Cinque Terre

মুক্তাদীর আহমদ মুক্তা

১৮ জুন , ২০২০


সাংবাদিক ও রাজনৈতিক কর্মী

[email protected]
সাধারণের নেতা অসাধারণ কামরান

চলে গেলেন সিলেটের সমকালীন রাজনীতির সবচেয়ে জনপ্রিয় মানুষ বদর উদ্দিন আহমদ কামরান। সিলেটের মানুষ কামরানকে যেমন অনেক দিয়েছেন তেমনি কামরানও সিলেটবাসীর জন্য নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন সাধ্যমতো। বদরউদ্দিন কামরান ছাত্র রাজনীতি থেকে উঠে আসা একজন আপাদমস্তক জননেতা। নিজের মেধা, একাগ্রতা, মধুর ব্যবহার ও স্বভাবসুলভ সহৃদয়তা দিয়ে তিনি জয় করেছেন তার চারপাশকে। প্রান্ত থেকে কেন্দ্রে পৌঁছাতে কামরানকে অনেক ঘাত প্রতিঘাত মোকাবিলা করতে হয়েছে। বার বার জীবনের ওপর আঘাত এসেছে। ভাগ্য সুপ্রসন্ন থাকায় মৃত্যুঞ্জয়ী কামরান সময়ের সাহসী সন্তান হিসেবে পরিণত হয়েছেন জনতার কামরান হিসেবে। 

সিলেটের আওয়ামী লীগের রাজনীতির অপরিহার্য মুখ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে অনেক ত্যাগ স্বীকার  করতে হয়েছে কামরানকে। কালের পরিক্রমায় বদর উদ্দিন কামরান নিজেই হয়ে উঠেছিলেন একটি প্রতিষ্ঠান। ছাত্র জীবন থেকেই তাঁর রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ততা। শিল্প, সংস্কৃতি, ক্রীড়া, সমাজসেবা সকল জায়গায়ই রেখেছেন যোগ্যতার স্বাক্ষর। আলো ছড়িয়েছেন সর্বত্র। তৈরি করেছেন আপন ভুবন।

