পণ্ডিত ব্যক্তি ছিলেন। আমি নীরব শ্রোতা। বিশ্বসাহিত্য থেকে শুরু বাংলা সাহিত্যের গতিধারা এমনকি সিলেট নিয়ে আলোচনা হতো। সময় ফুরিয়ে যেত কিন্ত আমাদের আড্ডা শেষ হতো না। 

এক-এগারো কিংবা ওয়ান-ইলেভেন নামে পরিচিত সরকারের আমলে রাষ্ট্রযন্ত্রের নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়েছিলাম আমি। দীর্ঘ পাঁচ মাস আমাকে কারাভোগ করতে হয়েছে। সেই সময়ের ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে আমি একটি পাণ্ডুলিপি তৈরি করেছিলাম। মনজুরভাই সব জানতেন। ২০১৪ সালে এই পাণ্ডলিপি বই আকারে প্রকাশ করতে চাইলাম। আগ্রহের বিষয়টি তাঁকে জানালাম। তিনি বললেন, ‘অপেক্ষা করো নূর, দেশের পরিস্থিতি বুঝে সিদ্ধান্ত নেবে।’ কিন্তু দেশ ‘দেশের মতোই’ থাকল। ২০১৫ সালে তাঁকে আবারও বললাম, বইটি কি বের করব? বললেন বের করে ফেলো। জানতে চাইলাম বইটির ভূমিকা কি তিনি লিখবেন। শুধু একটি বাক্যই বললেন, ‘ইটস মাই প্রিভিলেজ’। আমি অবাক বিস্ময়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে রইলাম। তিনি বললেন, ‘তোমার পাণ্ডুলিপিটি আমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঠিকানায় কুরিয়ারে পাঠিয়ে দিও। আমি তা-ই করলাম। তিনি হাতে পেয়েই ফোন দিয়ে প্রাপ্তি সংবাদ জানালেন। কয়েকদিন পর ফোন দিয়ে বলেন, ‘নূর, তোমার বইয়ের ভূমিকা ইমেইলে পাঠিয়ে দিয়েছি। ‘কারাভোগের কড়চা’ নামে ভূমিকা দেখে আমার চোখ চড়ক গাছ। বুঝতে পারলাম পুরো পাণ্ডুলিপিটি তিনি গভীর মনোযোগের সঙ্গে পড়েছেন। যে কেউ সেটি পড়লেই বুঝতে পারবেন। অবশেষে আমার সেই গ্রন্থটি ‘ওয়ান-ইলেভেন: কারারুদ্ধ দিনগুলো’ নামে বের হলো। আমার বিশ্বাস সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের ভূমিকা পড়েই পাঠকরা বইটির প্রতি আগ্রহ দেখিয়েছিলেন। যার ফলে তিন মাসের মধ্যে গ্রন্থটির দ্বিতীয় সংস্করণ ছাপতে হয়েছিল। এটা আমার মতো মফস্বলের একজন সংবাদকর্মীর কাছে ছিল অভূতপূর্ব ঘটনা। 



দুই.

সিলেট মিরর। সিলেটের একটি আঞ্চলিক দৈনিক। ২০১৮ সালে পত্রিকাটির পথচলা শুরু। পত্রিকাটির সম্পাদক আমি। সিলেটের সংবাদপত্র জগতে কিছু নতুন করার প্রত্যয়ে এক ঝাঁক তরুণ সাংবাদিকদের নিয়ে পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়। সিলেট মিরর পাঠকদের মাঝে সাড়া জাগায়। আমাদেরও দায়বোধ বাড়ে। আকাক্সক্ষা বাড়ে। ২০১৯ সালেই একটি ঈদ সংখ্যা বের করার উদ্যোগ নিই। স্যারের সাথে আলাপ করি। তিনি উৎসাহ দেন। তিনি তো লিখবেনই আরও কয়েকজনের লেখাও সংগ্রহ করে দেবেন আশ্বাস দিলেন। দেশ-বিদেশের লেখকদের নিয়ে ঈদসংখ্যাটি বেরিয়েছিল বিশাল কলেবরে। সিলেটের সংবাদপত্রের ইতিহাসে এর আগে এমন সমৃদ্ধ ঈদসংখ্যা বের হয়নি। কিন্তু পরের বছরই অতিমারি করোনা সবকিছু স্তব্ধ করে দিল। দু-বছর পরে আবারও ঈদ সংখ্যা বের করলাম। মনজুরভাই সিলেট এসেছিলেন। নিজেই ফোন দেওয়া শুরু করলেন লেখকদের। একেজনের সাথে কথা বলে লেখা চান আর পরে আমার সাথে কথা বলিয়ে দেন। ২০২২ সালে সেই ঈদ সংখ্যাটিও পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছিল। কিন্তু দেশের অর্থনৈতিক বাস্তবতায় এরকম আয়োজন আর করা সম্ভব হয়নি। তবে মনজুরভাই সবসময় এ নিয়ে নিজের দুঃখবোধ প্রকাশ করতেন। কিছুদিন আগেও বলেছিলেন, ‘নূর সিলেট মিরর ঈদ সংখ্যা বের করতে হবে। আমি সিলেট এলে তোমার সাথে বসে সিদ্ধান্ত নেবো কী করতে হবে। আমার যা করার সব করব। কিন্তু ঈদ সংখ্যা বের করতেই হবে। এটা বন্ধ করা যাবে না।’

