Cinque Terre

শাহ ফখরুজ্জামান

১৭ মে , ২০২০


আইনজীবী ও সাংবাদিক


ভার্চ্যুয়াল কোর্ট : কঠিন কিছু নয়

প্রযুক্তির আগমন এবং বিবর্তনকে আমরা ভয় পাই। কিন্তু বালির বাঁধ দিয়ে যেভাবে বান ঠেকানো যায় না, তেমনিভাবে প্রযুক্তির উৎকর্ষতাকেও দমিয়ে রাখা যায় না। এটি নিজেই নিজের অবস্থান তৈরি করে নেয়। যারা প্রযুক্তির আগমনকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নিয়ে এর সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন, তারাই সফল হন। ঠিকে থাকেন। 

আমাদের দেশে ব্যাংকের মাধ্যমে টিটি আর ডিডি পাঠানোর ইতিহাস খুব বেশি পুরনো নয়। কিন্তু এখন অনলাইন ব্যাংকিং আর এটিএমের ব্যবহারকেই স্বাভাবিক ব্যাংকিং মনে করেন সবাই। আরও অনেক ক্ষেত্রেই বড় ধরনের বিবর্তন হয়ে গেছে। কিন্তু আমাদের দেশের বিচার বিভাগে নতুন প্রযুক্তির আগমন যেভাবে নাড়া দিয়েছে, তা আর কোনো ক্ষেত্রের বিবর্তনে দেয়নি।

আমাদের দেশের সিভিল ইঞ্জিনিয়ার আর আর্কিটেক্টরা বহু আগেই হাতের করা ড্রয়িংয়ের পরিবর্তে অটোক্যাড সফটওয়্যার ব্যবহার শুরু করেছেন। ডাক্তাররা শুধু টেলিমেডিসিনই দেন না, নতুন নতুন প্রযুক্তি আর যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে আপডেটও হচ্ছেন। প্রশাসনের ই-নথি আর পুলিশের প্রযুক্তির ব্যবহারও বেশ আগের ঘটনা। শিক্ষকরাও মাল্টিমিডিয়া আর পাওয়ার পয়েন্ট ব্যবহার থেকে অনলাইনে ক্লাস নিতে শুরু করেছেন। টেলিভিশন সাংবাদিকরাও বাসে করে আর ক্যাসেট পাঠান না। ঘটনাস্থল থেকে লাইভ করছেন। বড় বড় হুজুররা ইউটিউবে ওয়াজ নসিহত করে তা ভাইরাল করে ডলার কামাচ্ছেন। শিক্ষার্থীরা অনলাইনে আবেদন করে ভর্তি হওয়ার পর এখন চাকরির আবেদনও অনলাইনে করছেন। চালকরা উবার, পাঠাও ব্যবহার করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। কৃষকরা অ্যাপসের মাধ্যমে সরকারি গুদামে ধান দেওয়ার আবেদন করছেন। তারা ব্যবহার করছেন হারভেস্টার, রিপারসহ অনেক মেশিন।

আর আমরা যারা আইনজীবী, কী করি? সবাই আমাদের বিজ্ঞ সম্বোধন করে। অথচ আমরা বড় ধরনের হোঁচট খেলাম ভার্চ্যুয়াল কোর্ট নিয়ে! তবে ওই যে বললাম বালির বাঁধ বান আটকাতে পারে না; শত বাধা-বিপত্তির মাঝেও এই ভার্চ্যুয়াল কোর্ট অতি অল্প সময়ে আপন আলোয় উদ্ভাসিত হয়েছে। আমরা আইনজীবীরা আমাদের মেধা, দক্ষতা আর যোগ্যতা দিয়ে দুর্যোগকালের অল্প সময়েই পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়েছি। বেশির ভাগই নিজের মতো করে যোগ দিচ্ছেন। অর্থাৎ হোঁচট একটা খেলেও মুহূর্তেই স্থির হয়ে দাঁড়িয়েছি।

