Cinque Terre

শাহ ফখরুজ্জামান

১১ জুলাই , ২০২০


আইনজীবী ও সাংবাদিক


করোনাকালের হবিগঞ্জ : মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ

মাস খানেক আগে মহামারি করোনা ভাইরাস নিয়ে বাংলাদেশে তৈরি একটি অ্যানিমেশন ভিডিও ব্যাপকভাবে ভাইরাল হয়েছিল। এর বিষয়বস্তু ছিল করোনা ভাইরাসের বাংলাদেশ প্রতিনিধির সঙ্গে চীনে থাকা ওস্তাদের কথোপকথন। সেখানে ওস্তাদ বাংলাদেশের প্রতিনিধিকে কেন এই দেশে বড় আঘাত হানতে পারল না, তার কৈফিয়ত তলব করে। বাংলাদেশের প্রতিনিধি এই দেশে করোনার ব্যর্থ হওয়ার কারণগুলোতে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন অসঙ্গতি তুলে ধরে। এই দেশের মানুষ করোনার চেয়েও ভয়ঙ্কর বলে বর্ণনা করে ওই প্রতিনিধি।

আবার করোনার শুরুতে আমাদের দেশে ‘আমরা করোনার চেয়েও শক্তিশালী’ এ ধরনের একটি কথাও ব্যাপক আলোচিত ছিল। এ নিয়েও মিডিয়ায় অনেক লেখালেখি এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেক কথা হয়েছিল। বাস্তব বিচার করলে আমরা কিন্তু প্রমাণ করেছি সেই অ্যানিমেশনের ভাষায় আমরা করোনার চেয়েও ভয়ঙ্কর। অথবা জনপ্রিয় আলোচনা আমরা করোনার চেয়েও শক্তিশালী। কারণ আমাদের করোনায় যে ক্ষতি করেছে, তার চেয়ে আমাদের মানুষেরা কী কম ক্ষতি করেছে। এখানে অর্থনৈতিক ক্ষতির চেয়ে মানুষের মৃত্যু এবং নৈতিকতার মানদণ্ডে বিবেচনা করলেই বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে।

করোনাকালে এ দেশের বিপন্ন মানুষ অনুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে সবকিছু যাছাই করছে। মিডিয়াকর্মীরাও ঝুঁকি নিয়ে সেই মানুষের সামনে আমাদের স্বনামধন্য ব্যক্তি ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অপকর্ম তুলে ধরছেন। স্বল্প পরিসরে হলেও এর সবকিছু পর্যালোচনা করা আমার উদ্দেশ্য নয়। আমার কাছে যে বিষয়টি বেশি নাড়া দিয়েছে, সেটি হলো আমার প্রিয় হবিগঞ্জে করোনাকালেও খুন, দাঙ্গা,আত্মহত্যা আর বিভিন্ন অপরাধের বিষয়টি।

বাংলাদেশের ভূ-বৈচিত্রের অনন্য জনপদ হবিগঞ্জের একটি নেতিবাচক পরিচিতি ‘দাঙ্গা প্রবণ এলাকা’ হিসেবে। এই পরিচয় থেকে আমাদের মুক্তির জন্য বিভিন্ন সময় নেওয়া হয়েছে অনেক উদ্যোগ। কিন্তু করোনাকালে আমরা সেই পরিচিতিকে যেন আরও স্থায়ী রূপ দিতে উঠে-পড়ে লেগেছি!

হবিগঞ্জে করোনাকালেও বন্ধ হয়নি গ্রাম্য দাঙ্গা ও খুন। বরং স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে তা অনেক বেড়ে গেছে। প্রায় দিনই জেলার বিভিন্ন এলাকায় ঘটছে খুনের ঘটনা। কোনো দিন একাধিক খুনের ঘটনাও ঘটছে। এর বাইরে আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটছে উল্লেখযোগ্য হারে। ঘটেছে অনেক ধর্ষণের ঘটনা। জেলায় গত চার মাসে ৩৪টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। অথচ ওই সময়ে করোনায় মারা গেছেন ছয়জন। যদিও একটি মৃত্যুও কাম্য নয়। গত ২৫ জুন শুধু বানিয়াচং উপজেলায় একদিনে তিনজন আত্মহত্যা করেছেন। এমনকি রাস্তায় তেমন যানবাহন না থাকলেও প্রায়দিনই সড়ক দুর্ঘটনায়ও প্রাণহানি ঘটছে।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, বুধবার ৮ জুলাই জেলার চুনারুঘাট ও নবীগঞ্জে দুটি খুনের ঘটনা ঘটেছে। বুধবার বিকেলে চুনারঘাটে আপন বড় ভাইয়ের দায়ের আঘাতে ছোট ভাই খুন হন। পরে পুলিশ হত্যাকারী ও তার ছেলেকে আটক করে। নবীগঞ্জে খুন হয় এক কিশোর।

