Cinque Terre

মুফতি মুহাম্মাদ আকতার আল-হুসাইন

০৯ মে , ২০২০


লেখক

ইমাম ও খতিব, ওল্ডহাম জামে মসজিদ, যুক্তরাজ্য


রমজান : ইফতারের আনন্দ

রমজান মাস হচ্ছে মুমিন মুসলমানের জন্য একটি আনন্দময় মাস। এ মাস আসলে সবার মনে একটা আনন্দের জোয়ার দেখা দেয়। বিশেষ করে রোজা পালনসহ বিভিন্ন ইবাদত করার ক্ষেত্রে। আর তার মধ্যে অন্যতম একটি ইবাদত ও আনন্দ উপভোগ করার সময় হচ্ছে বান্দা যখন দিন শেষে ইফতার করে। আজ আমরা কুরআন-সুন্নাহর আলোকে সে বিষয়ে খুব সংক্ষেপে জানার চেষ্টা করব ইনশা-আল্লাহ। 

ইফতার কি? ইফতার হচ্ছে আরবি শব্দ। যার অর্থ হচ্ছে ভঙ্গ করা। একজন রোজাদার সুবহে সাদিক থেকে নিয়ে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সব ধরনের খানাপিনা থেকে বিরত থাকার পর হালাল কিছু আহার করে রোজা থেকে বিরতি গ্রহণ করেন। আর তাকেই বলা হয় ইফতার। 

ইফতারের আনন্দ অপার। একজন রোজাদারের জন্য সারাদিন শেষে ইফতারের সময় যখন আসে তখন সত্যিই এটি তাঁর কাছে সবচেয়ে বেশি আনন্দের মূহুর্তে পরিণত হয়। আর এই আনন্দ সরাসরি আল্লাহর পক্ষ থেকেই প্রাপ্ত একটা পুরস্কার। মুসলিম শরীফের হাদিসে এসেছে-‘হযরত আবু হুরায়রাহ্ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- রোজা পালনকারীর জন্য দুটি আনন্দ আছে। একটি তার ইফতারের সময় এবং অপরটি তার প্রতিপালক আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাতের সময়।’

মুসলিম শরীফের হাদিসে এসেছে- ‘হযরত উমার (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- যখন রাত আসে, দিন চলে যায় এবং সূর্য অদৃশ্য হয়ে যায়, তখন সিয়াম পালনকারী ইফতার করবে’। কোন ভাবেই বিলম্ব না করে ইফতারের সময় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইফতার করা হচ্ছে উত্তম। 

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইফতারের সময় বলতেন- আল্লাহুম্মা লাকা সুমতু ওয়া আলা রিযক্বিক্বা আফতারতু। অর্থ- ‘হে আল্লাহ! আমি আপনার উদ্দেশ্যেই রোজা পালন করেছি এবং আপনার দেওয়া রিযিক দ্বারাই ইফতার করেছি’।

আর ইফতার শেষ করে বলতেন, ‘পিপাসা দূরীভ‚ত হয়েছে, শিরা-উপশিরাগুলো সিক্ত হয়েছে এবং ইনশা আল্লাহ প্রতিদানও নির্ধারিত হয়েছে’। 

মুয়াজ্জিন সাহেবের দায়িত্ব হলো যখন আযানের সময় হবে তখন আযান দেওয়া। আবার এদিকে একজন রোজাদার হিসেবে ইফতার বিলম্ব না করা। এমতাবস্থায় তিনি কি করবেন? ফুকাহায়ে কেরামদের মত অনুযায়ী তখন তিনি খেজুর বা পানি দিয়ে রোজা থেকে বিরতি গ্রহণ করে আযান দিবেন। অথবা কিছু না খেয়েও তিনি আযান দিতে পারেন। তবে এমনটি যেন না হয় একবারে পেটপুরে খেয়ে আযান দিলেন অথবা আযান শেষে আরো বিলম্ব করে ইফতার করলেন।

