Cinque Terre

ফজলে এলাহী

৩০ মে , ২০২০


যুগ্ম আহবায়ক, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী কৃষক দল, সিলেট মহানগর


শিল্প-সংস্কৃতি : জিয়াউর রহমানের অবদান

আজ ৩০ মে। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বীরউত্তম এর ৩৯তম শাহাদাৎ বার্ষিকী। আজকের দিনে জিয়াউর রহমানের বর্ণাঢ্য কর্মগুলো নিয়ে অনেকে অনেক আলোচনা ও স্মৃতিচারণ করবেন। কিন্তু আমি সেসব আলোচনায় যাব না। আজ আমি অনেকের না বলা কিছু কথা, সংক্ষেপে আলোচনা করব। কথাগুলো সবার জানা উচিত।  

বাংলাদেশের শিল্প সংস্কৃতিতে জিয়াউর রহমানের রয়েছে অনেক অবদান। তিনি যেমন দেশ পরিচালনার জন্য দেশসেরা সব মেধাবী ও দক্ষ মানুষদের একত্রিত করেছিলেন, ঠিক তেমনি বাংলাদেশের শিল্প সংস্কৃতিতে মেধাবীদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন। জিয়াউর রহমানই দেশে ‘জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার’, ‘স্বাধীনতা পদক’ ও ‘একুশে পদক’ প্রবর্তন করেছিলেন। রাষ্ট্রীয় এসব পদক প্রবর্তনের পেছনে তাঁর উদ্দেশ্য ছিল দেশের সকল গুণী মানুষদের কর্মগুলোকে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি জানিয়ে তাঁদের সম্মান জানানো।

জিয়াউর রহমানের আমলে দলমতের উর্ধ্বে উঠে প্রত্যেকটি রাষ্ট্রীয় পদক প্রদান করা হতো। গত ১২ বছর ধরে পত্র পত্রিকায় ও টেলিভিশন চ্যানেলের টক শোতে বিভিন্ন বুদ্ধিজীবীর সন্তান ও পরিবারের সদস্যরা জিয়াউর রহমানকে ‘পাকিস্তানের এজেন্ট’, ‘স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি’ বলে গাল-গপ্পো করে বর্তমান প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করে চলেছেন। অথচ তাদের পিতা-স্বামী-ভাইকে জিয়াউর রহমান প্রথম রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মাননা প্রদান করেছিলেন। এ প্রসঙ্গে দু’ তিনটি উদাহরণ না দিলেই নয়। 

প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান গুম হয়েছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি, যা সেই সময়ে ব্যাপক আলোড়ন তুলেছিল। সেই জহির রায়হানকে জিয়াউর রহমান প্রথম রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মান জানালেন। ১৯৭৬ সালের প্রথম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে মরণোত্তর শাখায় তাঁকে পদক দেন। দ্বিতীয়বার সম্মান প্রদর্শন ও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি জানিয়েছিলেন ১৯৭৭ সালে দেওয়া একুশে পদকের মাধ্যমে। সুরকার আলতাফ মাহমুদ ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসেই নিখোঁজ হয়েছিলেন। সেই আলতাফ মাহমুদকে রাষ্ট্রীয় সম্মান ও স্বীকৃতি জানিয়েছিলেন শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান।  

১৯৭১ সালে নিখোঁজ হওয়া খ্যাতিমান সাহিত্যিক মুনির চৌধুরীকে সর্বপ্রথম রাষ্ট্রীয় সম্মান ও স্বীকৃতি দিয়েছিলেন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ১৯৮০ সালের স্বাধীনতা পদক প্রদানের মাধ্যমে। 

