মোস্তাক আহমাদ দীন
১২ অক্টোবর , ২০২৫
গত শতকের আশির দশকের শুরুতে কানাডা থেকে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফিরে বিশ্বসাহিত্যের খ্যাতকীর্তি লেখকদের নিয়ে দৈনিক সংবাদ-এ যখন কলাম লিখতে শুরু করলেন, তখন আমরা যারা সেই সময়ের, বা পরবর্তীসময়ের মুদিদোকানের পুরোনো কাগজের স্তূপ-ঘেঁটে-বের-করে-আনা সাময়িকীর বিলম্বিত পাঠক, তাদের কাছে, সেইসব লেখকের নাম জানতাম না বলে একেকটি গদ্য ছিল হাতে চাঁদ-পেয়ে-যাওয়ার শামিল। অন্যরকম সব বই, অন্যরকম সব লেখক : হোর্হে লুই বোর্হেস, আমোস টুটুওলা, ইতালো কালভিনো, নিকোলাস গিয়েন, উমবের্তো একো, শেমাস হিনিসহ আর কত কতজন! তখন সেখানে ‘হৃৎকলমের টানে’ শিরোনামে কলাম লিখতেন অগ্রজ লেখক সৈয়দ শামসুল হকও, সেটি খুব জনপ্রিয়ও ছিল; ফলে, ‘বিষয়বৈচিত্র্য’ নিশ্চিত করে, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে ‘যুক্তি’ ও ‘অনিবার্যতা’ বজায় রেখে ‘ভাষার ব্যাপারে যতœশীল’ থেকে সেই কলামগুলো লিখতে হতো তাঁকে। ভাষা ও বিষয়ের ক্ষেত্রে সেসময় কতটা সতর্ক ও সজাগ ছিলেন সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, পরবর্তীসময়ে বই প্রকাশ করতে গিয়ে তিনি তার উল্লেখ করলেও আমাদের মতো আনপড় পাঠকদের পক্ষে তখনই তা বোঝার কথা নয়; আমরা শুধু এটুকুই বলতে পারি, আমাদের সামনে তখনকার কলামগুলো ছিল স্বচ্ছ, স্বতঃস্ফূর্ত স্বাদু গদ্যের উদাহরণ।
এইসব আনন্দপাঠের মধ্য দিয়ে যখন সময় কাটছিল তখন আরেকটি বিস্ময় অপেক্ষা করেছিল আমাদের জন্য, সেটি হলো ১৯৯২ সালে প্রকাশিত বই : কতিপয় প্রবন্ধ। বিস্ময় একারণে যে, ভেবে পাইনি, ১৯৫১ সালে নিস্তরঙ্গ সিলেটে জন্মগ্রহণকারী সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম এই ক্ষুরধার প্রবন্ধগুলো কবে লিখলেন এবং তার জন্য এত প্রস্তুতিই-বা গ্রহণ করেছিলেন কবে? পিএইচডির জন্য যে-পাঁচটি বছর বাইরে ছিলেন, তা মনে রাখলে, সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময়ে তাঁর বয়স তো তখন মাত্র চব্বিশ কি পঁচিশ, সে-হিসেবে পিএইচডির সময়ে যেহেতু সংশ্লিষ্ট কাজেই ব্যস্ত থাকার কথা, সেহেতু তাঁর আগে, অথবা পরে, কলাম লেখার ফাঁকে ফাঁকে এগুলো লিখেছিলেন। যখনই লিখুন, সার্বিক বিবেচনায় একথা কারও বুঝতে অসুবিধা হয় না যে কী আকাক্সক্ষা নিয়ে এই প্রবন্ধগুলো লিখে চলেছিলেন এক নবীন সমালোচক। অনুমান মিথ্যে হতে পারে, তবু ধারণা করি, ইংরেজি সাহিত্যের মনোযোগী ছাত্র ও শিক্ষক হওয়া সত্তে¡ও বাংলা সাহিত্যের যুগন্ধর সমালোচক হওয়ার ইচ্ছায় গবেষণার খণ্ডন-মণ্ডনের রীতি মান্য করে একেকটি আলোচনা লিখে গেছেন সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম।
