Cinque Terre

মুক্তাদীর আহমদ মুক্তা

০৪ এপ্রিল , ২০২০


সাংবাদিক ও রাজনৈতিক কর্মী

[email protected]
প্রদর্শন নয় প্রয়োজন টেকসই আয়োজন

নভেল করোনাভাইরাস গোটা মানবজাতির জন্য এখন একটা প্রাণঘাতি আতঙ্কের নাম। বিশ্বের উন্নত দেশসমূহ এই ভাইরাস মোকাবিলায় হিমশিম খাচ্ছে। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ দুনিয়ার অগ্রসর রাষ্ট্রগুলো করোনা ভাইরাসের আঘাতে বিপর্যস্ত। আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্রের বেশকিছু কার্যকর পদক্ষেপে মানুষ যতোটা না আশান্বিত, সমন্বয়হীনতা ও অব্যবস্থাপনায় তার চেয়ে বেশি মানুষ আতঙ্কিত। 

করেনাভাইরাসের ভয়াবহতা এখনও সাধারণ মানুষ অনুধাবন করতে পারছে না। প্রশাসনের জোর জবরদস্তিতে আপাতদৃষ্টিতে মানুষ ঘরবন্দি থাকলেও করোনা প্রতিরোধক স্বাস্থ্যবিধিকে মানুষ পাত্তাই দিচ্ছে না। সরকারের পক্ষ থেকে সচেতনামূলক পদক্ষেপকে গুরুত্ব না দিয়ে মানুষ ত্রাণ গ্রহণ আর বিতরণকেই উপভোগ করছে। ত্রাণে কি পরিত্রাণ মিলবে প্রাণঘাতি এই ভাইরাস থেকে সে ভাবনা এখন জরুরি।

দূর্যোগে, সংকটে বাংলাদেশের মানুষের মানবিকতা সবসময়ই প্রশংসনীয়। কিন্তু এবারের সংকটে যে গতানুগতিক সাহায্য, সহযোগিতা আর পৃষ্ঠপোষকতার চেয়ে নিজেকে বিচ্ছিন্ন রাখা সবচেয়ে বেশি জরুরি এই চরম সত্যটি আমরা যেন বুঝতেই চাচ্ছি না। দলবেঁধে, মানুষ জড়ো করে এই সাহায্য  সহযোগিতা এদেশের কপালে নিয়ে আসতে পারে ভয়াবহ দূর্যোগ। প্রাণঘাতি ভাইরাস এখনও দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েনি। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা যেখানে বার বার বলেছে পরীক্ষা নিরীক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। সেখানে আমরা এখনও বিভাগীয় পর্যায়েও করোনা পরীক্ষা নিরীক্ষার ব্যবস্থা করতে পারিনি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কার্যক্রম শুরু থেকেই প্রশ্নবিদ্ধ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে তারা অনুধাবন করতে না পেরে প্রতি উপজেলা থেকে দুইজনের নমুনা সংগ্রহের কথা প্রচার করেছেন। যেখানে উপজেলা পর্যায়ে করোনা পরীক্ষার কিট সরবরাহ করা হয়নি সেখানে এ ধরণের বক্তব্য তামাশার শামিল। ঢাল নেই তলোয়ার নেই নিধিরাম সর্দার এমন অবস্থার মধ্যে চিকিৎসকদের রেখে কঠিন এই মহামারি মোকাবিলা কখনই সম্ভব নয়। শুরু থেকেই পার্সোনাল প্রটেকটিভ ইকুপমেন্ট (পিপিই)  নিয়ে লঙ্কাকাণ্ড চলছে। করোনাভাইরাস চিকিৎসার জন্য টেকসই মাস্কও এখনও নিশ্চিত করা যায়নি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর পিপিই নিয়ে বক্তব্যের পরও একজন সংসদ সদস্য পিপিই পরিধান করে জনসংযোগ করছেন। জনপ্রশাসনের কর্মকর্তা, ব্যাংকাররা পিপিই পরিধান করে প্রদর্শন করছেন অথচ চিকিৎসকরা পিপিই পাচ্ছেন না। কি দূর্ভাগ্যজনক দায়িত্বহীনতা আর সমন্বয়হীনতা চারপাশে। আরেকটি জিনিস ব্যাপক হারে দেখা যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে স্থানীয় মন্ত্রী এমপিরা নিজেরা নিজেদের নির্বাচনী এলাকায় পিপিই পৌছে দিচ্ছেন। অনেক সরকারি, বেসরকারি হাসপাতালে  স্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ, শিল্পপতি বা সমাজপতিরা পিপিই সরবরাহ করছেন। এরা কিভাবে এই গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসা উপকরণ সরবরাহ করার অধিকারী হলেন! বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা অনুমোদিত মানসম্পন্ন পিপিই কি এগুলো? না দেশের বাজারে তৈরি উন্নত রেইনকোট এগুলো তারও বিচার বিশ্লেষণ প্রয়োজন। সরকারি হাসপাতালে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর নিজেরা কেনো পিপিই সরবরাহ না করে অননুমোদিত কতৃপক্ষের পিপিই গ্রহণকে উৎসাহিত করছেন তা বোধগম্য নয়। আত্মঘাতি এইসব প্রবণতা এখনই থামাতে হবে। করোনাভাইরাস কে মৌসুমি দূর্যোগ ভেবে যারা প্রদর্শনীমূলক সমাজহিতৈষী কর্মযজ্ঞে আত্মতৃপ্তি খোঁজছেন তারা না ভয়াবহ সংকটের কারণ হয়ে দাঁড়ান সেটাও ভাবনায় রাখা জরুরি। সহযোগিতা যেন সহমরণের কারণ না হয়। শারীরিক দূরত্ব যেখানে সবচেয়ে বেশি জরুরি সেখানে উৎসবমুখর জনসমাগম দূর্ভাগ্যজনক পরিণতি নিয়ে আসতে পারে। এখনও চিকিৎসকদের আস্থায় নিয়ে আসতে পারেনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। করোনাকে কেন্দ্র করে সাম্প্রতিক কিছু বিতর্কিত সিদ্ধান্তে এমনিতেই চিকিৎসক সমাজ মনঃক্ষুন্ন। তার উপর নিরাপত্তাহীন চিকিৎসা সামগ্রী দিয়ে করোনা চিকিৎসায় কাউকে নিবেদিত করা যাবে না।

নিবেদিতপ্রাণ চিকিৎসক, দায়িত্বশীল স্বাস্থ্যপ্রশাসন আর উপযুক্ত পরীক্ষাগার এই মুহুর্তে হতে পারে টেকসই আয়োজন। আবেগে আর হুজুগে না মেতে করোনা প্রতিরোধে টেকসই পন্থা অবলম্বন না করলে বৈশ্বিক এই মহামারি নিয়ন্ত্রণ আয়ত্তের বাইরে চলে যাবে। আত্মপ্রচার নয় অনুভব করার প্রতিযোগিতা দরকার। মানবিকতার প্রদর্শন নয় বিবেকের দংশন আর সময়োপযোগী মানবিক আচরণই এখন সবচে বেশি প্রয়োজন।