ভার্চ্যুয়াল কোর্ট নিয়ে বিভ্রান্তির শুরুটা মূলত চিলে কান নিয়েছে অবস্থার মতো। শুরুতে সবাই মনে করেছেন এই কোর্ট করতে হলে সব আইনজীবীর কম্পিউটার, স্ক্যানার, ক্যামেরা, প্রিন্টার প্রয়োজন। সঙ্গে ইন্টারনেট। অথচ বাস্তবতা হলো একটি স্মার্টফোন দিয়েই এসব মেশিনের কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব। আমি নিজেও হাতের স্মার্টফোনটা শুধু ব্যবহার করে আদালতে না গিয়েই হবিগঞ্জের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ভার্চুয়ালি সবার আগে জামিন আবেদন করেছি। জেলার প্রথম আইনজীবী হিসেবে এভাবে শুনানি করে তিন আসামির জামিন পেয়েছি। পরে আবার স্মার্টফোনেই জামিননামা ও রিলিজের আবেদন পাঠিয়ে তাদের কারাগার থেকেও বের করেছি।

প্রকৃতপক্ষে ভার্চ্যুয়াল আদালতে সংযুক্ত হতে স্মার্টফোনটিতে জুম বা মাইক্রোসফট টিম নামক ভিডিও কনফারেন্সিং সফটওয়্যারটি থাকলেই চলে। ফোনে ই-মেইলও লগ-ইন করা যায়। ফলে স্মার্টফোনে ছবি তুলে ওয়েবপোর্টালে জামিনের দরখাস্ত, জামিননামা, রিলিজ ও অন্যান্য কাগজ কয়েক সেকেন্ডে পাঠানো যায়। পরে ই-মেইলে ভিডিও লিংক এলে সহজেই সেটার মাধ্যমে ভার্চ্যুয়াল কোর্টে সংযুক্ত হওয়া যায়। আবার যারা সিনিয়র, প্রবীণ, যারা স্মার্টফোন ব্যবহার করতে পারেন না, তারাও সহজেই একজন জুনিয়র বা সহকারীর মাধ্যমে কাজটি করে নিতে পারেন। অন্ততপক্ষে একটি কম্পিউটারের দোকানে গিয়েও মাত্র কয়েক মিনিটে নিজের অ্যাকাউন্ট চালু করতে পারেন। আবার আবেদন করতেও কয়েক মিনিট প্রয়োজন হয়। শুধু বিষয়গুলো সম্পর্কে একটু জেনে নেওয়া বা ধারণা নেওয়া জরুরি। এক্ষেত্রে রয়েছে ওয়েবপোর্টাল, মুক্তপাঠ, সুপ্রিম কোটের ওয়েবসাইটের টিউটোরিয়াল, এটুআই ও ইউএনডিপির অনলাইন সেমিনার এবং ফেসবুক গ্রুপ। ভার্চ্যুয়াল সিস্টেমে আবেদন করার পদ্ধতিতে মাত্র কয়েকটি বিষয় পূরণ করতে হয়। এর চেয়ে অনেক জটিল আয়কর রিটার্নের ফরম পূরণ করেন আমাদের আয়কর আইনজীবীরা। যারা চাকরির আবেদন করেন অনলাইনে, তারাও অনেক কঠিন ধাপে আবেদন করেন। আমেরিকায় যাওয়ার জন্য যখন আমরা ডিবি লটারির ফরম পূরণ করতাম, সেটিও এর চেয়ে জটিল ছিল। আমরা অনেকেই না বুঝে ভার্চ্যুয়াল কোর্টের বিষয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়ছি।

