Cinque Terre

ডা. সুধেন্দু বিকাশ দাশ

১২ মে , ২০২০


প্রাক্তন সহযোগী অধ্যাপক

সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল

বর্তমানে কানাডা প্রবাসী।   


স্বাধীনতা ও মৌলভীবাজারের ঘড়ুয়া গ্রাম

আজ ১২ মে ২০২০ খ্রিস্টাব্দ। স্বাধীনতার ৪৯ বৎসর গড়িয়ে যাচ্ছে। অর্থনৈতিক স্বাধীনতায় রাজনৈতিক প্রচেষ্টা ক্রমাগত হাত পরিবর্তনের কারণে কখনও শ্লথ হয়েছে, কখনও এক পা এগিয়েছে। গোটা মৌলভীবাজারের স্বাধীনতার ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনায় কেউ কেউ ব্রতী হয়েছেন, তা জানা থাকলেও পুর্ণাঙ্গতা কতটুকু পেয়েছে, তা জানার সুযোগ আমার হয়নি। যতটুকু জানতে পেরেছি বা তথ্যগত দিক থেকে তা আমার হৃদয়কে স্পর্শ করেনি, এ কারণেই যে আমিও এক শহীদ পরিবার থেকে এসেছি। এ দৈন্যতা ইতিহাসবেত্তার নয়। মনে করি, এ দৈন্যতা সেই সব শহীদ পরিবারের, যারা নিজেরাই প্রকৃত ইতিহাস রচনার স্বার্থে তথ্যের যোগান দেয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি বা সুযোগ পাননি।

এ দেশের প্রতিটি গ্রামের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মাঝে ১৯৬৯, ১৯৭০ বা ১৯৭১ সালে যে বারুদের স্ফুলিঙ্গ জ্বলে উঠেছিল, তার মাঝে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সহযোগিতা না থাকলে আজকের স্বাধীনতার স্বাদ মহাকালেই হয়ত বিলীন হয়ে যেত। কিছু মুসলিম লীগের লোক, কিছু রাজাকার আর কিছু আলবদর-আলশামস ছাড়া  প্রতিটি পরিবারেরই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভূমিকা স্বাধীনতা সংগ্রামে রয়েছে। এর মাঝ থেকে যেমন প্রয়োজন ছিল আমাদের স্বাধীনতার শহীদদের আর মুক্তিযোদ্ধাদের আমাদের ধরে রাখার। তেমনি প্রয়োজন ছিল গুটি কয়েক রাজাকার, আলবদর ও আলশামস, দুষ্টচক্রের ফসল জাল বা ভুয়া সার্টিফিকেটধারী  মুক্তিযোদ্ধা আর প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের চিহ্নিত করে রাখার। প্রকৃত ইতিহাসের বিকৃতি ঘটার সুয়োগ তখনই কমে যেত যদি এই তিন-চারটে মহলকে আলাদা করে রাখার ব্যবস্থা করে রাখা হতো। তেলে-জলে মিশে গেলে তেল আর জলকে আলাদা করা খুবই কষ্টকর।

স্বাধীনতাকে বা মুক্তিযুদ্ধকে জাতীয়ভাবে না দেখে ছোট্ট একটি গ্রামীণ স্তরে নিয়ে আসলে ও যে ইতিহাস হবে, তা উপস্থাপন করাই আমার উদ্দেশ্য। আমি জন্মেছি বর্তমান জেলা মৌলভীবাজারের শহরতলী ঘড়ুয়া গ্র্রামে। পারিবারিক ইতিহাস যতটুকু জানতে পেরেছি, আমার প্রয়াত পিতা আর শহীদ দাদুদের থেকে, তাতে জেনেছি আমার পরিবারের প্রত্যেকেই শিক্ষকতা পেশায় জড়িত ছিলেন। সেই কারণে হয়ত বাড়িটির একটা আলাদা পরিচয় ছিল ‘পন্ডিত বাড়ি’ বলে । এও জেনেছি বাড়িতেই প্রাথমিক পর্যায়ের একটি স্কুল ছিল। পন্ডিত বাড়ির পন্ডিতেরা তা হলে গ্রামকে তথা সমাজকে দিয়ে গেলেন কি?  আর সমাজ বা গ্রাম থেকে কি পেলেন? পাবার প্রশ্নটি অবশ্যই আসছে না, কারণ জ্ঞান দানের বিনিময়ে কিছু পাবার থাকায় নয়, তবুও প্রশ্নটি বিশেষ একটি কারণেই আসছে। যার উল্লেখ পরেই করার চেষ্টা করব। 

