Cinque Terre

আহমেদ নূর

২৪ অগাস্ট , ২০২৫


সম্পাদক

সিলেট মিরর


সিলেটে প্রকৃতির কান্না এবার থামবে তো?


কোনটা রেখে কোন প্রসঙ্গকে গুরুত্ব দিয়ে লিখব ভেবে পাচ্ছি না। ব্যাপারটা ‘সর্বাঙ্গে ব্যথা, ওষুধ দেবো কোথা’র মতোই। তবে লেখার শিরোনাম দেখে পাঠকরা ঠিকই বুঝে নেবেন লেখার বিষয়বস্তু। তাই লেখাটি যথাসম্ভব ছোট্ট করেই লেখার চেষ্টা করছি। যাতে যার বা যাদের উদ্দেশে লেখা তাদের ধৈর্যচ্যুতি না ঘটে। কোনো প্রসঙ্গ বাদ পড়লেও পাঠকরা তা বুঝে নেবেন বলে বিশ্বাস।

এক.

এই সিলেটেরই এক গুণী সংগীতশিল্পী সুবীর নন্দীর কণ্ঠে একটি জনপ্রিয় গানের দুটো কলি ছিল এ রকম- 

‘পাহাড়ের কান্না দেখে

তোমরা তাকে ঝরনা বলো

ওই পাহাড়টা বোবা বলেই কিছু বলে না

তোমরা কেন বোঝো না যে

কারো বুকের দুঃখ নিয়ে কাব্য চলে না।’

সিলেটের পাহাড়গুলোর নীরব কান্না গত দুই দশকে কেউ শুনেনি। অনেক পাহাড়-টিলা এখন সমতল ভূমি। সংবাদপত্রে বিভিন্ন সময়ে এসব নিয়ে সচিত্র প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে জেলা প্রশাসন এবং পুলিশ প্রশাসন এমনকি পরিবেশ অধিদপ্তরও নীরব ছিল। টিলা কেটে পুলিশের সামনে দিয়ে ট্রাক ভর্তি মাটি নিয়ে গেলেও পুলিশ অন্ধের ভূমিকায় ছিল। আর পরিবেশ অধিদপ্তরের স্থানীয় কর্তার বক্তব্য ছিল- ‘রাতের বেলা তাদের করার কিছু নেই।’ সম্ভবত কর্তারা মনে করতেন দিনের বেলা প্রকাশ্যে পাহাড়-টিলা কাটা হবে। কী অদ্ভূত যুক্তি! মাঝেমধ্যে লোক দেখানো অভিযান আর কয়েকটা কোদাল আর শ্রমিক আটকেই দায় সেরে তৃপ্তির ঢেকুর তুলেছেন। 


দুই.

শত বছর আগে ১৯১৯ সালে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সিলেট এসেছিলেন। সিলেটের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে এই অঞ্চলকে ‘সুন্দরী শ্রীভূমি’ হিসেবে অখ্যায়িত করে একটি কবিতা লিখেছিলেন। তাঁর কবিতার প্রথম চার লাইন ছিল-

‘মমতাহীন কালস্রোতে 

বাংলার রাষ্ট্রসীমা হতে 

নির্বাসিতা তুমি 

সুন্দরী শ্রীভূমি।’

কবিগুরুর সেই ‘সুন্দরী শ্রীভূমি’ আজ আর নেই। পাহাড়-টিলা নেই, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নেই, খাল-বিল, দিঘীও নেই। সম্প্রতি কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার পর্যটনকেন্দ্র সাদাপাথর ব্যাপকভাবে লুটপাট হয়েছে। একইসঙ্গে লুটপাট হয়েছে অন্য পাথর কোয়ারিগুলোতেও। এরপর সরকারের টনক নড়েছে। সিলেটের ডিসিকে ওএসডি করে নতুন ডিসি পদায়ন করা হয়েছে। দুদক একটি প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদন দিয়েছে। চূড়ান্ত প্রতিবেদনে হয়ত পাথর লুটের একটা সত্যিকার চিত্র পাওয়া যাবে। অনেক রাঘববোয়াল বাইরে রয়ে গেছেন। সাংবাদিকরাও নাকি সম্পৃক্ত আছেন। এই মহৎ পেশার জন্য এরচেয়ে লজ্জার কী হতে পারে। আশা করি কর্তৃপক্ষ তাদের মুখোশও উন্মোচন করবেন। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগও একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। এগুলো আশার কথা। কিন্তু এসব তদন্ত প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখবে তো?  অন্তর্বর্তী সরকারের তো কাউকে খুশি করে চলার কথা নয়। তাই আশাবাদী এবার কিছু একটা হলে হতেও পারে। কারণ অতীত অভিজ্ঞতা সুখকর নয় বলেই কথাটি বলতে হলো। 