জেলা পুলিশের তথ্যমতে, মার্চ থেকে জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত চার মাসে ৩৪টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। এর মধ্যে মার্চে ১০টি, এপ্রিলে ৬টি, মে মাসে ১০টি, জুন মাসে চারটি এবং জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে চারটি খুন। এই চার মাসে জেলায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে শতাধিক! এসব সংঘর্ষ-সংঘাতে আহত হয়েছেন হাজারেরও বেশি। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে অর্থ-সম্পদেরও। এরমধ্যে জেলার নয় উপজেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটেছে লাখাই ও মাধবপুর উপজেলায়। মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত চার মাস জেলায় আত্মহত্যা করেছে ৪৭জন। এর  মাঝে ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেছে ২৯ জন এবং বিষপানে ১৮জন। চার মাসে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ১৯টি এবং শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ৩১টি।

হত্যাকাণ্ডগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ভাইয়ের হাতে ভাই খুনের ঘটনা ঘটেছে বেশ কয়েকটি। স্বজনদের বিভিন্ন বিরোধে সবচেয়ে বেশি হত্যার ঘটনা ঘটেছে। এসব হত্যার নেপথ্যে সম্পত্তির বিরোধ এবং আধিপত্য অন্যতম। তুচ্ছ বিষয় নিয়েও ঘটেছে অনেক ঘটনা। আর পারিবারিক বিরোধ থেকে আত্মহত্যা এবং অনান্য অপরাধগুলো ঘটেছে।

এই হত্যা এবং আত্মহত্যার ঘটনাগুলোর কারণ উদঘাটন করে তা থেকে উত্তরণের কৌশল বের করা অতি প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। এ নিয়ে সামাজবিজ্ঞানী ও মনোবিজ্ঞানীদের মাধ্যমে একটি প্রকল্প নিয়ে গবেষণা করে কারণ উদঘাটন ও অবস্থার উন্নয়নের কৌশল গ্রহণ করা যেতে পারে। সরকারের পাশাপাশি কোনো এনজিও এখানে এগিয়ে আসতে পারে।

অনেক সমাজবিজ্ঞানী ও মনোবিজ্ঞানীর সঙ্গে সম্পর্ক থাকায় তাদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা এবং পর্যালোচনা করে যে পর্যবেক্ষণ পেয়েছি, সেটার মধ্যে প্রধান বিষয় হল এখানকার লোকজনের ইগো সমস্যা প্রকট। ফলে সামান্য বিষয় নিয়ে এখানে খুন ও দাঙ্গার ঘটনা ঘটছে। পাশাপাশি ধর্মীয় শিক্ষার অভাবও একটি কারণ। পারিবারিকভাবে মূল্যবোধের শিক্ষা না থাকা এবং সামাজিক অবক্ষয়ের জন্য এখানে তুচ্ছ বিষয় নিয়ে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।

এর বাইরে এখানে লোকজনের মাঝে কর্মবিমুখতার প্রবণতা আছে। অনেক লোক কাজ করার সামর্থ থাকলেও কাজ না করে পরিবারের অন্য সদস্যের আয় অথবা বিদেশে থাকা স্বজনদের পাঠানো অর্থ দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। আর এই কর্মহীন লোকজন বিভিন্ন সমস্যা তৈরি করেন।

আমার ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণে সবচেয়ে বড় যে বিষয়গুলো সামনে এসেছে, সেগুলো হলো এখানে উত্তরাধিকারী আইন অনুযায়ী ফরায়েজ নিশ্চিত না করা। বিশেষ করে মুসলমান ধর্মালম্বীদের ধর্মগ্রন্থ পবিত্র কোরআন শরীফে ফরায়েজ নিশ্চিত করার জন্য ফর্মুলা দেওয়া থাকলেও সেটি প্রায় স্থানেই যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হয় না।

