উজ্জ্বল মেহেদী
১৩ অক্টোবর , ২০২৫
সাংবাদিক
মধ্যরাত। ঘুমুতে যাওয়ার প্রস্তুতি। ফেসবুকে চোখ পড়তেই আঁতকে উঠি। এ কী! রাতের পালায় কর্মব্যস্ত সাংবাদিক কয়েকজনকে ফোন দেই। ওপাশ থেকে জানা গেল ঘটনা সত্য। বাংলাদেশে আমাদের রাত মধ্য হলেও নিউইয়র্কে ব্যস্ত দুপুর। ফোন দেই নিউইয়র্ক সিটির বাসিন্দা সৈয়দ উতবাকে। ব্যস্ততার মাঝে শোকসন্তপ্ত উতবা খোঁজ নিয়ে জানালেন, ঘটনাটি ঠিক। ঘড়ির কাঁটা টিক টিক করে শেষ রাতের দিকে গড়াচ্ছিল। ঘুম আসছিল না। শেষ দেখাও অদেখা!
দেখা-অদেখার মানুষটি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী। দুই ছেলেকে দেখতে ও শারীরিক কিছু জটিলতার উন্নত চিকিৎসায় নিউইয়র্ক গিয়েছিলেন। ১০ অক্টোবর বাংলাদেশ সময় মধ্যরাতে তিনি পাড়ি জমান পরপারে। সেখানকার ভরদুপুরের শোক আমাদের রাত-ভোর করে রাখে। মৃত্যুসংবাদটি রাতেই আপ হয় ‘প্রথম আলো উত্তর আমেরিকা’ অনলাইনে। রিপোর্টে বলা হয়, ‘এক সপ্তাহ আগে শারীরিক জটিলতা বাড়ায় তাকে নিউইয়র্কের এলমহার্স্ট হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। শুক্রবার স্থানীয় সময় দুপুর ১টা ৪০ মিনিটে তিনি মারা যান (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।... পারিবারিক সিদ্ধান্তে মরদেহ বাংলাদেশে পাঠানো হবে না। তার পরিবারের ইচ্ছায় ওয়াশিংটন মেমোরিয়াল কবরস্থানে দাফনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। দাফনের আগে মরদেহ উডসাইডের আহলে বায়াত মসজিদ ফিউনারেল হোমে নেওয়া হবে এবং সেখানে জানাজা সম্পন্ন হবে।...’
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সিলেট চ্যাপ্টারের সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন ফারুক মাহমুদ চৌধুরী। টিআইবির নাগরিক সংগঠন সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) সাবেক সভাপতির দায়িত্বে দুবার ছিলেন। দুটো সংগঠনের প্রতিষ্ঠাকালীন একজন সংগঠন। সজ্জন শুধু নন, সদা সজ্জন। সাদাসিধে জীবনযাপনের মধ্যে অসাধারণ একটি গুণ ছিল গণমাধ্যমে সব বিষয়ে কথা বলতেন। এড়িয়ে যেতেন না। বলা কথায় অবিচল থাকা। যে সকল কথা তার বরাত দিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশ হতো, তাতেই তিনি স্থির থাকতেন। ওই পন্থায় পথ চলতেন। এসব কথা-পন্থা থেকে শত্রু-মিত্রের উদ্রেক ঘটতো। নানা বিবাদ-ফ্যাসাদ তৈরি হতো। কিন্তু তিনি সেই এক কথার মানুষ। নির্বাচন এলেই সুশাসনের স্বপ্ন জাগিয়ে কথা বলতেন। প্রোগ্রাম করতেন। ভোটের পরে স্বপ্নভঙ্গ ঘটতো। আশাহত হতেন। তবে আশা হারাতেন না।
