Cinque Terre

আশরাফুল আলম

০৯ জুন , ২০২০


প্রাবন্ধিক


উইলিয়াম কেরি : ইতিহাসে স্মরণীয়

উইলিয়াম কেরি বাংলার ইতিহাসে এক স্মরণীয় পুরুষ। তিনি মুদ্রণশিল্প ও বাংলা গদ্য বিকাশের জন্য অমর হয়ে আছেন। আমাদের নিজেদের প্রয়োজনেই উইলিয়াম কেরিকে চর্চা করতে হবে। ১৭৬১ সালের ১৭ আগস্ট ইংল্যান্ডের নর্দাম্পটনশায়ারের এক দরিদ্র পরিবারে উইলিয়াম কেরির জন্ম। ১৮৩৪ সালের ৯ জুন শ্রীরামপুরে তাঁর জীবনাবসান ঘটে। আজ তাঁর প্রয়াণ দিবস।

উইলিয়াম কেরি ছিলেন একজন সংগ্রামী পুরুষ। প্রথম জীবনে তিনি জুতা তৈরি ও মেরামতের কাজ করতেন। তবে শৈশব থেকেই ধর্ম ও জ্ঞানচর্চার প্রতি তার আগ্রহ ছিল প্রবল। টমাস জোন্সের কাছে তিনি গ্রিক ও লাতিন ভাষা শিক্ষা এবং বিজ্ঞান, ইতিহাস, ভ‚গোল প্রভৃতি বিষয়ে জ্ঞানলাভ করেন।

১৭৮৬ সালে উইলিয়াম কেরি মোল্টন গ্রামে শিক্ষকতা শুরু করেন। তবে ১৭৯২ সালে তার নেতৃত্বে খ্রিষ্টানদের মধ্যে খ্রিষ্টধর্ম প্রচার করার উদ্দেশ্যে কেটারিং শহরে একটি সমিতি গঠিত হয়। এ সময় খ্রিষ্টধর্ম প্রচারের পন্থা সম্পর্কে ইংরেজি ভাষায় তিনি একটি বই লেখেন। ১৭৯৩ সালে ব্যাপ্টিস্ট মিশন থেকে তাকে খ্রিষ্টধর্ম প্রচারের জন্য ভারতে পাঠানো হয়। বঙ্গদেশে এসে রামরাম বসুর কাছে তিনি বাংলা ভাষা শেখেন এবং তার সহায়তায় বাংলায় ‘বাইবেল’ অনুবাদ করেন।

১৭৯৪ সালে কেরি মালদহের মদনবাটি নীলকুঠির তত্ত্বাবধায়ক নিযুক্ত হন। স্থানীয় কৃষক-প্রজাদের শিক্ষার সুবিধার্থে এখানে তিনি বিদ্যালয় স্থাপন করেন। ১৭৯৭ সালে বই ছাপানোর উদ্দেশ্যে দেশি হরফ তৈরির কারখানা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিলে তার সঙ্গে চার্লস উইলকিন্সের শিষ্য পঞ্চানন কর্মকারের পরিচয় হয়।

এরপর নীলকুঠি বন্ধ হয়ে গেলে কেরি কিছুকাল খিদিরপুরে স্থায়ীভাবে বসবাস করে ১৭৯৯ সালের শেষদিকে জোশুয়া মার্শম্যান, উইলিয়াম ওয়ার্ড, গ্রান্ট প্রমুখ মিশনারির সঙ্গে শ্রীরামপুরে যোগ দেন এবং ১৮০০ সালের জানুয়ারিতে শ্রীরামপুর মিশন প্রতিষ্ঠা করেন। এ সময় পঞ্চানন কর্মকারও এ মিশনের ছাপাখানায় যোগ দেন। 

কেরি ও পঞ্চাননের যৌথ প্রচেষ্টায় ‘মিশন সমাচার’ নামে বই ছাপার মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষায় প্রথম মুদ্রণকাজের সূচনা হয়। পরে শ্রীরামপুর থেকে কেরির নেতৃত্বে প্রায় ৪০টি ভাষা ও উপভাষায় খ্রিষ্টধর্মীয় গ্রন্থের অনুবাদ প্রকাশিত হয়। এক্ষেত্রে একটি বিষয় লক্ষণীয়, কেরি প্রথম দিকে খ্রিষ্টধর্ম ও ইংরেজদের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অধিক মনোযোগী ছিলেন। তবে ধীরে ধীরে বাংলা ও বাঙালির অগ্রগতির সূচনায় নিজেকে জড়িয়ে নেন। 