উত্তরাধিকারীর সম্পদ বণ্টনের সময় একজন অন্যজনকে ঠকানোর চেষ্টা করেন। আর নারীদের বঞ্চিত করার ঘটনা এখানে স্বাভাবিক বিষয় হিসেবে প্রায় সবাই অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন। সুষ্ঠুভাবে বণ্টন না হলে এখানে ক্ষোভ ও বিরোধ সৃষ্টি হয়। যা চলতে থাকে বংশ পরম্পরায়। এ বিষয় নিয়ে পরে খুনের ঘটনাও ঘটে।

এক সময় সামাজিক বন্ধন অনেক দৃঢ় ছিল বলে নারীরা তাদের পৈত্রিক সম্পদ না নিয়ে ভাইদের দিয়ে দিতেন। কালক্রমে এটিই সংস্কৃতিতে রূপ নেয়। আবার নারী স্বেচ্ছায় পৈত্রিক সম্পত্তি নেবেন না বলে চলে আসলেন, কিন্তু কোনো দলিল সম্পাদন করে দিলেন না, পরে ওই নারীর পরবর্তী প্রজন্মের কেউ সম্পত্তির দাবি নিয়ে হাজির হন। মামলাও করেন। ফলে বিরোধ দেখা দেয়।

আরেকটি বিষয় হলো অনেক সময় যৌথ সম্পত্তির রেজিস্ট্রি বণ্টন না করে মৌখিকভাবে বণ্টন করার পর একজন তার অংশে বড় ঘর তৈরি করলেন। পরে অন্য একজন সেই মৌখিক বণ্টন না মেনে ঘরসহ ওই অংশটি নিজের বলে দাবি করেন। বা দখলের চেষ্টা করেন। অথবা মামলা করেন। পরে জটিলতা বাড়তে থাকে। এর বাইরে কাগজে থাকা নির্ধারিত অংশের বেশি দখলের প্রবণতা। রাস্তা বন্ধ ও সরু করে দেওয়া। পানি নিষ্কাশনে বাধাসহ বিভিন্ন কারণে স্বজনদের মাঝে বিরোধ সৃষ্টি হয়। পরবর্তীকালে মামলা ও হত্যার মতো ঘটনা ঘটে।

সম্পত্তি নিয়ে এ ধরনের বিরোধকে কেন্দ্র করে হবিগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে ১৪৪ ধারায় যে পরিমাণ মামলা হয়, তা দেশের অন্য যেকোনো জেলার চেয়ে বেশি। পার্শ্ববর্তী মৌলভীবাজার জেলায় যেখানে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট তার চেম্বারে বসেই এ ধরনের মামলা নিষ্পত্তি করে দেন, সেখানে হবিগঞ্জে দীর্ঘসময় এজলাসে বসে কাজ করেও জট কমাতে পারেন না বিচারক!

গ্রাম্য মাতব্বরদের নিজেদের গোষ্ঠীগত আধিপত্য বিস্তারের জন্য দাঙ্গা এবং হত্যার ঘটনা এখানকার আরেকটি সংস্কৃতি। আজমিরীগঞ্জের নোয়াগড় গ্রামের আলোচিত দুই পক্ষের মধ্যে আধিপত্যের দ্বন্দ্বে সাতটি খুনের পরও বন্ধ হয়নি বিরোধ। এই করোনাকালেও ওই দুই পক্ষ দুই দফা সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে। পুলিশের শক্ত ভূমিকা না থাকলে সেখানে একাধিক খুনের সমূহ সম্ভাবনা ছিল। প্রতিপক্ষকে ফাঁসানোর জন্য নিজের লোককে মেরে ফেলার ঘটনাও আমরা দেখেছি। সাম্প্রতিককালে হবিগঞ্জে বেশ কয়েকটি এ ধরনের হত্যার কথা দেশ-বিদেশে আলোড়ন সৃষ্টি করে। গাড়ি ও সম্পদ ছিনিয়ে নেওয়ার জন্যও হচ্ছে হত্যাকাণ্ড। ধর্ষণের পর হত্যা। সাতছড়ির জঙ্গল আর হাওরে হত্যার পর লাশ ফেলে দেওয়ার ঘটনাও আমরা দেখেছি বেশ কয়েকটি।