১৯৬৯ সালে আমি মৌলভীবাজার সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্র। ১৯৭০ সালে পাকিস্তান জাতীয় ও গণপরিষদের নির্বাচন এর কিছুই ভুলে যাবার নয়। ভুলে যাবার নয় ২৫ শে মার্চ ১৯৭১ সালে বর্বর ঘাতক পাকবাহিনীর নির্মম বাঙালি নিধন যজ্ঞের কথা ও ২৬ শে মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার কথা। ১৯৭১ সালের এপ্রিলে আমার প্রবেশ করা  কথা ছিল প্রবেশিকা পরীক্ষার হলে, কিন্তু সে প্রবেশ করা অনিশ্চিত হয়ে গেল। পাকিস্তান সৈন্যদের বর্বরোচিত আঘাতের খবরগুলো ইতিমধ্যেই আমরা ‘বিবিসি’ আর ‘আকাশবাণী’র বদৌলতে পেতে থাকলাম। ২৬ শে মার্চ থেকে ২৯ এপ্রিলের মধ্যে আশপাশের গ্রামগুলো থেকে বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের দেশত্যাগের হিড়িক পড়ে গেল। ঘরে আমরই অগ্রজা অনার্সের ছাত্রী। দেশের রাজনৈতিক অবস্থা বিবেচনায় আমাদের জননী কিছুতেই মেয়েকে গ্রামের বাড়িতে রাখা নিরাপদ মনে করলেন না, তাই সিদ্ধান্ত হলো অন্তত আমাকে দিয়ে অগ্রজাকে ভারতে পাঠানো। আমার প্রয়াত পিতা নরেশ চন্দ্র দাশ বড় কষ্টেই রাজি হয়েছিলেন। ১৮ এপ্রিল বারহাল গ্রামের সেন পরিবারের সবাই একটি বাস রিজার্ভ করে ভারতে যাবেন এবং তাঁদের সঙ্গে আমরা দুজনে যাবার কথা হলো, কিন্তু সে দিনে বাসটির যান্ত্রিক ক্রুটির কারণে আর যাওয়া হলো না। বিকালে যখন বাড়ি ফিরে এলাম তখন আমাদের বাবা প্রচণ্ড রকমের খুশি হলেন এই জন্যে যে, বাবা তাঁর পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবার মতো পরিস্থিতি থেকে দুটি সন্তানকে কাছে ফিরে পেয়েছেন। পরিবারের প্রত্যেককে নিয়ে বেঁচে থাকলে এই দেশেই বেঁচে থাকবেন আর মরলেও এ মাতৃভূমিতেই, এই তাঁর ইচ্ছে। কিন্তু আমার মা কোনোভাবেই একমত হতে পারলেন না বাবার সঙ্গে আর তাইতো ১৯ এপ্রিল বোনকে নিয়ে দেশত্যাগ করলাম। ভারতের কৈলাশহর শহরে গিয়ে উঠলাম। নাম লেখালাম বাংলাদেশী উদ্ভুিদ্ধ আর ভারতীয় শরণার্থী হিসেবে। 

২৬ মার্চের পর কিছুদিন পাকিস্তানী সৈন্য মৌলভীবাজারে ছিল না তাদের আত্মরক্ষার কারণেই। আমরা ভারতে যাবার সপ্তাহ দিনের মধ্যেই আবার মৌলভীবাজার পাকিস্তানী সৈন্যের নিয়ন্ত্রনে চলে এলো, অতএব সীমান্ত বন্ধ। আর ফিরে আসা যাবে না নিজ গৃহে,  বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম পিতা-মাতা, ভাইবোন আর দাদু-ঠাকুমা থেকে। পরিস্থিতি এমন হবে বুঝতে পারিনি, অর্থাৎ আটকে গেলাম ভাইবোন আমরা দুজনে ভারতেই। মা-বাবা অন্য ভাই-বোনেরা আর দাদু-ঠাকুমা আটকে গেলেন গ্রামের বাড়ি ঘড়ুয়াতেই। ওপার থেকে যেমনটি সংবাদ পেতে থাকলাম, তাতে ধারণা করতে হলো হয়ত জন্মভূমিতে কোনোদিনই ফিরে আসা হবে না, আর জন্মের মতো হারালাম গ্রামের বাড়িতে রেখে যাওয়া পরিবারের প্রত্যেকেই। এমন অনশ্চিয়তার মধ্যে ত্রিপুরা ছেড়ে পাড়ি জমাতে হলো দিল্লিতে কাকাদের কাছে। কেমন ওলট-পালট হয়ে গেল হয়ে গেল জীবনের ধারা!

