রুম্মান মাহমুদ
০১ সেপ্টেম্বর , ২০২৫
১৯১৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর ভোরের নির্মল আকাশ এবং মৃদুমন্দ বাতাস কেবলমাত্র প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ক্রমশ অবসানের ইঙ্গিতই দেয়নি, বরং নিঃশব্দে একটি জাতির স্বাধীনতার ভাগ্যও লিখে যাচ্ছিল। প্রকৃতিও যেন তার বাহারি ফুল, পাখির গান আর সুরমা নদীর রূপালী স্রোতের ছন্দের মাধ্যমে এক মহান সন্তানের আগমনের ঘোষণা করছিল। বেগম জোবেদা খাতুন এবং খান বাহাদুর মফিজুর রহমানের পরিবারের তৃতীয় সন্তান হিসেবে তাঁর আগমন। মা স্নেহভরে তাঁর নাম রাখলেন “আতা”, যার পোষাকি রূপ মহম্মদ আতাউল গণি ওসমানী। এই শুভ জন্মদিনে পুরো জাতি গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করছে সেই মহান নেতাকে যিনি কৌশল, সাহস এবং সততার মাধ্যমে বাংলাদেশের ভাগ্য গড়ে তুলতে সহায়তা করেছিলেন। আজ বাংলাদেশের জনগণ ওসমানীর জন্মদিন উদযাপনের মাধ্যমে এক সত্যিকারের বীরকে সম্মান জানাচ্ছে। তিনি এমন একজন মানুষ যার সাহস, ত্যাগ এবং দেশের প্রতি অগাধ ভালোবাসা একটি জাতিকে জাগিয়ে তুলেছিল। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি এবং বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর স্থপতি হিসেবে জেনারেল ওসমানী আজও প্রতিটি সৈনিকের স্যালুটে এবং আমাদের স্বাধীনতার চেতনায় জীবন্ত। তাঁর অসাধারণ সমরকৌশল, শক্তিশালী সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তোলার প্রতি অঙ্গীকার এবং গণতন্ত্রের প্রতি গভীর বিশ্বাস আজও প্রতিটি সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যের পথকে আলোকিত করে। তিনি শুধু একজন সামরিক নেতাই ছিলেন না; ছিলেন এদেশের স্বাধীনতার একজন অভিভাবক।
ওসমানী সিলেটের সুনামগঞ্জের এমন একটি পরিবারে বেড়ে উঠেছেন যেখানে শিক্ষার গুরুত্ব এবং জনসেবার চেতনা গভীরভাবে প্রোথিত। তাঁর পিতামহ জনাব আবদুস সোবহান চৌধুরী ছিলেন একজন ফারসী পণ্ডিত, দার্শনিক এবং ধর্মীয় চিন্তাবিদ। জেনারেলের মাতামহ জনাব আকিল চৌধুরী ছিলেন রায়খালীর (দশঘর ইউনিয়ন, বিশ্বনাথ, সিলেট) জমিদার। জনাব আবদুস সোবহান চৌধুরীর কনিষ্ঠ পুত্র খান বাহাদুর মফিজুর রহমানের ঔরসেই মহম্মদ আতাউল গণি ওসমানীর জন্ম। জনাব আব্দুস সোবহান চৌধুরী পাটনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে স্নাতক সম্পন্ন করে যথাক্রমে মুন্সিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জের সাব-ডিভিশনাল অফিসার, আসামের জেলা প্রশাসক এবং আসামের প্রথম মুসলিম ডিরেক্টর অব ল্যান্ড রেকর্ডস হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এমন এক বিশিষ্ট পরিবারে শিশু ওসমানীর মায়ের দক্ষ তত্ত্বাবধানে পারিবারিক পরিবেশেই তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয়। ১৯২৯ সালে ষষ্ঠ শ্রেণিতে গৌহাটি কটন স্কুলে ভর্তি হওয়ার সময়ই তিনি ইংরেজি ও ফারসি ভাষার প্রাথমিক শিক্ষা আয়ত্ত করে ফেলেছিলেন। এরপর তিনি সিলেট গভর্নমেন্ট হাই স্কুল থেকে ইংরেজি বিষয়ে অসাধারণ দক্ষতার জন্য ‘প্রিটোরিয়া পুরষ্কার’সহ প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। অতঃপর তিনি ১৯৩৮ সালে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কলা বিভাগে স্নাতক এবং ১৯৩৯ সালে ভূগোল বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। পরবর্তীতে, ১৫ মে ১৯৪০ তারিখে তিনি ভারতের দেরাদুনে রয়েল ভারতীয় মিলিটারি একাডেমিতে ব্যাচের একমাত্র বাঙালি ‘জেন্টলম্যান ক্যাডেট’ হিসেবে যোগদান করেন।
ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীতে প্রশিক্ষণের সময় তাঁকে শৃঙ্খলা, সাংগঠনিক দক্ষতা এবং আধুনিক সামরিক কৌশলের শিক্ষা দেয়া হয়। চাকুরীর পরিক্রমায় ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৪২ তারিখে ওসমানী মাত্র ২৩ বছর বয়সে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর অন্যতম কনিষ্ঠ মেজর হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন। তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর ওসমানী পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন এবং লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদে পদোন্নতি পান। ১৯৪৮-৪৯ সালে তিনি পাকিস্তানের কমান্ড অ্যান্ড স্টাফ কলেজ, কোয়েটা হতে মর্যাদাপূর্ণ স্টাফ কোর্স সম্পন্ন করেন। ১৯৫২ সালে তিনি প্রথম বাঙালি অফিসার হিসেবে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ১ম ব্যাটালিয়নের অধিনায়কের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন এবং ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৪ তারিখ পর্যন্ত উক্ত ব্যাটালিয়নকে নেতৃত্ব দেন। পরবর্তী সময়ে তিনি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টার, একটি পদাতিক ব্রিগেড, ঢাকার স্টেশন কমান্ডার এবং ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের অতিরিক্ত কমান্ড্যান্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৪ মে ১৯৫৬ তারিখে তিনি কর্নেল পদে পদোন্নতি লাভ করেন। এ সময় তাঁকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জেনারেল হেডকোয়ার্টার এর ‘মিলিটারি অপারেশনস ডাইরেক্টরেট’ এর উপ-পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় যেখানে কেবলমাত্র বাছাই করা দক্ষ অফিসারদেরই দায়িত্ব দেওয়া হতো। তিনি এই পদে তাঁর সামরিক জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। পেশাগতভাবে অত্যন্ত দক্ষ কর্নেল ওসমানীর উচ্চপদে উন্নীত হয়ে দায়িত্ব পালনের সকল যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৭ তারিখে তাঁকে অবসরে প্রেরণ করা হয়।
বস্তুত সেই সময়ে ওসমানীর পক্ষে প্রমাণ করার আর কিছুই বাকি ছিল না। পাকিস্তানে বাঙালিদের প্রতি বৈষম্য তাঁকে গভীরভাবে হতাশ করে এবং তাঁর মধ্যে নিজ জাতির মুক্তির জন্য কাজ করার অদম্য ইচ্ছার জন্ম নেয়। ১৯৭১ এর শুরুর দিকে চলমান উত্তেজনা ও শঙ্কার মধ্যে মার্চের প্রথমদিকে লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খানকে মার্শাল ল’ অ্যাডমিনিস্ট্রেটর হিসেবে নিয়োগ দিয়ে ঢাকায় প্রেরণ করা হয়। কোয়েটা কমান্ড অ্যান্ড স্টাফ কলেজে একইসাথে স্টাফ কোর্স করার সুবাদে টিক্কা খান কর্নেল ওসমানীর চরিত্র ও যোগ্যতা সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা রাখতেন। ফলে, ২৫ মার্চ রাতে টিক্কা খানের গোয়েন্দারা গুরুত্বপূর্ণ বাংলাদেশী নিধনের যে তালিকা করেছিল সেখানে তার নাম ছিল চতুর্থ অবস্থানে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে ১২ এপ্রিল ১৯৭১ তারিখে ওসমানী মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেই সকল ধরনের মুক্তি সংগ্রামী বাহিনীকে কেন্দ্রীয় কমান্ডের অধীনে আনার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে, চিরাচরিত রণকৌশল উক্ত পরিস্থিতিতে কার্যকর হবে না। তাই তিনি সমগ্র দেশকে ১১টি অপারেশনাল সেক্টরে ভাগ করেন এবং প্রতিটি সেক্টরের জন্য একজন করে যোগ্য কমান্ডার নিয়োগ করেন। সেক্টর কমান্ডারগণ স্থানীয় পরিস্থিতি অনুযায়ী স্বাধীনভাবে কৌশলগত সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে অপারেশন পরিচালনার ক্ষমতা রাখতেন। এই উদ্ভাবনী পদ্ধতি দ্রুতই অত্যন্ত কার্যকর হিসেবে বিবেচিত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদেরকে বিভিন্ন ধ্বংসাত্মক অভিযান, শত্রুর রসদ সরবরাহ লাইন বিচ্ছিন্ন করা এবং শত্রু টহলদলকে অতর্কিত হামলার কৌশল সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেয়ার পাশাপাশি জেনারেল ওসমানী মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল বৃদ্ধিকে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন। তিনি ব্যক্তিগতভাবে বিভিন্ন ক্যাম্প পরিদর্শন করতেন, যোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করতেন এবং তাঁদের স্মরণ করিয়ে দিতেন যে, তাঁদের ত্যাগের বিনিময়েই একটি স্বাধীন বাংলাদেশ অর্জিত হবে। তাই ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের চূড়ান্ত বিজয় শুধু একটি সামরিক সাফল্যই নয়; এটি বরং একটি সম্মিলিত চেতনার ফল, যা জেনারেল ওসমানী সকলের মাঝে বপন করেছিলেন।
স্বাধীনতা অর্জনের পর বাংলাদেশের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল একটি গেরিলা বাহিনীকে পূর্ণাঙ্গ ও প্রথাসিদ্ধ সশস্ত্র বাহিনীতে রূপান্তর করা। জেনারেল ওসমানী তাঁর দূরদর্শিতা এবং অভিজ্ঞতা দিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমান বাহিনী এবং বাংলাদেশ রাইফেলসকে পুনর্গঠন করেন। তিনি এমন একটি সশস্ত্র বাহিনীর স্বপ্ন দেখছিলেন যা দেশপ্রেম, শৃঙ্খলা এবং অসামরিক প্রশাসনের প্রতি পারস্পরিক শ্রদ্ধার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠবে। তিনি কঠোর প্রশিক্ষণ, চেইন-অফ-কমান্ড এবং শৃঙ্খলার উপর জোর দিয়েছিলেন যেখানে জাতীয় স্বার্থকে সবকিছুর ঊর্ধ্বে স্থান দেয়া হতো। তাঁর বিশ্বাস ছিল, সৈনিকদের কেবল ভূখন্ড রক্ষার মধ্যেই সীমাবদ্ধ না থেকে দেশের উন্নয়ন এবং জাতীয় দুর্যোগে সরকারের সহযোগী হিসেবে কাজ করা উচিত। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে দ্রুত প্রাথমিক কার্যক্রম সম্পন্ন করে এই নিঃস্বার্থ জেনারেল ১৯৭২ সালের ৭ এপ্রিল দ্বিতীয়বারের মতো সেনাবাহিনী হতে অবসর গ্রহণ করেন।
জেনারেল ওসমানীর দেশের প্রতি অঙ্গীকার কেবল সামরিক ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ ছিল না। সেনাবাহিনী থেকে অবসর গ্রহণের পরও তিনি রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালে তিনি দুইবার ‘প্রক্টোরিয়াল মনিটর’ নির্বাচিত হওয়া ছাড়াও তিনি আসাম বেঙ্গল স্টুডেন্টস ইউনিয়নের সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে অবসরের পর রাজনীতিতে যোগদানের বিষয়ে প্রাথমিকভাবে অনীহা প্রকাশ করলেও