কতিপয় প্রবন্ধ বইয়ের শেষ আলোচনা ‘বাংলাদেশে শেক্সপীয়ার চর্চা’র কথা বাদ দিলে, প্রত্যেকটি আলোচনার বিষয় বাংলা সাহিত্য : ‘মাইকেল মধুসূদন ও আধুনিকতা’, ‘আধুনিক পাঠকের বঙ্কিমচন্দ্র’, ‘রবীন্দ্রনাথের ভ্রমণ সাহিত্য’, ‘নজরুল ইসলামের বিদ্রোহ’, ‘সুধীন্দ্রনাথ দত্ত : নাস্তির নেমির মধ্যে জীবন’, ‘সমর সেনের কবিতা’, ‘শামসুর রাহমানের শহর’, ‘অন্য এক বিভূতিভূষণ’, ‘কাঁদো নদী কাঁদো : চিন্তা ও শৈলী’ এবং ‘ফররুখ আহমদের কবিতায় কিংবদন্তী প্রসঙ্গ : হাতেমতা’য়ী’। এর প্রত্যেকটি প্রবন্ধেই রয়েছে তাঁর সূ² পর্যবেক্ষণশক্তির পরিচয়।
‘মাইকেল মধুসূদন ও আধুনিকতা’ শিরোনামক প্রবন্ধে তিনি মধুসূদনের ইংরেজি ভাষায় লিখিত চিঠিপত্রের ম্যানারিজমে স্ববিরোধিতা লক্ষ করলেন এবং বললেন, ‘শ্রমসাধ্য চিঠিপত্র-বিনিময়ে যে-উদ্দেশ্যটি প্রধান, তা হল কল্পনায় একজন কীটস বা বায়রন অথবা একজন কার্লাইল হওয়া, যাদের চিঠিপত্রের ধাঁচ ও ভাষা অনেকটা মধুসূদনের সঙ্গে সমগোত্রীয়।’ এই প্রবণতার বৈপরীত্য খুঁজে পাওয়া যায় মাইকেলের ঢাকায় প্রদত্ত ভাষণে, যা সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম তাঁর প্রবন্ধে উদ্ধৃত করেছিলেন : ‘আমার সম্বন্ধে আপনাদের আর যে কোন ভ্রমই হউক, আমি সাহেব হইয়াছি এ ভ্রমটি ভারি অন্যায়। ...আমি সুদ্ধ বাঙালী নহি, আমি বাঙাল, আমার বাটী যশোর।’ তিনি বাঙাল ছিলেন বটে, কিন্তু সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের মতে, তিনি আধুনিকও : মধুসূদন আধুনিক, ‘স্বকালের সাথে তাঁর অসংখ্য পার্থক্য ও কলহের জন্য, তাঁর জীবন ও সৃষ্টি, এ দুটি ভিন্ন ক্ষেত্রে বৈচিত্র্যময় প্রকাশের জন্য।’ আধুনিকতা বিষয়ে তাঁর এ-মন্তব্যের পরিচয় খুঁজে পাওয়া যাবে ‘সুধীন্দ্রনাথ দত্ত : নাস্তির নেমির মধ্যে জীবন’ শীর্ষক প্রবন্ধেও, যেখানে তাঁর মূল্যায়নে আধুনিকতা-স্ববিরোধ-অসামঞ্জস্যতা প্রভৃতি সমার্থ ব্যঞ্জনায় একাকার। সেভাবে, উনিশশতকের লেখক বঙ্কিমও তাঁর কাছে আধুনিক ঔপন্যাসিক হিসেবে চিহ্নিত হতে পারেন।
তিনি জানেন, আধুনিকবাদ বিশেষ সময়ের আন্দোলন বটে কিন্তু সব যুগেই তার প্রকাশ ঘটতে পারে। ফলে বঙ্কিমকে নিয়ে লিখিত বইয়ের দ্বিতীয় প্রবন্ধে নানা বিশ্লেষণের মাধ্যমে তিনি তাঁর উপন্যাসকে আধুনিক, অভিনব এবং কালজয়ী বলতেও দ্বিধা করেননি। তবে এ-প্রবন্ধের সবচেয়ে মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য তিনি সেই ‘বিজ্ঞজন’দের সম্পর্কে করেছেন যারা বঙ্কিমকে সাম্প্রদায়িক বলেন ঠিকই অথচ বঙ্কিমের সার্ধশতবর্ষে পৌঁছেও নিজেরা অসাম্প্রদায়িক হতে পারেননি।