প্রবেশিকার দ্বারে আর প্রবেশ করা হলো না। একদিকে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম, অন্যদিকে পরিবারের প্রতিটি মানুষের জন্য মানসিক যাতনা। এরই মধ্যে কাকাবাবুর নির্দেশ আমাকে কাজের মধ্যে রাখা এবং স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেয়া হলো। আমাকে দিল্লির ‘ইউনিয়ন একাডেমি হাইয়ার সেকেন্ডারি’ স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেয়া হলো। যথারীতি স্কুলে যাতায়াত শুরু করলাম, তবে দশম বা একাদশ শ্রেণিতে নয় অষ্টম শ্রেণিতে। দিল্লিতে বসে স্বাধীনতা যুদ্ধের সংবাদ সংগ্রহ করা তখন বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপারই ছিল। এরই মধ্যে ‘রেডিও পাকিস্তান’ থেকে পাকবাহিনীর মনোবল আর অব্যাহত বিজয় আর ‘আকাশবাণী’ থেকে মুক্তি বাহিনীর বিভিন্ন রনাঙ্গণের সফল অভিযানের খবর। স্কুলে যাওয়া আসার পথে ‘গোল মার্কেট’-এর কিছু বইয়ের দোকানে একদিন আবিষ্কার করলাম, ‘স্বাধীন বাংলা’ নামের একখানি সাপ্তাহিক বাংলা পত্রিকা। মহা আনন্দে পত্রিকাখানি কিনলাম, কিন্তু পরের সপ্তাহেই যখন আর পত্রিকাখানি পেলাম না, তখন আমার মনের কষ্ট কে দেখে? বাংলাভাষী ছেলেটির হিন্দিভাষী এলাকায় মিশতেও কষ্ট। দুশ্চিন্তায় অতলে দিনে দিনে মনোবল ক্ষিণ হতে লাগলো। দিল্লিতে কাকার পরিবারের সবাই ধরেই নিলেন গ্রামের বাড়ি ঘড়ুয়াতে আর কেউ বেঁচে নেই। দিল্লি থেকে মৌলভীবাজারের ঘড়–য়া গ্রামের খবর সংগ্রহ করার কোনো উপায়ই নেই। দেশ ত্যাগ করলাম এপ্রিল মাসে। মে-জুন-জুলাই-আগস্ট মাস কাটল।

ইতিমধ্যে ত্রিপুরার এক আত্মীয় একটি আগরতলা ভিত্তিক পত্রিকার উদ্ধৃতি দিয়ে জানালেন যে, দুই দাদু সারদা চরণ দাশ, অন্নদা চরণ দাশ আর আমার পিতা নরেশ চন্দ্র দাশ পাকিস্তানী আর্মির গুলিতে নিহত হয়েছেন। পরিবারের বাকি সদস্যেদের কোনো সংবাদ দিতে পারলেন না। যাক, জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহের বাবার হাতের লেখা একখানি চিঠি পাওয়া গেল। চিঠিখানি প্রচুর কষ্ট করে তারই একজন ছাত্র যিনি আগস্ট মাসে ভারতে পালাতে সক্ষম হয়েছিলেন, তার কাছ থেকে পাওয়া। বাবার ছাত্রের বর্ণনা মতে আর বাবার হাতের লেখা চিঠিখানি পড়ে জানা গেল যে, ১২ মে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানী হানাদার পাকসেনা মৌলভীবাজার শহর হতে স্বাধীনতাবিরোধী মুসলিম লীগার আর রাজাকারের নেতৃত্বে, প্ররোচনায় আর সহযোগিতায় এবং নিজ গ্রাম ঘড়ুয়ার কয়েকজন সহযোগীসহ আমাদের গ্রামের বাড়ি আক্রমণ করে। যে মাতৃভূমিকে আকড়ে থেকেছিলেন তাঁরা, সেই মাতৃভূমিতে মরতে হলো, অর্থাৎ নিজ বাড়িতেই গুলি করে পাক সেনারা হত্যা করলো পন্ডিত পরিবারের দুজনকে, পন্ডিত সারদা চরণ দাশ আর পন্ডিত অন্নদা চরণ দাশকে। পরিবারের অন্যরা এদিক-ওদিক পালিয়ে ওইদিন আত্মরক্ষা করতে পেরেছিলেন। মাতৃভূমিতে এঁরা শহীদ হলেন, কিন্তু মাতৃভূমিতে তাদের শেষকৃত্য করা সম্ভব হয়েছিল কি না, সে প্রসঙ্গেও পরে আসব।

অবশ্যই প্রশ্ন জাগবে পাকিস্তানী সৈন্য কীভাবে ঘড়ুয়া গ্রামের এই বাড়িটিকে খুঁজে বের করতে পারলো? বাবার হাতের লেখা চিঠিখানি পেয়ে দিল্লিতেই প্রয়াত অথবা শহীদ দাদুদের উদ্দেশ্যে ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান করা হলো দিল্লির কালী বাড়ীতে। বুঝে গেলাম, যাঁরা সারা জীবন অপরের জীবনে জ্ঞানের আলো জ্বালাতে চেষ্টা করেছেন, তেমন দুটি দীপকে নিভিয়ে দেয়া হয়েছে। পাক সেনাদের চেনার কথা নয় বাংলাদেশের এই  প্রত্যন্ত গ্রামের অভাগা সন্তান দুজনকে। গ্রামের কাছে, সমাজের কাছে, দেশের কাছে যে সন্তানেরা আলো জ্বালাতে ব্রতী ছিলেন তাঁরা শহীদ হলেন। পরবর্তীকালে শুনেছি যে, মৌলভীবাজার হতে যিনি হত্যাযজ্ঞে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন আর নিজ গ্রাম ঘড়–য়া হতে যারা সহযোগী হয়েছিলেন, তারা প্রত্যেকে নাকি পন্ডিত সারদা চরণ দাশ ও পন্ডিত অন্নদা চরণ দাশের একসময়কার ছাত্র ছিলেন। শিক্ষা বিস্তারে আর জ্ঞান দানে যে ভূমিকা পন্ডিত অন্নদা চরণ দাশ ও পন্ডিত সারদা চরণ দাশ রেখেছিলেন, ১৯৭১ সালের ১২ মে মৃত্যুকে  বরণ করেই প্রতিদান পাওয়া গেল তাদেরই সুযোগ্য ছাত্রদের কাছ থেকে।