ভার্চ্যুয়াল কোর্টের ক্ষেত্রে অনেকেই প্রফেশনালভাবে পিছিয়ে পড়া এবং এগিয়ে যাওয়া নিয়ে অস্বস্থি বোধ করছেন। সিনিয়ররা মনে করছেন জুনিয়ররা তথ্যপ্রযুক্তি ভালো বুঝেন। মোয়াক্কেল জুনিয়রদের দিকে ঝুঁকে পড়বে। বাস্তবতা কিন্তু ভিন্ন। আইন পেশায় প্রতিযোগিতা আছে। সেটি হলো দক্ষতা ও উপস্থাপনার প্রতিযোগিতা। টেকনোলজির দক্ষতায় কেউ এগিয়ে যাবে বলে আমি মনে করি না। কারণ এখন ভার্চ্যুয়াল কোর্টে শুধু হাজতে থাকা আসামির জামিন শুনানি হচ্ছে। হাজতে থাকা আসামিরা ইতিমধ্যে তাদের পছন্দের আইনজীবী নিয়োগ করে পাওয়ার বা ওকালতনামা দিয়ে দিয়েছেন। আর জামিনের ক্ষেত্রে সব মোয়াক্কেলই আইনে দক্ষদের কাছেই বেশি যাবে। ভার্চ্যুয়াল ভালো বুঝেন, ভালো শুনানি করতে পারেন না, এমন আইনজীবীকে কিন্তু মোয়াক্কেল পছন্দ করবেন না। করলেও তা হবে সাময়িক। কারণ মোয়াক্কেলরা দিন শেষে ফলাফলেই সন্তুষ্ট হন।

ভার্চ্যুয়াল আদালতের আরেকটি সুবিধা হলো এখানে জামিন প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন স্থানে যোগাযোগ, দালাল ও টাউটদের দৌরাত্ম কমে যাবে। তবে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় একটি মামলায় যেভাবে অনেক আইনজীবীর উপকৃত হওয়ার সুযোগ ছিল, সেটি কমে যাবে। প্রচলিত পদ্ধতিতে বড় মামলায় বাদী ও বিবাদী পক্ষে অনেক আইনজীবী অ্যাংগেজ থাকতে পারেন। কিন্তু এখানে সুযোগ কম।

আসলে আমরা কোনো আইন বা পদ্ধতি চালু করার ক্ষেত্রে দীঘসূত্রিতার সঙ্গেই অভ্যস্থ। আমরাই আবার এই দীর্ঘসূত্রিতার জন্য লাল ফিতার দৌরাত্মসহ বিভিন্নভাবে সমালোচনা করি। কিন্তু ভার্চ্যুয়াল কোর্টের ক্ষেত্রে এত দ্রুত অধ্যাদেশ, গ্যাজেট, প্রজ্ঞাপন আর আদেশ বাস্তবায়ন হয়েছে, যা প্রচলিত রীতি ভেঙে দিয়েছে। এখন আমাদের অনেক দিনের চাওয়া এই দীর্ঘসূত্রিতা ভেঙে দিয়ে নতুন অধ্যায়ের সূচনার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে যেখানে ধন্যবাদ দেওয়ার কথা, সেখানে আমরা হয়ে পড়লাম দ্বিধা বিভক্ত। চিন্তা করা উচিত ভার্চ্যুয়াল কোর্ট চালু হওয়ায় তিনদিনে সারাদেশে জামিন পেয়েছেন তিন হাজারের বেশি আসামি। আবেদন জমা পড়েছে প্রায় চার হাজার। বৃহস্পতিবার (১৪ মে) একদিনেই আবেদন এসেছে এক হাজার ৫০০। আমার নিজ জেলা হবিগঞ্জে ১২ মে আইনজীবীরা দ্বিধাগ্রস্থ থাকায় কোনো শুনানি না হলেও ১৩ ও ১৪ মে দুইদিনে জামিন পেয়েছেন ১০৬ জন। আবেদন জমা পড়েছে প্রায় ২০০। ফলে হবিগঞ্জের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট তানিয়া কামাল চিন্তা করছেন ১৭ মে জেলার সাতটি আমলী আদালতেই ভার্চ্যুয়াল কোর্ট চালু করে দিতে। এদিকে, আবার এই আবেদনের সিংহভাগই কিন্তু সিনিয়র আইনজীবীদের। শুরুতে ভার্চ্যুয়াল কোর্ট মেনে না নেওয়ার পক্ষের আইনজীবীদের।