এছাড়াও রবীন্দ্রনাথ, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, কাজী নজরুল ইসলাম, সমর সেন, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্, ফররুখ আহমদ ও শামসুর রাহমানকে নিয়ে যে-আলোচনা করেছেন তাতে তিনি তাঁর স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে বহু জায়গায় পূর্ববর্তী আলোচকদের মত খÐন করে করে নিজের মÐিত সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন। তাঁর এই স্বতন্ত্র মত-প্রকাশের প্রবণতা গড়ে ওঠার পেছনে ভূমিকা রেখেছে দেশি ও বিদেশি সাহিত্যের নিবিড় অধ্যয়ন, পারিবারিক উত্তরাধিকার ও বিদ্যানুকূল পরিবেশ এবং সর্বোপরি নিজের সৃষ্টিশীল কাজের অভিজ্ঞতা থেকে প্রাপ্ত সুগভীর অন্তর্দৃষ্টি। আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে প্রকাশিত তাঁর বই নন্দনতত্ত¡, বাংলাদেশের চিত্রকলা বিষয়ে ইংরেজি ভাষায় লিখিত দুটি বই এবং বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত উপন্যাস ও ছোটোগল্পগুলো পড়লে একথার সত্যতা পাওয়া যাবে। অব্যাহত জ্ঞানচর্চার সঙ্গে তাঁর এই অন্তর্দৃষ্টির যোগই তাঁকে আত্মবিশ্বাসী করেছে যার পরিচয় খুঁজে পাওয়া যায় বিশ্বসাহিত্যবিষয়ক বহু আলোচনায়। এখানে আত্মবিশ্বাসী বলতে যেকোনো সিদ্ধান্ত বিষয়ে তাঁর অনড় অবস্থার কথা বলা হচ্ছে না, বরং অন্তর্নিহিত বিষয়বস্তুর নানা সামঞ্জস্য অনুসন্ধানের মধ্য দিয়ে তিনি নিজস্ব ভঙ্গিতে যে পাঠ-পরিচয় তুলে ধরেন তার কথা বলছি।
এই মুহূর্তে মনে পড়ছে, ‘ইতালো কালভিনো’ শিরোনামের লেখাটির কথা যেখানে তিনি ইনভিজিবল সিটিজ উপন্যাসটির প্রশংসা করে বলেছিলেন, ‘কালভিনোর উদ্দেশ্য ছিল উত্তর আধুনিক নগর সভ্যতার একটি কাঠামোবাদী চালচিত্র নির্মাণ এই উপন্যাসে, তিনি সফল হয়েছেন তাঁর বর্ণনার ভাষার বিশিষ্টতার জন্য। অদৃশ্য নগরগুলো শেষপর্যন্ত প্রতিটি মানুষের অন্তঃস্থিত।’ এরপর, ‘তাঁর শৈলীর নিজস্বতা ও বিষয়বস্তু স্থিত ছিল তাঁর বিশ্বদর্শনে’ বলবার পরেও তিনি আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে যে-মন্তব্য করলেন তা আমাদের মতো কালভিনোতাড়িত পাঠকদের জন্য ছিল এক বিরাট ধাক্কা; বলেছিলেন : ‘কালভিনো বড় লেখক ছিলেন না।’ দুটি বাংলা অনুবাদের সঙ্গে পর্যাপ্তÍ টীকাটিপ্পনীর সাহায্যে এই উপন্যাসটি পড়বার পর আমাদের যে-অভাবিতপূর্ব অভিজ্ঞতা, তাতে মাঝে মাঝে ভেবেছি তাঁর এই সিদ্ধান্ত বিষয়ে জিজ্ঞেস করা যায় কি না, কিন্ত অপ্রতিভতাবশত তাঁর কণ্ঠাপেক্ষী হওয়ার সেই সাহস আর সঞ্চয় করে উঠতে পারিনি, ভবিষ্যতেও সেই সুযোগ আর রইল না।