অতি আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে, স্বাধীনতার রজতজয়ন্তী উদযাপিত হয়েছে, আসছে হীরকজয়ন্তী কাল, কিন্তু এতগুলো বছর পেরিয়ে যাবার পরও আমার সেই সাহসটুকু নেই, যে স্বাধীনতাবিরোধী নেতৃত্বদানকারী আর সহযোগীদের কারণে ঘড়ুয়া গ্রামের পন্ডিত সারদা চরণ দাশ এবং অন্নদা চরণ দাশ শহীদ হলেন, সেই আলবদর, রাজাকার শান্তি কমিটির সদস্য চক্রদের নাম উচ্চরিত করব। কেন আমার সাহস নেই, এ প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে নেই অথবা একটাই আছে যে, আমি আজ গ্রাম-সমাজ আর দেশে সেই সাহসী অবস্থানে নেই যে আমি বলে যেতে পারবো। ছোট পরিসরের হলেও আমার গ্রাম আমার শহরের নতুন প্রজন্মকে সেই স্বাধীনতাবিরোধীদেরকে চিহ্নিত করে রাখার দায়িত্ব হয়ত আমারই ছিল। আমি শহীদ হতে চাইনি, তাই আমি ভীরু।

দিল্লিতে বসে স্বাধীনতা যুদ্ধরত দেশের গ্রামের বাড়ির কোনো সংবাদ এর পর আর পাবার সুযোগ হলো না।  দিল্লি শিক্ষা বোর্ডের অনুমতিতে আমি ইউনিয়ন একাডেমি হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলে নবম শ্রেণিতে পড়বার সুয়োগ পেলাম। স্কুলের প্রিন্সিপাল শ্রদ্ধেয় বিভূতি ভূষন ঘোষ মহাশয় কুমিল্লার লোক ছিলেন। অনেক আগেই দেশ ত্যাগ করেছেন। প্রথম যে দিন তাঁর দিল্লির বাসায় আমাকে স্কুলে ভর্তির প্রচেষ্টা হিসেবে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, সে দিন তিনি বলেছিলেন, প্রবাস জীবন বড়ই কষ্টের, মাতৃভূমি ত্যাগ আরো কষ্টের, তা তিনি গত ৩০ থেকে ৩৫ বছর থেকে বুঝতে পারছেন। কথাটি আজও আমার কানে বাজে। স্কুলের প্রত্যেক টিচারের কাছেই বাংলাদেশী ছেলে বলে একটা অতিরিক্ত স্নেহমমতা পেতাম। ভালো হিন্দি বলতে পারতাম না, কিন্তু স্কুলের হিন্দিভাষী টিচারাও আমার খোঁজ নিতেন। বাংলাদেশর মুক্তিযুদ্ধের অবস্থা, বিভিন্ন তথ্য আমার কাছ থেকে জানতে চাইতেন। অনেক সময় দোভাষী নিয়োজিত করে হলেও আমাকে কথা বলাতে চাইতেন। দিন-কাল গড়িয়ে ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর এলো। ১৩, ১৪ অথবা ১৫ ডিসেম্বর অন্তত একইটুকু বুঝে গেলাম যে, হয়ত আমার পরিবারে আর কেউ বেঁচে নেই, হয়ত আমার গ্রাম নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে, হয়ত আমার দেশ আকৃতি হারিয়ে বিকৃতি লাভ করেছে, তবুও আমরা স্বাধীন হচ্ছি।  

১৬ ডিসেম্বর ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে পাক বাহিনীর আত্ম সমর্পণের দলিল সাক্ষরের সংবাদ দিল্লিতে আমরা আগেই পেলাম এবং আমরা স্কুলে বসেই শুনেছি। দুপুরের পরেই স্কুলের প্রিন্সিপালের নোটিশ ক্লাসে ক্লাসে আসলো। বাংলাদেশে পাকবাহিনী আত্মসমর্পণ করাতে এবং বাংলাদেশে বিজয়ের কারণে ওই দিন পরবর্তী সময়ের জন্য স্কুল ছুটি ঘোষণা করা হলো। ছাত্রদের সবাইকে জড়ো করে স্কুলের প্রিন্সিপাল এও বললেন যে, ‘আজকে বাঙালি এক গৃহিণীর কাছে লজ্জা পেয়েছি এবং সে লজ্জা মাথা পেতে নিয়েই স্কুলের ছুটি ঘোষণা করেছি।” ওই বাঙালি নারী নাকি বলেছেন, প্রিন্সিপালবাবু, ওদিকে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে গেল আর স্কুলে আপনি ছেলেদের নিয়ে বসে আছেন। পরে ব্যক্তিগতভাবে জানলাম যে, সেই বাঙালি নারী আমাদের একসময়কার শ্রীমঙ্গলের বিশিষ্ট হিন্দু হোম পরিবারেরই একজন, যারা অনেক আগে দিল্লিতে সেটেল করেছেন। পরের দিন স্কুলে গিয়ে দেখি বাংলাদেশের এই বিজয় উপলক্ষে স্কুলের মাঠে ছাত্র-শিক্ষক মিলে এক উৎসব আর বক্তৃতার পালা। সে দিনটি আমার কাছে স্মরণীয় অনেকভাবেই, আমি স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হয়ে অনুষ্ঠানে থেকেছি, আমার দেশের জন্য বিদেশিদের আনন্দ আর সর্বোপরি স্কুলের এক ‘শিখ’ টিচারের আগুনঝরা বক্তৃতা। সেই শিখ টিচারের আবেগপ্রবণ বক্তৃতাটি আজও ভুলিনি।