তিনি সিলেট এলে আমরা একসাথে বসতাম। কিন্তু সিলেট মিরর অফিসে তিনি একবারই এসেছিলেন। প্রায় দু-ঘণ্টা আমরা কথা বলেছিলাম। এটা ছিল শুধুই আড্ডা। কত কথা, কত বিষয়। বিদেশি সাহিত্য নিয়ে তাঁর লেখার আগ্রহের কথা বলেছিলাম। তিনি বললেন, এখন সময় দিয়ে পেরে উঠছেন না। বলেছিলাম- আত্মস্মৃতি কবে লিখবেন? ঝটপট উত্তর, ‘আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আত্মস্মৃতি আমি লিখব না। তবে সিলেট নিয়ে আমার স্মৃতিকথার চারটি পর্ব অবশ্যই লিখব। সেটা শুরু করেছি।’ জানি না সেই চার পর্ব তিনি লিখে গেছেন কি না। কারণ এর মধ্যে এ নিয়ে তাঁর সাথে কোনো কথা হয়নি। যদি লিখে যান আমি নিশ্চিত এটি হবে সিলেটের এক অমূল্য সম্পদ। 


তিন.

সিলেট আসবেন এবং বলেছিলেন তাঁকে সময় দিতে হবে। কিন্তু কয়েক মাস পেরিয়ে গেলেও তাঁকে হোয়াট্সঅ্যাপে একটা মেসেজ দিয়ে রেখেছিলাম কেন আসছেন না। উত্তরে লিখেছিলেন-‘ইচ্ছা থাকার পরও আপাতত সম্ভব হচ্ছে না। শরীরটা ভালো নেই যতটা ভালো থাকলে ভ্রমণের ধকল গায়ে লাগে না। ডাক্তার বললেন, লং কোভিড। আরো কিছুদিন ভুগতে হবে। সুস্থতা আর শক্তি ফিরলে বেরিয়ে পড়ব। তোমাকে জানাব। অনেক ধন্যবাদ নূর।’ 

প্রসঙ্গত, করোনাকালে তিনি কোভিডে আক্রান্ত হয়েছিলেন। দেশে করোনার প্রকোপ কমে গেলেও বছর খানেক আগে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে ফের করোনা সংক্রমিত হয়েছিলেন।

অপেক্ষায় ছিলাম তিনি হয়ত শিগ্গিরই সিলেট আসবেন। এর মধ্যে বেশ কয়েকদিন কথাও হয়েছে অন্য বিভিন্ন প্রসঙ্গ নিয়ে। আমার কিছু শুভাকাক্সক্ষী আমাকে নিয়ে একটা প্রকাশনা করার উদ্যোগ নিয়েছেন। তাঁর কাছেও একটি লেখা চেয়েছেন। তিনি আমাকে ফোন করে বলেছিলেন লিখবেন। খুশিও হয়েছিলেন। হঠাৎ ২৩ জুন, ২০২৫ সকালে তিনি হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ পাঠালেন‘প্রিয় নূর, শুভ সকাল। লেখাটা আর ৩/৪ দিনের মধ্যে শেষ করে পাঠিয়ে দেব। তোমাকে গ্রেপ্তার করা নিয়ে যে বইটি লিখেছিলে তার কথাও আমি উল্লেখ করতে চাই। ধন্যবাদ।’

ঠিক চার দিন পর ২৭ জুন  মেসেজ পাঠালেন, Please send me your email address. ওইদিনই সন্ধ্যায় আবার মেসেজ Dear Noor, you will get my write up on you from Abdul Hannan, who computer composes my handwritten pages.