১৮০১ সালের মে মাসে কেরি ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের বাংলা, সংস্কৃত ও মারাঠি ভাষার অধ্যাপক নিযুক্ত হন। এখানে ভাষা শিক্ষাদানের দায়িত্ব গ্রহণের পর তিনি ভারতীয় ভাষাগুলো, বিশেষ করে বাংলা ভাষার সর্বাঙ্গীণ উন্নতিসাধনে আত্মনিয়োগ করেন। সুশৃঙ্খলভাবে ভাষা শিক্ষাদানের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণের অভাব পূরণের উদ্দেশ্যে তিনি পাঠ্যপুস্তক, ব্যাকরণ এবং অভিধান রচনা করেন। তার অধীন যারা ছিলেন তাদেরকে তিনি এই কাজে উৎসাহিত করতে থাকেন।

কেরির রচিত গ্রন্থের সংখ্যা প্রায় অর্ধশত। তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হলো গ্রামার অব দ্য বেঙ্গলি ল্যাঙ্গুয়েজ (১৮০১ সালে ইংরেজি ভাষায় রচিত), ডায়ালোগস (বাংলা-ইংরেজি দ্বিভাষিক গ্রন্থ, ১৮০১), ইতিহাসমালা (গল্পসংগ্রহ, ১৮১২), বাংলা-ইংরেজি অভিধান (১৮১৫-২৫), চার খণ্ডে ওল্ড টেস্টামেন্ট বা ধর্মপুস্তক (১৮০২-০৯, হিব্রু থেকে অনূদিত)। এছাড়া তিনি মারাঠি ব্যাকরণ ও অভিধান এবং পাঞ্জাবি ব্যাকরণ, তেলিঙ্গা ব্যাকরণ, কানাড়ি ব্যাকরণ প্রকাশ করেন। তিনি ওড়িয়া, পাঞ্জাবি, সংস্কৃত ও অসমিয়া ভাষায়ও বাইবেল অনুবাদ করেন। জোশুয়া মার্শম্যানের সঙ্গে মিলে তিনি মূল বাল্মীকি রামায়ণের অযোধ্যাকা- পর্যন্ত ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করে তিন খণ্ডে প্রকাশ করেন। ‘এ ইউনিভার্সাল ডিকশনারি অফ দি ওরিয়েন্টাল ল্যাঙ্গুয়েজেস’ নামের সংস্কৃতসহ ১৩টি ভারতীয় ভাষায় এক সমন্বিত শব্দকোষ কেরির অসামান্য পাণ্ডিত্যের স্মারক হিসেবে চিহ্নিত। কিন্তু এই শব্দকোষের পাণ্ডুলিপির কিছু অংশ অগ্নিকাণ্ডে বিনষ্ট হওয়ায় এর মুদ্রণ সম্পন্ন হতে পারেনি। 

উইলিয়াম কেরির উদ্যোগে ১৮১৮ সালে ‘ফ্রেন্ড অফ ইন্ডিয়া’ নামে একটি পত্রিকাও প্রকাশিত হয়। পুস্তক রচনা, অনুবাদ ও প্রকাশের পাশাপাশি বাংলা হরফের সংস্কার এবং অন্যান্য ভারতীয় ভাষায় হরফ তৈরির কাজেও তিনি উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন।

১৮০৬ সালে কেরি কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্য হন। ১৮০৭ সালে আমেরিকার ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ‘ডক্টর অফ ডিভিনিটি’ উপাধিতে ভূষিত করে। তিনি ১৮২২ সালে বিখ্যাত লিনিয়ান সোসাইটির এবং ১৮২৩ সালে লন্ডন জিওলজিক্যাল সোসাইটি ও রয়াল এগ্রিকালচারাল সোসাইটির সদস্য হন। ১৮২৩ সালে ভারতবর্ষে তিনিই প্রথম এগ্রি-হর্টিকালচারাল সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন।

১৮২৪ সালে কেরি তৎকালীন বৃটিশ সরকারের বাংলা অনুবাদক নিযুক্ত হন। ৩০ বছর ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে অধ্যাপনা করার পর ১৮৩১ সালে অবসর নিয়ে তিনি পরবর্তী এক বছর শ্রীরামপুর কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। মূলত উইলিয়াম কেরি বাংলা গ্রন্থ প্রকাশ ও সংবাদ প্রকাশের সূচনা করেছিলেন। সঙ্গত কারণেই তাঁকে জানা আমাদের উচিত ও কর্তব্যের মধ্যে পড়ে।