ক্রমাগত অনুরোধে সাড়া দিয়ে বিশেষ শর্তসাপেক্ষে তিনি রাজনীতিতে যোগ দেন এবং ১৯৭০ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিজয়ী হন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে অবসরের পর ১৯৭২ সালের ১২ এপ্রিল তিনি শিপিং, অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন এবং বিমান মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত হন। ১৯৭৩ সালের সাধারণ নির্বাচনেও তিনি বিপুল ভোটের ব্যবধানে পুনরায় নির্বাচিত হন এবং তাঁকে টেলিযোগাযোগ, শিপিং, অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন ও বিমান মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়। দেশের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে তিনি অবগত ছিলেন; তবে বিশ্বাস করতেন যে একমাত্র কঠোর পরিশ্রম ও নিষ্ঠাই এই দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু ১৯৭৪ সালের মে মাসে তিনি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনের বিরোধিতা করে কেবিনেট ও জাতীয় সংসদ উভয় স্থান থেকেই পদত্যাগ করেন। বাংলাদেশের ইতিহাসের সেই গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে জেনারেল ওসমানীই ছিলেন একজন, যিনি প্রতিষ্ঠিত রাস্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে দৃঢ়ভাবে অবস্থান নিতে পেরেছিলেন।
১৯৭৫ সালের ২৯ আগস্ট জেনারেল ওসমানীর জীবনে এক বিশেষ অধ্যায়ের সূচনা হয়। সামরিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক নেতাদের বারংবার অনুরোধের প্রেক্ষিতে তিনি রাষ্ট্রপতির সামরিক উপদেষ্টা হিসেবে যোগদান করেন। এই পদে যোগদানের সময়ও তিনি তিনটি শর্ত দেন যার একটি ছিল- তিনি এ দায়িত্বের জন্য কোন শপথ গ্রহণ করবেন না, একটি জাতীয় কর্তব্য হিসেবে তিনি এ দায়িত্ব পালন করবেন এবং এজন্য তিনি কোন সম্মানী গ্রহণ করবেন না। কঠোর নৈতিকতা এবং সামরিক প্রথা অনুযায়ী বঙ্গভবনে অবস্থানকালে খাবারসহ গৃহীত সকল সেবার জন্য তিনি নিজে বিল প্রদান করতেন। তবে, ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে চার জাতীয় নেতাকে হত্যার ঘটনার পরপরই তিনি আবারও পদত্যাগ করেন। পরবর্তী সময়ে, ১৯৭৬ সালে তিনি একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন, তবে তাতে উল্লেখযোগ্য সাফল্য আসেনি। জেনারেল মহম্মদ আতাউল গণি ওসমানী ১৯৮৪ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি লন্ডনের সেইন্ট বার্থোলোমিউ হাসপাতালে ৬৬ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
যুক্তরাজ্য সরকার একটি বিশেষ সামরিক মোটরকেড সহযোগে তাঁর মরদেহ বিমানবন্দর পর্যন্ত পৌঁছে দেয়, যা সাধারণত প্রয়াত ফিল্ড মার্শালদের সম্মানার্থে দেয়ার রেওয়াজ ছিল। তাঁর শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী, এই মহান বীরকে সিলেটে হযরত শাহজালাল (রহ.) দরগাহ প্রাঙ্গণে মায়ের কবরের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়। জেনারেলরা হয়তো একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বাঁচেন, কিন্তু কিংবদন্তিরা চিরকাল বেঁচে থাকেন। জেনারেল ওসমানীকে শুধুমাত্র তাঁর সামরিক মেধা বা রাজনৈতিক দূরদর্শিতা নয়, বরং তাঁর ব্যক্তিত্ব ও চারিত্রিক দৃঢ়তাই অনন্য করে তুলেছিল। সরলতা ও আত্মশৃঙ্খলার জন্য তিনি সর্বজনবিদিত ছিলেন। স্বাধীনতার পরও তিনি নিতান্তই সাদামাটা জীবন বেছে নিয়েছিলেন এবং সাধারণ মানুষের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত ছিলেন।