সারাদেশের মেধাবী শিশু কিশোরদের জাতীয় পর্যায়ে মেধা বিকশিত করার জন্য ১৯৭৬ সালে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ টেলিভিশনের মাধ্যমে ‘নতুন কুঁড়ি’  প্রতিযোগিতা শুরু করেছিলেন যা ছিল বিশ্বের প্রথম ‘ট্যালেন্ট হান্ট / রিয়েলিটি শো।’ এই প্রতিযোগিতা থেকেই আমরা পেয়েছিলাম কণ্ঠশিল্পী সামিনা চৌধুরী, অভিনেত্রী তারানা হালিম (সাবেক সংসদ সদস্য), মেহের আফরোজ শাওন, রুমানা রশীদ ঈশিতা, তারিন, তিশাসহ আরও অনেককে। স্বৈরাচার এরশাদ সরকারও  ‘নতুন কুঁড়ি’ প্রতিযোগিতাটি বন্ধ করেনি। একমাত্র আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর সর্বপ্রথম সারাদেশে জনপ্রিয় এই প্রতিযোগিতাটি বন্ধ করে দেয়। ২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসার পর পুনরায় তা বন্ধ করে। 

বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকেও এগিয়ে নেওয়ার জন্য জিয়াউর রহমান নানা উদ্যোগ নিয়েছিলেন।  একদিন জিয়া বঙ্গভবনে ডেকে পাঠালেন তৎকালীন সময়ের জনপ্রিয় ও ব্যস্ত নায়ক উজ্জ্বলকে। উজ্জ্বল ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স ও মাস্টার্স করা মেধাবী ছাত্র। উজ্জ্বলের সঙ্গে ইন্ড্রাস্ট্রির নানা বিষয় নিয়ে কথা বললেন। কীভাবে পাশের দেশের রঙ্গিন বাণিজ্যিক সিনেমাগুলোকে টেক্কা দিয়ে আমরা এগিয়ে যেতে পারি, সেসব বিষয় নিয়ে বিস্তারিত কথা বললেন। চলচ্চিত্রের জন্য উজ্জ্বলকে একদিন ৬০ লাখ টাকা অনুদান দিলেন। পরিচালক আজিজুর রহমানের ‘ছুটির ঘন্টা’ সিনেমার পেছনেও আছে জিয়াউর রহমানের অবদান । চলচ্চিত্র শিল্পের জন্য জিয়ার আমলে যে কয়টি অত্যাধুনিক ক্যামেরা কেনা হয়েছিলো সেগুলো দিয়ে ইন্ডাষ্ট্রি চলেছে দুই দশক ধরে। জিয়াই এফডিসিতে ‘জহির রায়হান কালার ল্যাব’ প্রতিষ্ঠিত করে রঙিন সিনেমা বানানোর জন্য দেশেই সব ব্যবস্থা করে দিলেন। এফডিসির বেঙ্গল স্টুডিওকে করলেন আধুনিক, যেখানে অসংখ্য সিনেমার শুটিং হয়েছিল। মিষ্টি প্রেমের রোমান্টিক ও পারিবারিক সিনেমার ইমেজ ছেড়ে উজ্জ্বল বেরিয়ে এসে নির্মাণ করলেন ‘নালিশ’ সিনেমাটি। যার পরের ইতিহাসটা সবারই জানা। বরেণ্য পরিচালক খান আতাউর রহমান এর জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র ‘ডানপিটে ছেলে’ নির্মাণের পেছনেও আর্থিক অনুদানসহ যাবতীয় সহযোগিতা করেছিলেন জিয়াউর রহমান।