সিলেটের নতুন জেলা প্রশাসককে ধন্যবাদ। কর্মস্থলে যোগ দিয়েই তিনি ছুটে গেছেন সাদাপাথরের কান্না শুনতে। এর আগেই তিনি বলেছেন, ‘প্রকৃতিকন্যা সিলেট যেন প্রকৃতির মতোই থাকে।’ (সূত্র: সিলেট মিরর, ২২ আগস্ট ২০২৫)। একইদিন তিনি কোম্পানীগঞ্জে তিনটি ক্রাশার মিলে অভিযান চালান এবং সেখানে থাকা পাথর জব্দ করার নির্দেশ দেন স্থানীয় প্রশাসনকে। এসময় জেলা প্রশাসক হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, ‘আর একটি পাথরও যদি সরানো হয়, জীবন ঝালাপালা করে দেবো। বাংলাদেশ সীমানার যেখানেই পাথর সরানোর চেষ্টা হবে, সেখান থেকেই অপরাধীদের ধরে আনা হবে।’ (সূত্র: প্রথম আলো অনলাইন ভার্সন, ২১ আগস্ট, ২০২৫)।

সত্যি বলতে কী দুর্বৃত্তদের (সব ধরনের) দৌরাত্ম্যে সিলেটের মানুষের জীবন এমনিতেই ‘ঝালাপালা’ হয়ে আছে। আমার এ কথা নেতিবাচক অর্থে। কিন্তু নতুন জেলা প্রশাসকের ‘ঝালাপালা’ করে দেওয়া ইতিবাচক। কর্মজীবনে তাঁর একটা প্রশংসিত ক্যারিয়ার রয়েছে। দেশের মানুষ জানেন। দুর্নীতি ও ভেজাল বিরোধী অভিযান পরিচালনা করে দেশব্যাপী আলোড়ন তুলেছিলেন তিনি। যদিও এজন্য তাঁকে অনেক মাশুলও দিতে হয়েছে। আমি বিশ্বাস করতে চাই তিনি সেই ‘ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলমই’ রয়েছেন। অবশ্য তিনি প্রথম দিনেই বলেছেন, ‘যদি আপনারা আমাদের সঙ্গে থাকেন, জনগণ সঙ্গে থাকে, তাহলে আমাকে যেমন দেখেছেন, আমি এখনো তেমন আছি তেমনই থাকব।’ তাই একটা কথাই বলব, ‘ঝালাপালা’ করে দেন। এতে সিলেটের মানুষ শান্তি পাবে। নীতিবান মানুষ সবাইকে আপনার সঙ্গেই পাবেন। 


তিন.

মাস দুয়েক আগে (১২ জুন, ২০২৫) সিলেটের বর্তমান বিভাগীয় কমিশনারের সঙ্গে একটি বৈঠকে কিছু কথা বলার সুযোগ হয়েছিল। সেই বৈঠকে পাথরকাণ্ডে ওএসডি হওয়া জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদের অযোগ্যতা ও অদক্ষতা সম্পর্কে কিছু কথা বলেছিলাম। সিলেটের মতো প্রাচীন জেলার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে তাঁর অনেক কিছু জানার কথা ছিল। না জানলে জানার চেষ্টা করতে পারতেন। এই সিলেটে ডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করে গেছেন এমন একজন বর্তমান উপদেষ্টা পরিষদে আছেন। অতীতে দায়িত্ব পালন করা তাঁর পূর্বসূরীদের রেখে যাওয়া নোট পড়লেও তো তিনি সম্যক ধারণা নিতে পারতেন। বিভাগীয় কমিশনার আমার কথা শুনেছেন। কিছু নোটও নিয়েছেন। তবে কিছু বলেননি। তবে তিনি যে শুনেছিলেন এজন্য তাঁকে ধন্যবাদ। 