আমি মুক্ত। আমি স্বাধীন দেশের নাগরিক। আমি পাকিস্তানের সর্বশেষ এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিলাম। আমি দিল্লির ইউনিয়ন একাডেমি হাইয়ার সেকেন্ডারি স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্র। ইতিমধ্যে দিল্লিতে অনেক বন্ধু সৃষ্টি হয়েছে। দিল্লিতে প্রবাসী পরিবারের প্রতিটি সদস্য আর বন্ধুদের আদেশ-উপদেশ আর অনুরোধ পড়াশোনার বাকি পাঠটি দিল্লিতে সেরে ‘ওদেশেই’ থেকে যাওয়া। কিন্তু ১৭ ডিসেম্বরের পরে আর আমি স্কুলে যেতে পারিনি। কেউ আমাকে স্কুলে পাঠাতে পারেনি। আমি আমার দেশে আমার গ্রামেই আসব। দিন আর কাটতে চাইছিল না।

এরই মধ্যে ১০ জানুয়রি ১৯৭২ এলো। ৯ জানুয়ারি বিকেলেই ‘আকাশবাণী’তে ঘোষনা হলো দিল্লির  রামলীলা ময়দানের জনসভায় বঙ্গবন্ধু ভাষণ দেবেন। যে কোনোভাবেই আমার ১০ জানুয়ারি রামলীলা ময়দানে যাওয়া চাই। বন্ধুদের নিয়ে ভোর রাতে টিফিন বাক্সে রুটি-সবজি নিয়ে রামলীলা ময়দানে উপস্থিত হলাম। বঙ্গবন্ধু এলেন। মনে এলো আমার পূর্ণ স্বাধীনতা। স্টেজে উঠেছেন বঙ্গবন্ধু আর আমার  মনে হলো আমি নিজ দেশেরই রেসকোর্স ময়দানে হয়তো। সে দিনের সে কিশোর বয়সের আনন্দ আর আবেগকে ধরে রাখতে পারিনি। নিজের অজান্তেই চোখে দু-ফোঁটা জল এসেছিল। বঙ্গবন্ধু বক্তৃতা শুরু করলেন। ইংরেজিতে শুরু করলেন এভাবে ‘মাই ব্রাদার্স অ্যান্ড সিষ্টারস অব ইন্ডিয়া’। অমনি জনতার মধ্যে থেকে আওয়াজ এলো ’বংগালিমে’ ’বংগালিমে’। অবাঙালি জনতার ভিড়ে মাঠ উপচে পড়ছে। আর এই আবাঙালিদের মধ্যে থেকেই ’বংগালিমে’। যাই হোক বংগবন্ধু এবার বাংলাতেই দিল্লির রামলীলা ময়দানে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখলেন। আমার সঙ্গের স্কুলের বন্ধু অবাঙালি বন্ধুরা বাংলায় বঙ্গবন্ধু বক্তৃতা কি বুঝল জানি না, তবে তারা বলেছিল, ‘শেখসাবনে এসা আচ্ছা স্পিছ দিয়া থা’। তারপরেও আমার মনে হলো, অবাঙালি কিশোরদের কাছে এই বাংলা বক্তৃতাটুকু প্রচুর আবেদন সৃষ্টি করতে পেরেছিল। যেমনি ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর রেসকোর্সের বক্তৃতা বাংলাদেশের স্বাধীনতাতে গণজাগরণ সৃষ্টি করেছিল।

১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ সালে নিজের স্বাধীন দেশে বীরের মতো ফিরে এলাম। চন্দ্রালোকিত কুয়াশাভরা রাত্রিতে গ্রামের বাড়ি ঘড়ুয়াতে ফিরে এলাম। যে বীরের এত আনন্দ ছিল মনে স্বাধীন দেশ পেয়ে, হতাশ হলাম এই দেখে যে গোশালাসহ ৭ খানি ঘরের বাড়িতে টিকে আছে শুধু গোশালাই। যে গোশালাখানি মূল বাড়ির ঘরগুলো থেকে একটু দূরে ছিল। বাড়িতে যা আছে এই গোশালাটি এবং এর চারপাশে বেড়া দিয়ে সুপুরি গাছের মাচাঙে চরম দুর্বিসহ দিনগুলো কাটিয়ে আমার পরিবারের বেঁচে যাওয়া মা-বাবাসহ ৭ জন সদস্য। এঁদের সঙ্গে যোগ হলাম আরও দুজন। সে রাত কাটল সেই ভয়াল দিনগুলোর গল্প শুনতে শুনতেই।