সুজন-টিআইবির নাগরিক প্লাটফরমে আশাবাদী ফারুক মাহমুদ চৌধুরীর সঙ্গে প্রথম দেখা ২০০৬ সালে। তবে চেনার পাট আরও আগের। প্রথম দেখাতে জানিয়েছিলেন, সুজনের কেন্দ্রীয় সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদারের মাধ্যমে আমার সম্পর্কে প্রথম জানার বিষয়টি। প্রথম জানাটাও সাংবাদিকতা। ২০০৫ সালে সুনামগঞ্জের একটি উপনির্বাচনে উচ্চ আদালতের নির্দেশে প্রার্থীদের হলফনামা প্রকাশের বাধ্যবাধকতা প্রকাশ হয়। বাংলাদেশের কোনো সংবাদমাধ্যমে সম্ভবত আমিই প্রথম রিপোর্ট করেছিলাম। রাতের টেলিভিশন টকশো-তে ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়। এরপর সিলেটে ওয়ান-ইলেভেনকালে সিটি নির্বাচনে হলফনামা ধরে ধরে রিপোর্ট। সেই সব বিষয়ভিত্তিক রিপোর্টে ভোটের মাঠে বেশ চাঞ্চল্য তৈরি করে। তো এসব রিপোর্টে একটি বিশেষজ্ঞ বা বিবেকি মতামতের প্রয়োজন পড়তো। এ মতামত দিতেন ফারুক মাহমুদ চৌধুরী। অকপটে বলায় কখনো কখনো রিপোর্টের পুরো দায়ভার তাঁর ওপর গিয়ে বর্তাতো। নীরবে সয়ে যেতেন। সয়ে সেয়ে শেষে সতর্ক করে দিতেন। এভাবে কেবল আমার সঙ্গে নয়, সিলেটের সকল স্তরের গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক ছিল। চলছিল একটানা আড়াই দশককাল। নিজ পেশা ব্যবসায়ী পরিচয়টি আড়াল হয়ে গিয়েছিল। সিলেটের অভিভাবক হিসেবে গণমাধ্যম জগতে অনিবার্য মুখ হয়ে উঠেছিলেন। তাতে ছিল ক্ষমতাসীনদের যাতনা। সইতে সইতে শেষে সর্বশেষটা ছিল বিদ্ধ করার মতো।
সব ঘটনা বাদ দিয়ে শেষটাই বলছি। সর্বশেষ সিটি নির্বাচনে যথারীতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী তাঁর স্বভাবসিদ্ধ চরিত্রে প্রকাশ হলেন। এরপর গেল ২০২৪ সালের একতরফা জাতীয় নির্বাচন। সেখানেও তাঁর মতামত নিয়ে অবিচল ছিলেন। যে গণমাধ্যম মতামত জানতে চাইতো, অকপটে বলতেন। এসব মতামতই ছিল গণমত। কোনোভাবে উপেক্ষা করার ছিল না। তাতে ক্ষমতার রক্তচক্ষু জ্বলে ওঠে। একদিন ফোন করেন লক্ষীকান্ত সিংহ। তিনি মানবাধিকারকর্মী। হাতে গড়া বেসরকারি একটি উন্নয়ন সংস্থার নির্বাহী। একটি চক্র ভিডিও পাঠিয়ে ফারুক মাহমুদ চৌধুরীকে ফোন দিয়েছে। তিনি খুবই বিচলিত। শোনা মাত্র ফোন করলাম। কাঁপা কাঁপা তাঁর কন্ঠস্বর। পুরো বিষয়টি জেনে তাঁকে বললাম, এসব ‘এআই’ দিয়ে করানো। আপনি এড়িয়ে যান, আমরা দেখছি। একটি জিডি ও নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে সমন্বিত বিবৃতি প্রকাশের পর সেই চক্রটি হয়তো পরিকল্পনা বদল করেছিল। ঠিক তখন থেকেই তিনি কিছুটা বিচলিত ও সন্ত্রস্ত ছিলেন। তবে ত্রস্ত ছিলেন না। সংবাদমাধ্যমে নাগরিক বা সামাজিক সমস্যা, মানবাধিকারকেন্দ্রিক কিংবা রাজনৈতিক সংকট বিষয়ে সেই বিবেকি কণ্ঠে কথা বলা তাঁর কখনো থামেনি।