আসলে সামগ্রিকভাবে ভার্চ্যুয়াল আদালতের কার্যক্রমে আগের তুলনায় জটিলতা কম। আইনজীবীরা ঘরে বসেই এই আদালতে অংশগ্রহণ করতে পারছেন। নিঃসন্দেহে  এটি একটি বিশাল সুবিধা। এই দুর্যোগের সময় সবার নিরাপত্তাটাও নিশ্চিত হচ্ছে এর মাধ্যমে। তাই এই মহামারির সময় আমারা ভার্চ্যুয়াল আদালত নিয়ে প্রশ্ন না তোলাই শ্রেয় হবে। শুধু বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা না করে সরকার ও বিচার বিভাগের এই কালজয়ী সিদ্ধান্তকে সবাই মিলে স্বাগত জানানো উচিত হবে। বিজ্ঞ আইনজীবী, বিজ্ঞ বিচারক ও বিচারপ্রার্থী সবার সার্বিক মঙ্গলে এর চেয়ে ভালো একটি উপায় আর হতে পারে না।

আমি যখন বাসায় বসে আমার হাজতে থাকা আসামিদের জন্য ভার্চ্যুয়াল কোর্টে জামিনের আবেদন করি, তখন না-কি আমার অনেক সহকর্মী আইনজীবী মিটিং করে আদালত বর্জনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। অপরদিকে কোর্ট থেকে যোগাযোগ করা হয় আমার মামলার শুনানির জন্য। আমি যেহেতু কোনো মিটিংয়ের দাওয়াত পাইনি, তাই সে খবর শুনে আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট রুহুল হাসান শরীফ ভাইকে ফোন দিলে তিনি বলেন ‘না এমন কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। আমি চাইলে শুনানি করতে পারব’।

পরদিন আমার এক সিনিয়র দাদা আমাকে ফোন করে বললেন, কোনো এক আইনজীবী না-কি বলেছেন, যারা ভার্চ্যুয়াল কোর্ট করবেন, তারা রাজাকার হবেন। আমি তখন দাদাকে উত্তর দিই, যেহেতু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আইন করেছেন, তাই তার আইন মেনে কোর্ট করলে যদি রাজাকার হতে হয় হব। আমি শেখ হাসিনার রাজাকার হব! পরে আমার বন্ধু ও সহকর্মী অ্যাডভোকেট সুলতান মাহমুদ বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নেওয়ায় হবিগঞ্জে একদিন পর হলেও ভার্চ্যুয়াল কোর্ট শুরু হয়।

মূল কথা হলো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনন্য এ উদ্যোগের জন্য এখন হাজার হাজার মানুষ আইনি প্রক্রিয়ায় মুক্ত হয়ে নিজের পরিবারের সঙ্গে ঈদ করতে পারবেন। আবার কারাগার গুলোতে ধারণ ক্ষমতার বেশি লোক কমে গিয়ে যারা থাকবেন, তারা একটু স্বস্তি ফিরে পাবেন। আর আইনি প্রক্রিয়ায় অংশ নিয়ে হাজার হাজার আইনজীবী ঈদের আগে কিছু হলেও টাকা পাবেন হাতে। যা দিয়ে পরিবারের সদস্যদের মুখে হাসি ফোটাতে পারবেন। পাশাপাশি নিজেদের প্রযুক্তি জ্ঞানকেও সমৃদ্ধ করতে পারবেন। এই জ্ঞান বর্তমান সময়ের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগে নিজেদের এগিয়ে যাওয়ার পথ দেখাবে।