তবে ভেবেছি, শেমাস হিনি বিষয়ে অকালপ্রয়াত কবি খোন্দকার আশরাফ হোসেন যে-আবিষ্টতা তৈরি করে গিয়েছিলেন, তা থেকে স্বস্থ হওয়ার জন্য একদিন কথা বলা দরকার। নব্বইয়ের দশকে তাঁর সম্পাদিত একবিংশ পত্রিকায় শেমাস হিনির তিনটি বগ্ কবিতার যে-অনবদ্য অনুবাদ করেছিলেন খোন্দকার আশরাফ, তা পড়বার পর, অল্পবয়সে যা হয়, নানাজনের কাছে খুঁজে বেড়িয়েছি শেমাস হিনি এবং হিনিবিষয়ে যা-কিছু, তখনই একদিন নজর পড়ল সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের ‘শেমাস হিনি’ শীর্ষক লেখাটির ওপর এবং পড়ে বিলকুল বিস্মিত হয়ে যাই। শেমাস হিনির বয়স যখন চল্লিশ-ছুঁইছুঁই, তখন প্রথমে ডাবলিনের একটি পাব-এ বসে একটানা দুইঘণ্টা, পরে মধ্যরাতে এক নির্জন গোরস্তানে বসে সেই প্রিয় কবির কবিতা স্বকন্ঠে আবৃত্তি শুনেছেন সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম! কথাসাহিত্যিক সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের সেই অনবদ্য স্মৃতিলেখাটি শেষপর্যন্ত একটি রোমাঞ্চকর গল্পের রূপ নিয়েছিল বলে সেটি পড়ে তখন কী দশা হয়েছিল এখানে তা বলা মুশকিল, কিন্তু বুঝতে পারি শেমাস হিনির যে-কবিতাগুলো পড়ে একসময় আলোড়িত হয়েছি সেগুলোর দু-একটি সেখানে পড়া হয়েছিল। কারণ সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম লিখেছিলেন, গোরস্তানে কোন কোন কবিতা পড়া হয়েছিল তাঁর মনে নেই, তবে তাতে একটা চাপা হাহাকার ছিল : ‘যেন তিনি অতীতকে খুঁড়ে যাচ্ছেন, আর মৃতের সব হাড়গোড় বেরোচ্ছে। আর তিনি একজন একমাত্র জীবিত বংশধরের মতো পূর্বপুরুষের ওই অস্থিগুচ্ছ নিয়ে ভাবছেন, কীভাবে ফিরিয়ে দেবেন তাদের, এই মাটিতে। এবং অনুশোচনা করছেন, কেন তিনি খুঁড়ে তুললেন এই অতীতকে।’ আর আমাদেরও মনে পড়ে গেল ‘দ্য টলান্ড ম্যান’-এর সেই অনবদ্য স্তবক দুটি, কারণ গোরস্তানে বসে পড়তে গেলে শেমাস হিনির এই কবিতাটিই তো বেশি মনে পড়বার কথা :
কোন একদিন আমি যাব আরহাস্
তার কয়লা-ব্রাউন রঙের মাথাটি দেখতে,
আর তার চোখের পাতার নরম পল্লবগুলো
এবং তা সুঁচলো চামড়ার টুপিটি।
কাছের এক সমতল ভূমি থেকে
ওরা খুঁড়ে বের করেছে তাকে,
শীতের বীজদানায় রাঁধা তার শেষ আহার
পুঁটলি পাকিয়ে রয়েছে পাকস্থলীতে তার
তখনই বুঝেছিলাম, এরপর যখনই সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের সঙ্গে দেখা হবে, রাস্তা-হারানো বিষয়ে শেমাস হিনির সঙ্গে তাঁর আলাপ আর সেই রোমাঞ্চকর রাত্রিটির কথা বারবার মনে পড়তে থাকবে।
জীবনের শেষপ্রান্তে তিনি ছিলেন কথাসাহিত্যের জগতে ব্যস্ত, আমরাও ছিলাম তার নিয়মিত পাঠক, বাংলা সাহিত্য আর বিশ্বসাহিত্য বিষয়ে তাঁর লেখা কমে গিয়েছিল। তাঁর প্রকাশিত বই এবং পুরোনো পত্রপত্রিকায় নিশ্চয়ই আরও বহু লেখা পড়তে পারব, কারণ তাঁর মতো স্বতন্ত্র ও মননসংবেদী লেখকের লেখা পড়বার জন্য পাঠকেরা সবসময়ই আগ্রহী, কিন্তু আক্ষেপ একটাই : এখন থেকে কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের নতুন কোনো লেখা পড়ে আলোড়িত হওয়ার আর সুযোগ রইল না।