তিনি আনুগত্যকে গুরুত্ব দিতেন, তবে স্বাধীন চিন্তাকে উৎসাহিত করতেন। নিজস্ব উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে তিনি তাঁর অধীনস্তদের সর্বোচ্চ সক্ষমতা দিয়ে দায়িত্ব পালন করার সুযোগ করে দিতেন। তিনি সৈনিক, মুক্তিযোদ্ধা, দেশবাসী ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করতে ভালোবাসতেন এবং সর্বদা বিশ্বাস করতেন যে, এই দেশ প্রতিটি নাগরিকের। তাঁর ৬৬ বছরের জীবন আমাদের শেখায়, প্রকৃত সেবার অর্থ হলো জাতিকে নিজের চেয়ে বড় করে দেখা, সততার সঙ্গে নেতৃত্ব দেয়া এবং অন্যকে বৃহত্তর লক্ষ্যে অবদান রাখতে অনুপ্রাণিত করা। মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি যুদ্ধের মাঠে সাধারণ খাকি ইউনিফর্ম পরতেন, ক্যাম্পের বিছানায় ঘুমাতেন, জাঁকজমক এড়িয়ে চলতেন এবং নিজ বাড়িতেও প্রচলিত সামরিক আসবাবপত্র ব্যবহার করতেন। এই প্রকৃত নেতা যুদ্ধক্ষেত্রে কৃতিত্বের জন্য তাঁর অধীনস্তদের জন্য বীরত্বসূচক পুরস্কার নিশ্চিত করেছিলেন, কিন্তু নিজের কোনো সম্মাননা নিয়ে বিন্দুমাত্র ভাবেননি। আত্মপ্রেরণা এবং আত্মসম্মানের এই অসাধারণ উদাহরণ তাঁকে সকলের চেয়ে বহু দূরে, শ্রেষ্ঠত্বের শিখরে স্থান দিয়েছে।
এই বিশেষ দিনে আমরা জেনারেল এম এ জি ওসমানীকে শুধু একজন সামরিক কমান্ডার হিসেবে নয়, বরং একজন দূরদর্শী নেতা এবং নৈতিকতার এক জীবন্ত প্রতীক হিসেবে স্মরণ করি। তাঁর কৌশল, সামরিক উৎকর্ষতা ও জাতিগঠনে অবদান আজকের বাংলাদেশের ভিত্তি স্থাপন করেছে। যুদ্ধক্ষেত্রের সম্মুখসারি থেকে শুরু করে একটি গর্বিত জাতি গড়ার প্রতিটি পর্যায়ে তাঁর জীবন ছিল এক অবিরাম সেবাযাত্রা। তাঁর অটল নৈতিকতা, বিনয় এবং মানুষের প্রতি নিখাদ ভালোবাসা তাঁকে এক চিরন্তন অনুপ্রেরণার উৎসে পরিণত করেছে। ওসমানীনগর উপজেলা, ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, ওসমানী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, ওসমানী জাদুঘর, বঙ্গবীর ওসমানী শিশু উদ্যান, ওসমানী মেমোরিয়াল অডিটোরিয়াম, বুটেক্স ও এমআইএসটির ওসমানী হল ইত্যাদি স্থাপনার নামকরণ করে জাতি তাঁকে সম্মানিত করেছে। তবুও, পরবর্তী প্রজন্ম ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের মঞ্চে দখলদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের ছবিতে সেই মস্ত গোঁফওয়ালা জেনারেল-এর অনুপস্থিতি এখনো আক্ষেপের সাথে অনুভব করে। আজ আমাদের প্রতিজ্ঞা হোক, ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে আমরা যেন তাঁর জাতীয় ঐক্যের প্রতি অঙ্গীকার, সামরিক বুদ্ধিমত্তা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং নৈতিক নেতৃত্ব থেকে প্রেরণা নিয়ে একটি আরও সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী বাংলাদেশ গড়তে কাজ করি। তিনি ছিলেন একজন নেতা, একজন সৈনিক, একজন সেবক এবং সর্বোপরি বাংলাদেশের এক শ্রেষ্ঠ সন্তান। তাঁর কণ্ঠস্বর হয়তো আজ নীরব, কিন্তু তাঁর আদেশ আজও প্রতিধ্বনিত হয় - আমাদের মাটিতে, আমাদের আকাশে, আমাদের স্বাধীনতার প্রতিটি স্পন্দনে।
এএফ/১১