১৯৫১ সালের ১ জানুয়ারি সিলেট শহরে জন্মগ্রহণ করেন বদর উদ্দিন কামরান। শিক্ষাজীবনের শুরু হয় শহরের বন্দর বাজারের দুর্গাকুমার পাঠশালায়। এরপর সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক, এমসি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করেন। স্কুলে থাকা অবস্থায়ই ১৯৬৮ সালে তিনি ছাত্রলীগের সদস্য পদ লাভ  লাভ করেন। দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭২ সালে তৎকালীন এম সি কলেজ বর্তমান সিলেট সরকারি কলেজে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে তিনি অংশ নেন। এসময় ছাত্রলীগ দুইভাগে বিভক্ত হলে তিনি বৈজ্ঞানিক সমাজতান্ত্রিক অংশে যোগ দেন। এ সময় মুজিববাদী ছাত্রলীগ থেকে ভিপি পদে অংশ নেন সুলতান মোহাম্মদ মনসুর। জিএস পদে আক্তার আহমদ। সমাজতান্ত্রিক ছাত্রলীগ থেকে ভিপি পদে ইমরান আহমদ চৌধুরী ও জিএস পদে বদর উদ্দিন কামরান। ছাত্র ইউনিয়ন থেকে ভিপি পদে শাহাব উদ্দিন ও জিএস পদে মুর্শেদ আহমদ অংশ নেন। এসময় মুজিববাদী ছাত্রলীগ ভিপি জিএসসহ সিংহভাগ পদে নির্বাচিত হয়। বদর উদ্দিন কামরান জিএস পদে পরাজিত হওয়ার পর ১৯৭৩ সালেই তৎকালীন ভিপি সুলতান মোহাম্মদ মনসুরের হস্তক্ষেপে মুজিববাদী ছাত্রলীগে যোগ দেন। এ বছরই তিনি সিলেট পৌরসভা নির্বাচনে তোপখানা ওয়ার্ড থেকে কমিশনার নির্বাচিত হন। এসময় চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন বাবরুল হোসেন বাবুল। বদর উদ্দিন কামরানের জয়যাত্রা সে সময় থেকেই শুরু। সে সময় তিনি ছিলেন পৌরসভার সর্বকনিষ্ঠ জনপ্রতিনিধি। পরের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭৭ সালে, সেবারও কমিশনার নির্বাচিত হন তিনি। তখন চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন আ ফ ম কামাল অ্যাডভোকেট। মধ্যখানে কিছুদিন কাতারে চলে যাওয়ায় নির্বাচনী লড়াই থেকে দূরে ছিলেন তিনি। দেশে ফিরে ১৯৮৯ সালে আবার সিলেট পৌরসভা নির্বাচনে কমিশনার পদে অংশ নিয়ে তৃতীয়বারের মত কমিশনার নির্বাচিত হন। এর আগেই তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে উঠেন। দেওয়ান ফরিদ গাজীর সান্নিধ্যে থেকে গণসংগঠনে কাজ করতে থাকেন। এক পর্যায়ে  আওয়ামী লীগ বিভক্ত হলে তিনি আওয়ামী লীগ (মিজান) অংশে যোগ দেন। ১৯৮১ সালের ২১ জানুয়ারি সিলেট শহর আওয়ামী লীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ইর্শাদ আলী সভাপতি ও মাহমুদ হোসেন মঞ্জু সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এসময় কামরান আওয়ামী লীগের মূলধারায় চলে আসেন। ১৯৮৬ সালে বদরউদ্দিন কামরানকে সিলেট শহর আওয়ামী লীগের কার্যকরি কমিটির সদস্য পদে কোঅপ্ট করা হয়। এরপর থেকে  তিনি  আব্দুস সামাদ আজাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হন। ১৯৮৯ সালের ১৯ নভেম্বর সিলেট শহর আওয়ামী লীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনে তিনি শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। তখন সভাপতি ছিলেন মাহমুদ হোসেন মঞ্জু। ১৯৯৫ সালে তিনি আওয়ামী লীগের সমর্থিত প্রার্থী হিসেবে সিলেট পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ১৯৯৭ সালে সিলেট শহর আওয়ামী লীগের নতুন কমিটি গঠন হলে সিরাজ বক্স সভাপতি ও বদর উদ্দিন কামরান পুনরায় সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এরপর থেকে তাঁকে আর পেছনে থাকাতে হয়নি। একজন ব্যক্তি কামরান হয়ে উঠেন জনতার কামরান হিসেবে। সিলেটে দলমত নির্বিশেষে তাঁর ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা সৃষ্টি হয়। সিলেট শহরের বিভিন্ন সামাজিক ও পারিবারিক বলয়কে অতিক্রম করে কামরানকে নিজের অবস্থান সুসংহত করতে অনেক ধৈর্য্য ও সংগ্রাম করতে হয়েছে। এ সময়ই মূলত তিনি দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার দৃষ্টি আকর্ষণে সমর্থ হন। ২০০২ সালে তিনি সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। এসময় তাঁর সঙ্গে সাধারণ সম্পাদক হন মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ। ২০০৩ সালে সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রথম মেয়র হিসেবে তিনি আওয়ামী লীগের সমর্থিত প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হন। ২০০৪ সালের ৭ আগষ্ট মহানগর আওয়ামী লীগের সভায় তাঁকে লক্ষ্য করে গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। এসময় তাঁর ঘনিষ্ঠজন আওয়ামী লীগ নেতা ইব্রাহিম নিহত হন। অনেক নেতাকর্মী আহত হন। তখনকার আন্দোলন সংগ্রামে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ২০০৫ সালে কাউন্সিলের মাধ্যমে তিনি আবার সভাপতি নির্বাচিত হন। তখনও সাধারণ সম্পাদক হন মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ। ২০০৮ সালে কারাগারে থেকে তিনি পুনরায় আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে মেয়র নির্বাচিত হন। এরপর থেকে জাতীয় পর্যায়ে তাঁর পরিচিতি ব্যাপক বৃদ্ধি পায়। একজন আঞ্চলিক নেতা হয়েও তিনি কেন্দ্রের কাছে বিশেষ সমাদৃত হন। ২০১১ সালে তিনি সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের পুনরায় সভাপতি নির্বাচিত হন। এ সময় সাধারণ সম্পাদক হন আসাদ উদ্দিন। ২০১৩ সালে সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী হিসেবে পরাজিত হন। ২০১৬ সালে আওয়ামী লীগের বিশতম  জাতীয় কাউন্সিলে তিনি কেন্দ্রীয় কার্যকরি কমিটির সদস্য পদ লাভ করেন। ২০১৮ সালে সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী হিসেবে তিনি আবার পরাজিত হন। নিজের দল ক্ষমতায় থাকার সময়, জনপ্রিয় এই দলীয় প্রার্থীর পরাজয়ে দলের ভেতরে বাইরে দেখা দেয় ব্যাপক প্রতিক্রিয়া।