এবার আসি মূল প্রসঙ্গে। সেদিন, মানে ১৯৭১ সালের ১২ মে দুজন পাকসেনাকে নিয়ে মৌলভীবাজারের স্বাধীনতাবিরোধী মূল নেতৃত্বে আর পাশের গ্রামের এবং নিজ গ্রামের বেশ কজন এলেন আমাদের বাড়িতে। বাড়ির সামনে দিয়ে আসলেন দেশের স্বাধীনতাবিরোধী সেই ‘রাজা’সহ কিছু সহযোগী এবং একজন পাকসেনা। আর দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে আসলেন একজন পাকসেনা কয়েকজনসহ। পাকসেনাসহ অনেক লোক বাড়ি আসতে দেখে আত্মরক্ষার্থে কে কোন দিকে গেলেন, তা আর ঠিক রইলো না। পন্ডিত সারদা চরণ দাশ কাঠ-টিনের তৈরি সামনের ঘরের বারান্দায় বসে তামাক টানছিলেন চেয়ারে বসে। হয়ত ভেবেছিলেন, যারা আসছে তারা তারই ছাত্রদের মধ্যে থেকে হবে, কাজেই বন্দুকের নল কেউ তাদের দিকে উঁচিয়ে ধরবে না। পন্ডিত সারদা চরণকে পাকসেনারা আগে চিনত না। পাকসেনা তাদের সঙ্গের  দেশবিরোধী চক্রটিকে জিজ্ঞেস করেছিল, কি করবে? ইঙ্গিতে পন্ডিত সারদা চরণের একসময়কার ছাত্র শেষ করে দিতে বলেছিলেন। আর দেরি হলো না। অবসান ঘটল পন্ডিত সারদা চরণ দাশের জীবনের। ঢলে পড়লেন সারদা চরণ। শুধু তাই নয়, কাঠ-টিনের ঘরে আগুন জ্বালিয়ে আগতদের উল্লাস অনেক নীরব দর্শক থেকে পাওয়া গেছে। সে দিন সারদা চরণ দাশের শরীরের নীচের অর্ধেক জ্বলে গিয়ে কার্বনে পরিণত হয়েছিল, বাকি অর্ধেক তাতিয়ে রয়ে গেল। সামনের গুলির শব্দ শুনে বাড়ির পিছন থেকে দক্ষিণ দিকে আত্মরক্ষার্থে দৌড়ালেন পন্ডিত অন্নদা চরণ দাশ। মাথায়, বুকে, উরুতে কয়েকটি গুলি লাগলো আর তীব্র আর্তনাদে চৈত্রের ঝরা পাতার মতো পন্ডিত অন্নদাচরণ দাশের জীবনখানি ঝরে গেল। আমার ঠাম্মা, বয়সভারে গুজোবুড়ি অসহায়ের মতো বাড়ির উত্তর-পূর্ব কোণা দিয়ে এগুতে লাগলেন। যাঁর হেঁটে যাবার শক্তিটুকু ছিল না, তিনি কোনো পড়ন্ত একটি বিরাট গাছের আড়ালে ১২ মে-র ভয়াল সে রাত্রি যাপন করলেন। না নিজের কেউ, না অন্য কেউ এই গুজো বুড়ির খোঁজটি নিতে পেরেছিল।

আমার বাবা-মা, ভাই-বোনরা আত্মরক্ষার্থে কে কোন দিকে গেলেন, একে অন্যে জানলেন না, তবে কেউ-ই বাড়ির দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পশ্চিম দিক দিয়ে যাননি বলে প্রত্যেকে বেঁচে গেলেন। ১২ মে দিনটি গেল। পন্ডিত বাড়ির বেঁচে যাওয়া সদস্যরা দূরে যে যেখানে ছিলেন, প্রত্যক্ষ করেছেন নিজের বাড়িতে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। কে বেঁচে আছেন আর কে নেই, তাও রাত ৮ থেকে ৯ পর্যন্ত কারো জানার সুযোগ হলো না, কারণ একেকজন একেক গিয়ে উঠেছেন। গ্রামের প্রতিটি হিন্দু বাড়ি এমনকি আমাদের পাশের মুসলিম বাড়িতেও কেউ থাকলো না। আত্মরক্ষার্থে যে যেদিকে পারল চলে গেল আর প্রত্যক্ষ করল আগুনের শিখা । ১২ মে দিন-রাতভর আগুন জ্বলছে। ১২ মে রাত ১১ থেকে ১২টার দিকে আমাদের ঠাম্মা ছাড়া বাকি সবাই একত্রিত হয়েছিলেন বারহাম গ্রামে। ৯ সদস্যের হিন্দু পরিবার থেকে ঝরে গেলেন ৩ জন, এটাই হিসাব করা হলো ওই রাতে।