১৯৮০ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের জন্য আর্থিক অনুদান প্রথা চালু করেছিলেন এবং সেই অনুদানে নির্মিত প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র হলো বাদল রহমানের ‘এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী’। স্বাধীন বাংলাদেশে এটিই হলো সর্বপ্রথম শিশুতোষ চলচ্চিত্র এবং এখন পর্যন্ত জাতীয় পুরস্কারে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র শাখায় পুরস্কারপ্রাপ্ত একমাত্র শিশুতোষ চলচ্চিত্র। উল্লেখ্য, যে একই বছর খান আতাউর রহমানের ‘ডানপিটে ছেলে’ নামে আরেকটি শিশুতোষ চলচ্চিত্র নির্মাণ হয় যার পেছনেও রয়েছে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা। বাংলাদেশ শিশু একাডেমির একটি বিশেষ প্রকল্পের অনুদানে নির্মিত হয়েছিল ‘ডানপিটে ছেলে’। চলচ্চিত্রটি একই বছরেই জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে বিভিন্ন শাখায় (শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকার, শ্রেষ্ঠ গীতিকার ও শ্রেষ্ঠ শিশু শিল্পী)  পুরস্কার লাভ করেছিল। সেই থেকে এদেশে শিশুতোষ চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু হয়। যার ধারাবাহিকতায় আমরা পেয়েছিলাম ‘ছুটির ঘন্টা’,‘পুরস্কার’, ‘এতিম’,  ‘মাসুম’,  ‘রামের সুমতি’র মতো অসাধারণ কিছু বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র। 

১৯৮০ সালের  জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে সর্বাধিক ৫টি শাখায় পুরস্কার অর্জন করেছিল ‘এমিলের গোয়েন্দ বাহিনী’। জিয়াউর রহমান নিজ হাতে এসব পুরস্কার প্রদান করেন।

মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র ‘কলমিলতা’। গল্পটা জিয়াউর রহমানেরই বলা। যা নির্মাণের জন্য রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান আর্থিক অনুদানসহ সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছিলেন। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে চলচ্চিত্রের মাধ্যমে বিশ্ব দরবারে পৌঁছে দেওয়ার জন্য জিয়াউর রহমান গঠন করেছিলেন ‘বাংলা জাশিস’ নামের একটা প্রযোজনা সংস্থা। এই  সংস্থার প্রথম ও শেষ চলচ্চিত্র ছিল ‘কলমিলতা’।

জিয়াউর রহমান তাঁর শাসনামলে স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে প্রচারিত ‘প্রথম বাংলাদেশ আমার শেষ বাংলাদেশ’ শিরোনামের দেশাত্মবোধক গানটিকেই বিএনপির দলীয় সংগীত হিসেবে পছন্দ করেছিলেন। শুধু তাই নয় এই গানটির গীতিকার সুনামগঞ্জের অখ্যাত এক তরুণ মনিরুজ্জামান মনিরকে তিনি বঙ্গভবনে ডেকে নিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁকে বাংলা একাডেমিতে চাকরি দিয়েছিলেন। যার বিনিময়ে সেই অখ্যাত অচেনা মনিরুজ্জামান মনির বাংলাদেশের সংগীত ভাÐারে দু’হাত ভরে দিয়েছেন অসাধারণ সব গান। এভাবেই এই গীতিকার হয়েছিলেন বাংলা গানের জীবন্ত কিংবদন্তি।  

জিয়াউর রহমান মনে-প্রানে বিশ্বাস করতেন, মেধাবী প্রজন্ম ছাড়া কোনো দেশ এগিয়ে যেতে পারে না। তাই তো তিনি সবসময় মেধা ও যোগ্যতাকে প্রাধান্য দিতেন। দলীয় সংকীর্ণতার উর্ধ্বে ওঠে জিয়াউর রহমান তাঁর শাসনকালে রাষ্ট্রের বিভিন্ন জায়গায় তিনি যোগ্য লোকদের দায়িত্ব দিতেন। জিয়াউর রহমান চেয়েছিলেন অর্থনৈতিক সমৃদ্ধ বাংলাদেশের পাশাপাশি বাংলাদেশের শিল্প সংস্কৃতি বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে  দাঁড়াবে। জিয়ার কাছে সবসময় ‘ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ বড়’ এই নীতিটি ছিল প্রধান কথা। এই নীতি অনুসরণ করেই তিনি দেশের সকল জ্ঞানী-গুনী মানুষ ও মেধাবী তরুণদের নিয়ে একই সুতোয় মালা গেঁথেছিলেন। যার সুফল ধীরে ধীরে পেতে যাচ্ছিল এই রাষ্ট্র।