বদরউদ্দিন কামরান ২০১৯ সালের নভেম্বর পর্যন্ত সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। সর্বশেষ ২০১৯ সালে দলের একুশতম জাতীয় সম্মেলনে তিনি পুনরায় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন।

বদরউদ্দিন আহমদ কামরান আমৃত্য সিলেটের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সম্প্রীতির ঐতিহ্য ধরে রাখতে নিবেদিত ছিলেন। তিনি চাঁদের হাট,ফাল্গুনী সিলেট, রেডক্রস সোসাইটি, সিলেট জেলা ক্রীড়া সংস্থা ইত্যাদি নানা সংগঠনের ছিলেন গুরুদায়িত্বে। একাধারে রাজনীতি, ক্রীড়া, সংস্কৃতি প্রেমী ও সাহিত্য অনুরাগী হলেও সমাজে তাঁর মূল পরিচয় ছিল জনপ্রতিনিধি হিসেবে। তাঁর বৈচিত্রময় জীবনের স্বীকৃতিস্বরূপ বিভিন্ন সময়ে তিনি বিভিন্ন সম্মাননা পেয়েছেন। ছাত্রনেতা থেকে জননেতা, পৌরকমিশনার থেকে সিটি মেয়র। প্রান্ত থেকে কেন্ত্র এভাবে কামরান হয়ে উঠেন সিলেটের রাজনীতির সবচেয়ে পরিচিত মুখ। সফল রাজনীতিবিদ। 

২০২০ সালের ১৫ জুন ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। ৬৯ বছর বয়সে জীবনাবসান হয় সিলেটের সমকালীন রাজনীতির এই কিংবদন্তি পুরুষের। সমাপ্তি হয় এক সফল  রাজনৈতিক ও জনপ্রতিনিধির বর্ণাঢ্য জীবনের।

সিলেটবাসীর প্রিয় নাম বদর উদ্দিন কামরান এটি একটি চিরন্তন শ্লোগানে পরিণত হয়। তিনি সিলেট নগরের প্রতিনিধি হলেও জয় করেছিলেন ছিলেন সিলেট বিভাগের কোটি মানুষের হৃদয়। বিনয়ী কামরান ছিলেন একজন সুবক্তাও। সহজেই আপন করে নিতেন যে কাউকে। রাজনীতির মানুষ হলেও রাজনীতির বাইরের মানুষের প্রতি গভীর মমত্ববোধ ছিল তাঁর। বদর উদ্দিন কামরানের মৃত্যুতে শোকে ভাসছে সিলেট। দলমত নির্বিশেষে বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষের মধ্যে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। এটা কোনো আরোপিত শোক নয় মানুষের স্বস্তঃস্ফূর্ত প্রকাশ। স্বাস্থ্যবিধি মেনে নির্দিষ্ট সংখ্যক মানুষের তাঁর জানাজায় উপস্থিত থাকার কথা ছিল। কিন্তু মানুষের ভালোবাসার কাছে পরাজিত হয় সকল নিষেধাজ্ঞা। করোনা আক্রান্ত কামরানের দাফনে অংশ নেন হাজারো মানুষ। তাঁর শেষ বিদায়ে প্রমাণিত হয়েছে তিনি সত্যিকারের জননন্দিত নেতা। তিনি নগরবাসীর সুখ দুঃখের সঙ্গী ছিলেন আমৃত্যু। নগর পিতার আসনে না থাকলেও সবার হৃদয়ে যেন তাঁর নাম ‘মেয়র কামরান’। রাজনৈতিক নেতার চেয়ে জনসাধারণের নেতাতেই ছিল তাঁর প্রশান্তি। সাধারণের মাঝেই তিনি অনন্য অসাধারণ। সজ্জন রাজনীতিবিদ গণমানুষের কামরান চিরকাল বেঁচে থাকবেন সিলেটবাসীর হৃদয়ে। গভীর শ্রদ্ধা জনতার কামরান। শান্তিতে থাকুন পরপারে।