পরের দিন ১৩ মে অত্যন্ত সন্তর্পণে বাবা-ভাই এঁরা বাড়িতে এলেন। জীবনের হিসাব-নিকাশ মিলাতে মিলাতে দুঃখ-হতাশা-মৃত্যু ছাড়া সামনে কিছুই দেখলেন না। বাড়ি ঢুকে দেখা গেল পন্ডিত সারদা চরণ দাশকে পাক সেনা গুলিবিদ্ধ করে মেরেছে। তাঁর সৎকারের অর্ধেক কাজটিও করে রেখেছে। কাঠ-টিনের ঘরটির বারান্দায় বসা ছিলেন পন্ডিত সারদা চরণ। গুলিবিদ্ধ হয়ে বারান্দায় শরীরখানি এমন অবস্থা নিয়েছে যে, আগুন ধরা ঘরখানি তাঁর শরীরের  নিম্নাঙ্গের অন্তোষ্টিক্রিয়ার প্রযোজন সেরে নিয়েছে। অন্তোষ্টিক্রিয়া যদি করতে হয় তবে ওই ঊর্ধ্বাঙ্গের করতে হবে। এমন বিভৎস অবস্থা আমি দেখতে পাইনি, কিন্তু শুনে গা শিউরে উঠে। এই কি গুরুদক্ষিণা? এই কি প্রতিদান? বাড়ির দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে আবিষ্কৃত হলো পন্ডিত অন্নদাচরণ দাশের মৃত দেহ। অন্নদাচরণের মাথার খুলি, বুক আর পায়ে পাওয়া গেল অসংখ্য গুলি আর রাত্রিকালীন মাংসাশী প্রাণীর নরমাংস ভোজনের চিহ্ন।

গ্রামের আশপাশের বাড়ির প্রতিটি লোক আত্মরক্ষার্থে পলাতক। এই দুই শহীদ নিজের ভিটে ত্যাগ করেননি এই জন্যে যে, মাতৃভূমিতেই  শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করবেন। এই দুই শহীদের ইচ্ছা পূরণতো অন্তত হলো। পাশের হিন্দু বাড়ি দুটোর পুরুষ সদস্যরা এলেন। এলেন পূর্ব পাশের বাড়ির আমার ব্যক্তি জীবনের পরম শ্রদ্ধেয় বড় ভাই জনাব আব্দুর রহমান এবং অন্য কয়েকজন। আমার বাবা নরেশ চন্দ্র দাশ, যিনি পেশায় শিক্ষক ছিলেন, বড়ই হতাশ হয়ে পড়লেন কি করবেন কোথায় যাবেন এমনি একটি অবস্থায়। না শেষ পর্যন্ত সবাইকে যে সিদ্ধান্ত নিতে হলো, তা যে সেই মৃতার সৎকারের চেষ্টা করতে গিয়ে কেহই জীবনের ঝুঁকি নিতে চাননি। ধর্মীয় বিধানে এঁদের অন্তোষ্টিক্রিয়া করতে গেলে যারা এর সঙ্গে জড়িত থাকবেন, তাদের জীবনও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যেতে পারে যে কোনো মূহুর্তে। তাইতো পন্ডিত সারদা চরণ দাশ ও অন্নদাচরণ দাশকে আর নিজের বাড়ির মাটিটুকুও চাইল না। তাঁদের নশ্বও দেহ দুটির দাহ হবে তাঁদের বাবা-দাদার পাশে, তা আর হবার নয়।

করা যাবে কি শেষ পর্যন্ত? এ বাড়ি ও বাড়ি থেকে সংগ্রহ করা হলো চাটাই, তাতে মুড়িয়ে মনু নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হলো পন্ডিত সারদা চরণ দাশ আর পন্ডিত অন্নদাচরণ দাশের দেহ দুটি, এই আশাতেই যে, যদি কোনোদিন এঁদের মরদেহ দুটি গঙা অথবা যমুনায় পৌঁছে যেতে পারে, তা হলে মৃতের প্রতি সর্বশেষ ধর্মীয় নিয়ম যা উত্তরাধিকারীর পালন করতে হয়, তা আর তাঁদের উত্তরাধিকারীদের করতে হবে না। এ তাঁদের দুর্ভাগ্য। দেশকে আঁকড়ে থাকার দৃষ্টান্ত আর কি হতে পারে? 