ওইদিনই সন্ধ্যায় বিভাগীয় কমিশনারের উদ্যোগেই জেলা প্রশাসকের সঙ্গে সার্কিট হাউসে আলাপ হয়। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর ২০২৪ সালের ১২ সেপ্টেম্বর তিনি সিলেটে যোগ দেন। এটাই তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম দেখা। নিজের ব্যস্ততা, তাছাড়া কেউ না ডাকলে সাধারণত প্রশাসনের চৌহদ্দির মধ্যে যেতে চাই না। যাই হোক, সেদিনই ডিসি জানালেন তিনি সকালে উৎমাছড়া পর্যটন কেন্দ্র পরিদর্শন করে এসেছেন। সেখানে পর্যটকদের যেতে বারণ করেছিলেন স্থানীয়রা। এজন্যই তাঁর যাওয়া। জানালেন সমাধান করে এসেছেন। কিন্তু আমরা অবাক বিস্ময়ে দেখলাম সাদাপাথর লুটের সময় উৎমাছড়ারও পাথর লুট হয়েছে। অন্তত এই পর্যটন কেন্দ্রে তো বিশেষ নজর থাকার কথা ছিল ওই বিশেষ কারণে। তাছাড়া একযোগে সবগুলো পাথর কোয়ারির পাথর লুট হয়ে যাওয়া কোনো সাধারণ ঘটনা নয়। 


চার.

আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর ‘প্রলয়োল্লাস’ কবিতায় বলেছিলেন, ‘ভেঙে আবার গড়তে জানে সে চির-সুন্দর।’ অর্থাৎ ধ্বংসের মধ্য দিয়েও নতুনভাবে সুন্দর জন্ম নিতে পারে। তাই আমাদের যা হবার তো হয়েই গেছে। এবার দুর্বৃত্তায়নের দেয়াল ভেঙে নতুনভাবে সুন্দরের জন্ম দিতে হবে। সমস্যা একটাই আমরা ভেঙে আবার গড়তে পারি না। তাই সমাজে এত সংকট। 

আশার কথা গত শুক্রবার (২২ আগস্ট, ২০২৫) জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মো. মোখলেস উর রহমানসহ বেশ কজন সচিব সাদাপাথর পরিদর্শন করেছেন। সেখানে জনপ্রশাসন সচিব বলেছেন, ‘পাথর লুটে জড়িত যে দলেরই প্রভাবশালী ব্যক্তি কিংবা প্রশাসনের যত বড় কর্মকর্তাই জড়িত থাকুন না কেন কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।’ (সূত্র: সিলেট মিরর, ২৩ আগস্ট, ২০২৫)। কথা একটাই- সিলেটের মানুষ এর বাস্তবায়ন দেখতে চায়।  


শেষ কথা 

গতকাল রাতে (২৩ আগস্ট, ২০২৫) এই লেখাটি যখন লিখছি তখন জানতে পারলাম সিলেটের নতুন ডিসি পাথর লুটকারীদের তিন দিনের আল্টিমেটাম দিয়েছেন। আগামী মঙ্গলবার বিকাল ৫টার মধ্যে যাদের কাছে এখনো সাদাপাথর আছে তারা নিজ খরচে, নিজ উদ্যোগে ভোলাগঞ্জ সাদাপাথর এলাকায় পৌঁছে দেবেন। এ সময়ের পর কারো কাছে সাদাপাথর পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এমনকি নির্ধারিত সময়ের পর যে এলাকায় অভিযান চালিয়ে পাথর পাওয়া যাবে ওই এলাকার জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এটাই বোধহয় জীবন ‘ঝালাপালা’ করে দেওয়া। 

সরকারের সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ অন্তত বিষয়টিকে তারা গুরুত্ব দিয়েছেন। জীবন ‘ঝালাপালা’ করে দেওয়া একজন ডিসিকে সিলেটে পাঠিয়েছেন। আশা করব সরকার তাঁর পাশে থাকবেন। পিছু হটে যাবেন না। 

সিলেটের নতুন জেলা প্রশাসকের জন্য শুভকামনা রইল। যাতে সিলেটের মানুষ তাঁকে নিয়ে জয়ধ্বনি করতে পারে। কবি প্যারীচরণ দাশ সিলেটের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে লিখেছিলেন, ‘শ্রীহট্ট লক্ষীর হাট আনন্দের ধাম/ সর্বাপেক্ষা প্রিয়তর এ ভূমির নাম।’ মোদ্দাকথা হলো, আমরা আমাদের সেই শ্রীহট্ট বা সিলেট ফিরে পেতে চাই।