পট-পরিবর্তনের পর সামনে নির্বাচন। সময়ের পালাবদলে প্রার্থীদের উত্তরসূরিরা ভোটের মাঠে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকের বক্তব্য দরকার। ফোন দিলাম। রিসিভ করেননি। পরে কয়েকদিন পর ফোন এল। যথারীতি বিনীয় কণ্ঠ। জানালেন, তিনি স্টোক করে হসপিটালে ভর্তি! এ জন্য ফোন রিসিভ করতে পারেননি। সবিনয়ে বললাম, ঠিক আছে। সুস্থ হোন, কথা হবে। তবু বলছিলেন কী বিষয়ে মতামত দরকার। আমি আর জানাইনি। বলেছি, খোঁজ নিতেই ফোন করেছিলাম। খুব খুশি হয়েছিলেন।
মৃত্যু সংবাদ পাওয়ার পর ফোন ঘেঁটে দেখিছি. ১৩ আগস্ট ও ১৮ আগস্ট। সর্বশেষ কথা হয়েছে। এরপর চিকিৎসকের পরামর্শে নিউইয়র্কযাত্রা। সেখানে তাঁর দুই ছেলে বসবাস করেন। নিউইয়র্ক থেকে সৈয়দ উতবা জানালেন, ছেলের বাসায় থাকা অবস্থায় শারীরিক জটিলতায় হাসপাতালে ভর্তি হন। সপ্তাহের মাথায় চিরবিদায়। দেশে আর ফেরা হলো না। তার সঙ্গে শেষ দেখা, অদেখা হয়েই থাকল! কারণ, যুক্তরাষ্ট্রেই সমাহিত তিনি।
অসুস্থতায় শারীরিক নাজুক অবস্থার কথা বছর কয়েক ধরে জানতাম। রোজ বিকেলে হাঁটার রুটিনে ছেদ পড়েছিল। জানিয়েছিলেন চোখে কঠিন অসুখ। গøুকোমা। একদফা অপারেশনের পরও চোখে ঠিকঠাক দেখতে পারতেন না। এরপরও খোঁজ রাখতেন। চোখ রাখতেন ঘটনা পরিক্রমায়। সুজনের সভা-সেমিনারে সবার আগে সবাইকে বলে রাখতেন। চোখের অসুস্থতার বিষয়টি জেনে সচরাচর ফোন করতাম না। ফোন না করলে আবার তিনি অভিমানী সুরে জানতে চাইতেন, সব ঠিকঠাক আছে কি না! এ নিয়ে একদিন সবিস্ময়ে বিস্তারিত জানতে চাইলে তিনি বলতেন, সাংবাদিকদের ফোন না পেলে দুটো চিন্তা তাঁর মাথায় খেলা করত। একটি, দেশে সুশাসন পুরোপুরি প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। অন্যটি, সুশাসন সুদুর পরাহত! সাংবাদিকেরাও আর এসব নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করছেন না! দুটোর একটি বিষয়ে তাঁকে স্থির থাকতে বলতাম। কিন্তু তিনি যে মনে মনে অস্থির, সেটা ঠিকই বুঝতাম।
বুঝেছি স্থির-অস্থিরের জীবন অনন্ত না। মুত্যুপরবর্তী অবস্থাকে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন ‘সমুখে অনন্ত জীবন বিস্তার’। এ জনমে একজন সুনাগরিক ফারুক মাহমুদ চৌধুরীর সুচিন্তা ছিল সুশাসন। সেই সুচিন্তা নিয়ে ‘সমুখে’ যেতে ধীরস্থির জীবনেও অস্থির ছিলেন। এখন তিনি সুস্থির। সবকিছুর ঊর্ধ্বে । তবু প্রার্থনার সুরে বলি, পরজনমে সুশাসন-সুচিন্তায় সুস্থির থাকুন।
এএফ/০১