করোনাকালে মানুষ যেখানে মৃত্যুভয়ে সেই অপরাধ থেকে দূরে আসবে বলে আমরা চিন্তা করেছিলাম বাস্তবে ঘটেছে তার উল্টো। উপরের পরিসংখ্যান দেখলেই তা সহজে অনুমেয়। এক শ্রেণির মানুষ যেখানে অন্ন যোগাতে দিশেহারা তখন আরেক শ্রেণি ঠিকই তাদের অপকর্ম অব্যাহত রাখে। কাজ কর্ম কমে যাওয়ায় অবসরে থাকা লোকজন সেই খুন আর দাঙ্গার মিছিলে যোগ দেয়। সাধারণত অর্থনৈতিক সংকটে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই বেড়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু সৃষ্টিকর্তার কৃপায় আর সরকারের বলিষ্ট পদক্ষেপে খাদ্য সমস্যা সৃষ্টি না হয়নি। প্রশাসন ও পুলিশের তৎপরতায় এ ধরনের তেমন কোন অপরাধের ঘটনাও ঘটেনি। কিন্তু করোনাকালে তুচ্ছ বিষয় নিয়ে যেভাবে প্রাণহানীর ঘটনা বেড়েছে তা নিয়ে সমাজ ব্যবস্থা নিয়ে চিন্তার সময় এসেছে। এক সময় ঘোষণা দিয়ে আর প্রস্তুতি নিয়ে যে দাঙ্গা এবং খুন হত তাও বন্ধ হয়েছে। তারপরও কেন এমনট হচ্ছে?

তবে হবিগঞ্জের দাঙ্গা ও খুনের বিষয়ে লোকজনকে সচেতন করতে বিভিন্ন সময়ে প্রশংসনীয় ভূমিকা রেখেছে পুলিশ প্রশাসন। সাবেক পুলিশ সুপার ও বর্তমানে সিলেটের অতিরিক্ত ডিআইজি জয়দেব কুমার ভদ্রের পৃষ্ঠপোষকতায় এ বিষয়ে তৈরি হয়েছে সিনেমাও। বর্তমান পুলিশ সুপার মোহাম্মদ উল্ল্যা আরও অনেক সৃজনশীল উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। নিজে সমাজ বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন বলে তিনি সমস্যার কারণ ও সমাধানের কৌশল বুঝতে পেরে এ ধরনের উদ্যোগ নিতে পেরেছেন। তার উদ্যোগে লিফলেট বিতরণ, পোস্টার লাগানো, উঠান বৈঠকের আয়োজন এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে বিভিন্ন অনুষ্ঠান করে গ্রাম্য দাঙ্গার কুফল সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে সচেতন করার বিষয়টি অনেক ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে। করোনাকালে এই হত্যাকাÐ বেড়ে যাওয়ায় পুলিশ সুপার একটি কর্মসূচি গ্রহণ করেছেন। যার শিরোনাম ‘পারিবারিক সহিংসতা রোধকল্পে এবং হত্যাকান্ডের ঘটনা নিয়ন্ত্রনের লক্ষ্যে জনসচেতনতা পক্ষ পালন’। এই কর্মসূচিতে ১২টি দিক নির্দেশনা দিয়ে বিভিন্ন স্থানে পত্র প্রেরণ করা হয়েছে। তবে শুধু পুলিশ প্রশাসনে এই উদ্যোগ যথেষ্ট নয়। জনপ্রতিনিধি, শিক্ষক, ইমাম ও সচেতন নাগরিকদেরও এগিয়ে আসা প্রয়োজন।

হবিগঞ্জে করোনাকালে সবকিছু ভুলে গিয়ে যেভাবে তুচ্ছ বিষয় নিয়ে স্বজনকে হত্যা করা হয়েছে, দলবেঁধে দাঙ্গায় নামা হয়েছে, সাধারণ লোকজনকে বিপদে ফেলা হয়েছে, বর্ডার দিয়ে মাদক আর চা পাতার চালান নিয়ে দৌড়ঝাঁপ চলছে, আবার অনেক জনপ্রতিনিধির অপকর্ম সীমা যেভাবে অতিক্রম করেছে, তাতে করে বলা চলে করোনা সত্যিই আমাদের কাছে হার মেনেছে।