কথাগুলো লিখলাম এই কারণে যে, স্যার কতটা সময়ানুবর্তী ছিলেন। যখনই যেকোনো বিষয়ে লেখা চেয়েছি যে সময় বলতেন ঠিক সেই সময়ই পাঠিয়ে দিতেন। এমনকি বলছেন দু-মাস সময় দিতে হবে। দেখা গেছে ঠিকই দু-মাসের মাথায় লেখাটি পেয়ে গেছি। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল ২০২১ সালে সিলেট মিরর-এর বর্ষপূর্তিতে তিনদিনব্যাপী ক্রোড়পত্রের সূচনা করেছিলাম সিলেটের ১০ কৃতী মানুষের জীবন ও কর্ম নিয়ে মূল্যায়ণধর্মী লেখা দিয়ে। এই ১০ জনের একজন ছিলেন সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। 

সিলেট মিরর-এর পথচলা অব্যাহত থাকলে হয়ত আবারও সমৃদ্ধ ঈদ সংখ্যা বের হবে। কিন্তু সেটি দেখতে পারবেন না মনজুরভাই। তাঁর লেখা থাকবে না এটা ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে। আহারে জীবন।


চার.

আমি নিজে একটা বিষয় চর্চা করি প্রায়শই যদি কারও লেখা বা বক্তব্য ভালো লাগে তার চুম্বক অংশ নোট করে রাখি। গত ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে আবু খালেদ পাঠান সাহিত্য পুরস্কার অনুষ্ঠানে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম দীর্ঘ বক্তব্য দেন। বড় অংশ জুড়েই ছিল শিক্ষা। তিনি বলেছিলেন-

‘দেশে শিক্ষার কোনো গুরুত্ব দেখছি না। দেখলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন বাড়ছে, তাদের দাবি মানা হচ্ছে। উপেক্ষিত থাকছে স্কুলের শিক্ষক, প্রাথমিক শিক্ষকদের প্রতি আমাদের নজর দেওয়া উচিৎ। এটা হচ্ছে না- এতে বুঝা যাচ্ছে মৌলিক সংস্কারের চিন্তা নেই। যারা সংস্কারের আলাপ করছে তাদেরও শিক্ষার অভাব আছে।’

...‘আশাবাদ একটি মোমবাতির মতো। একটা মোমবাতি থাকলেই হয়। একটি মোমবাতি দিয়ে অনেকগুলো মোমবাতিতে আলোকপ্রজ্জ্বলন করা যায়। যার হাতে আশাবাদের মোমবাতি আছে তার পক্ষে পুরো দেশকে জাগিয়ে তোলা সম্ভব।’

...‘সংস্কৃতির শিক্ষা আছে, শিক্ষার সংস্কৃতি আছে-এই দুটো সমভাবে এগিয়ে গেলেই দেশ এগিয়ে যাবে।  আমাদের সমাজে নিজের সঙ্গে বিতর্ক প্রয়োজন। আমাদের সেই বিতর্ক নেই, তর্ক আছে। ফলে আগাচ্ছি না, সেই শিক্ষার সংস্কৃতি হারিয়ে যাচ্ছে।’ 

(সূত্র: ডেইলি স্টার অনলাইন, ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৫)

তাঁর মৃত্যুর পর জানলাম, এটাই ছিল তাঁর জীবনে শেষ কোনো অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেওয়া। কী মোক্ষম কথাগুলোই না বলে গেছেন এই গুণী শিক্ষক। যার হাতে আমাদের আশাবাদের মোমবাতিটি ছিল তিনিই যে চলে গেলেন অনন্তলোকে। তাঁর এই চলে যাওয়া আমার জন্য, আমাদের জন্য এক মহাশূন্য শূন্যতা। এখন কে জ্বালাবে আশাবাদের বাতি? কে বলে দেবে এগিয়ে যাওয়ার মূলমন্ত্র? 

এমন আকস্মিক প্রস্থানে আমাদের সুখদুঃখের গল্প বলাও আর হলো না। 

অনন্তলোকে ভালো থাকুন মনজুর স্যার। 



এএফ/০২