খেজুর দিয়ে ইফতার করা হচ্ছে মুস্তাহাব। খেজুর না থাকলে মিষ্টি জাতীয় কিছু দিয়েও করা যাবে। আর যদি এরকম কিছু না থাকে তাহলে শরবত, পানি বা হালাল যে কোন খাবার দিয়ে ইফতার করে নিতে কোন সমস্যা নেই। তিরমিজি ও আবু দাউদ শরীফের হাদিসে এসেছে- ‘হযরত আনাস ইবনে মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম (মাগরিবের) নামায আদায়ের পূর্বেই কয়েকটা তাজা খেজুর দ্বারা ইফতার করতেন। তিনি তাজা খেজুর না পেলে কয়েকটা শুকনো খেজুর দ্বারা ইফতার করতেন আর শুকনো খেজুরও না পেলে তবে কয়েক ঢোক পানি পান করতেন’। 

রোজাদারকে ইফতার করানো। রমজান মাসে রোজাদারকে ইফতার করানো অনেক সাওয়াবের কাজ। তিরমিজী ও ইবনে মাজাহ এর হাদিসে এসেছে-‘হযরত যায়েদ ইবনে খালেদ জুহানী (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- যে ব্যক্তি কোন রোজাদারকে ইফতার করাবে, সে রোজাদারের সমান নেকীর অধিকারী হবে। আর তাতে রোজাদারের নেকীর কিছুই কমবে না’।

আমাদের সমাজে একটা কু-ধারনা হলো রমজান মাসে যা পার তা খাও, কোন হিসাব নাই! এই কথার উপর ভিত্তি করে মানুষ ইফতারের সময় অনেক কিছু তৈরি করেন এবং অপচয় করেন। মূলত একজন মানুষ কতটুকু খাবে বা পান করবে সেটা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর হাদিস থেকেই পাওয়া যায়। তিরমিজী ও ইবনে মাজাহ এর হাদিসে এসেছে-‘হযরত মিকদাম ইবনু মাদীকারিব (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে বলতে শুনেছি, মানুষ পেট হতে অধিক নিকৃষ্ট কোন পাত্র পূর্ণ করে না।  অপচয় ও অপব্যয় একটি খারাপ অভ্যাস ও নিন্দনীয় কাজ। অপচয়ের সঙ্গে রয়েছে অহংকারের সম্পর্ক। নিজের বাহাদুরি প্রকাশের মনোভাব। অন্যদিকে অপব্যয়ের সঙ্গে রয়েছে শরিয়তের বিধান লঙ্ঘনের সম্পর্ক। অপচয় ও অপব্যয় মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে অবক্ষয় ডেকে আনে। যে কারণে ইসলামে অপচয় ও অপব্যয় দুটিই নিষিদ্ধ। ইসলামী শরিয়ত অনুযায়ী কোনো কাজ বৈধ হলেও সে ক্ষেত্রেও যদি প্রয়োজনাতিরিক্ত ব্যয় করা হয় তবে তাকে ইসরাফ বা অপচয় হিসেবে দেখা হয়। ইসলাম বৈধ কাজেও মাত্রাতিরিক্ত ব্যয় সমর্থন করে না। অবৈধ কাজে ব্যয় করাকে অপব্যয় বলা হয়। অপচয় করা শয়তানের কাজে।  মহান আল্লাহ বলেন হে আমার বান্দারা তোমরা খাও, পান কর ও অপচয় করো না। যেমন এ সম্পর্কে সূরা আরাফের ৩১ নম্বর আয়াতে ইরশাদ হয়েছে- ‘হে বনী আদম, তোমরা প্রতি সালাতে তোমাদের বেশ-ভ‚ষা গ্রহণ কর এবং খাও, পান কর ও অপচয় করো না। নিশ্চয় তিনি অপচয়কারীদেরকে পছন্দ করেন না’। ইসলামে অপচয়-অপব্যয়ের পাশাপাশি কৃপণতারও বিরোধিতা করা হয়েছে। ব্যয়ের ক্ষেত্রে ইসলামে মধ্যপন্থা অনুসরণকে উৎসাহিত করা হয়েছে।

মধ্যবর্তী অবস্থানে থেকে সবগুলো কাজ করা মুমিনের অন্যতম একটি গুণ। 

আল্লাহ তায়ালা রমজান মাসের উছিলায় আমারদের সবাইকে পরহেজগারী হাসিল করার তৌফিক দান করুন। রমজানের রোজাগুলো সঠিক ভাবে আদায় করার তৌফিক দান করুন। রমজানের রাহমাত বারাকাতসহ যা কল্যাণ আছে সবটুকু আমাদের দান করুন। (আমিন)