৩৯ বছর অতিক্রান্ত হলেও এ করুণ কাহিনি লিখে যাবার সুয়োগ আমি পাইনি।  ৩৯ বছর অতিক্রান্ত হলেও আমি দেখিনি স্বাধীনতার সপক্ষের কোনো কর্তাস্থানীয়কে ঘড়ুয়া গ্রামের সেই শহীদদের ভিটেতে বা শুনিনি কারো তরফ থেকে কোনো শোকবাণী শোনাতে। কথা অনেকই আছে, কিন্তু কথা বলারও সুযোগ লাগে, সময় লাগে। ৩৯ বছর যেহেতু বলতে পারিনি তাইতো নতুন প্রজন্মকে জানিয়ে যাবার জন্যে প্রয়োজন। কিন্তু কই? তাও পারলাম না! কোনো সময় যেন আমার সে সাহস হয়, সে পরিবেশ যেন আমার জীবদ্দশায় পাই। নয়তো আমার ভবিষ্যৎ প্রজন্ম অবশ্যই সে সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে। আমার  গ্রামের অনেকেই আছেন বা ছিলেন, যাঁরা অত্যন্ত কাছে থেকে প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পেয়েছিলেন পন্ডিত বাড়ির হত্যাযজ্ঞকে। এ কাহিনির জন্যে আরও যাঁদের এগিয়ে আসা উচিত বলে মনে করি এবং আমার থেকে অনেক বেশি সাহস রাখেন, তাঁদের কাছে আমার অনুরোধ, এগিয়ে আসুন, তা না হলে স্বাধীনতার অনেক জলন্ত সত্য চাপা পড়ে যাবে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশে এলেন ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ আর আমাদের দিল্লি হতে ঘড়–য়া আসতে হয়েছিল ফেব্রæয়ারিতে। আত্মীয়-অনাত্মীয় বন্ধু-বান্ধবের অনেকেই আমাকে দিল্লিতে স্থায়ীভাবে আটকে রাখবার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু জন্মভূমির টানেই ফেব্রুয়ারির ১৪ তারিখে ঘড়ুয়া ফিরে এলাম আমরা ভাই-বোন। জকিগঞ্জ হয়ে এক জ্যেৎাস্নালোকিত রাতে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরলাম। অবাক বিস্ময়ে রাতের আলোতেই দেখলাম, ১৯ এপ্রিল ১৯৭১ সালে রেখে যাওয়ার আমার জন্মভূমির ভূমিই আছে, তবে তা পাক সেনাবাহিনী আর স্থানীয় স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের আনন্দ-উৎসবের খেলায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে বাড়ির প্রতিটি গৃহ। একটিমাত্র গোশালা রক্ষা পেয়েছিল, তা মূল ঘরগুলো থেকে একটুখানি দূরে ছিল বলেই হয়তো রক্ষা পেয়েছে। অতএব গোশালাতে সুপারি গাছের বক্কলের উপর চাটাই বিছিয়ে দিনাতিপাত। আমার প্রয়াত পিতা নরেশচন্দ্র দাশ বেঁচে থাকার তাগিদেই বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে চাকুরিতে যে অসহযোগ করেছিলেন, তার অবসান ঘটালেন। কারণ, সাহসে বুক বেঁধে যে বেঁচে থাকতে হবে আর দেখে যেতে হবে স্বাধীনতার লাল সূর্যকে। এভাবে বেঁচে থাকার মাঝেও কতবার ‘এই পাকসেনা এলো’ বলে কতলোক যুজুর ভয় দেখিয়েছে আর কতবার গৃহত্যাগ করতে হয়েছে তার নাকি হিসাব ছিল না।

জাতীয়তাতে বাঙালি হিন্দু বলেই দেখা গেছে আমার প্রয়াত পিতার অত্যন্ত বাধ্য এবং অনুগত সেরা ছাত্রটিও বার কয়েক মুগুর হাতে নিয়ে বশ্যতা স্বীকার করাতে প্রচুর চেষ্টা করেছেন। বাড়ি ফিরে এসে এতই অসহায় হয়ে পড়লাম যে, সংসারে আছে বলে কিছু নেই, আছে শুধু নাই নাই আর নাই। এই নাই আর নাাই এর মধ্যে পিতার ৫ জন স্কুল কলেজ পড়ুয়া সন্তান। এর পরের অনেক কিছুই বলার আছে বা ছিল, কিন্তু তা আত্মজীবনী পর্যায়ের হয়ে যাবে, তাই আমার জীবনের সময়-সুযোগে লিখে যাবার চেষ্টা করব। তবে ব্যক্তি জীবনের দেখা একটুখানি না বলে গেলে অপরাধী হয়ে যাব আমার কাছেই।

স্বাধীনতা এবং স্বাধীনতা পরবর্তী দিনগুলোতে আমাকে পাশের বাড়ির পরম শ্রদ্ধেয় বড় ভাই জনাব হাজী মো. আব্দুর রহমান সাহেবের প্রত্যক্ষ আর পরোক্ষ সাহায্যে সহযোগিতা না পেলে ঘড়ুয়া গ্রামে স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময়ে এমনকি স্বাধীনতা পরবর্তী অত্যন্ত দুর্যোগময় আর বিবাদজনক মূহুর্তগুলোতে পন্ডিত বাড়ির সদস্যেদের টিকে থাকার কোনোভাবেই সম্ভব হতো না। আমি মশিজীবী হতে পেরেছি তাঁরই জন্য। আমি ঋণী, তার অপরিশোধ যোগ্য দানের কাছে।

শহীদ পন্ডিত সারদা চরণ দাশ আর পন্ডিত অন্নদা চরণ দাশের স্বাধীনতার লাল সূর্যের জন্য যে আত্মাহুতি, তার জন্য অন্তত গ্রাম হিসেবে ঘড়ুয়া বলতে পারবে, আমি মুক্তিযোদ্ধার জন্ম না দিতে পারলেও দুজন শহীদের জন্ম দিয়েছি। আর আমি লেখক ধন্য এ জন্যে যে, আমি জন্মেছি বাংলাদেশের ৬৮ হাজার গ্রামের এক প্রখ্যাত গ্রামে, যে গ্রাম রক্তস্নাত শহীদ সারদা চরণ আর অন্নদা চরণ দাশের রক্তে। জয় হোক তোমাদের হে গোলকপুত্র শহীদ সারদা চরণ ও শহীদ অন্নদা চরণ।