Cinque Terre

অরুন শীল

০৪ এপ্রিল , ২০২৩


শিশু সাহিত্যিক
কবি তুষার কর-এর কিশোরকবিতা

বাংলাদেশের কিশোরকবিতা অঙ্গনে তুষার কর এক তেজোদীপ্ত নাম। দীর্ঘ সময় ধরে তিনি বিভিন্ন মাধ্যমে সাহিত্যচর্চা করলেও কিশোর কবিতা তাঁর ধ্যানবিন্দু। শিশু-কিশোর মনস্তত্ত্বের অতলদেশ ছোঁয়া তাঁর প্রতিটি কবিতা। তাঁর ভাষা ও উপস্থাপনা পাঠক হৃদয়কে আলোড়িত করে। নীরব একনিষ্ঠ এই সাহিত্যসাধক তার লেখনী গুনে কবি শামসুর রাহমানের প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেছিলেন। কবির স্মৃতি গদ্য ‘কালের ধুলায়’ তার উল্লেখ রয়েছে।

একাত্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধা পেশা ব্যাংকার (সাবেক) কবি তুষার কর আজীবন সাহিত্য ও সংস্কৃতির সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছেন। উদীচী, বাংলাদেশের রবীন্দ্র সংগীত সম্মিলন পরিষদ, খেলাঘরসহ বিভিন্ন সংগঠনের সাথে তিনি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। প্রগতিশীল প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে তিনি সামনের সারিতে থাকেন। প্রগতিশীল মানবিক লেখক হিসেবে সিলেটে তিনি অত্যন্ত পরিচিত মুখ। তিনি দীর্ঘ সময় ধরে সাহিত্যচর্চা করলেও এ পর্যন্ত তাঁর চারটি ছড়া ও কিশোরকবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে। এগুলো হলো, ‘আমার কিছু কথা আছে’, ‘মাঠ হারিয়ে যায়’, ‘ভাঙা পথের রাঙা ধুলো’ ও ‘আমরা চলব আমাদের মতো’। 

মন ও মননে তিনি মাটিসংলগ্ন মানুষ। একাত্তরের রণাঙ্গনের বীরযোদ্ধা। চিন্তা ও চেতনায় তিনি উদার অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল ব্যক্তিত্ব। তিনি সবসময় সময়ের সাথে এগিয়ে  রয়েছেন। উঠতি তরুণদের মুখে প্রায়ই শোনা যায় ‘আমাকে আমার মতো থাকতে দাও, আমি নিজেকে নিজের মতো গুছিয়ে নিয়েছি’ গানটি। সেই আমাকে আমার উচ্চারণ করে পারস্পরিক এক সংযোগ তৈরির মাধ্যমে ভিন্ন মাত্রায় কবি তুষার কর বলেন ‘আমারা চলব আমাদের মতো, / দুর্গম পথ কঠিন সে ব্রত,/..... মিথ্যার কাছে হব নাকো নত/ আমারা চলব আমাদের মতো’/। কবির এই বুদ্ধিদীপÍ উচ্চারণের শক্তিতে তাঁর স্বপ্ন আমাদের সকলের হয়ে উঠেছে। আমরা শব্দের মাধ্যমে তিনি এমন একটি শক্তি সঞ্চার করেছেন, যেখানে ‘আমি’ শব্দটা ‘আমরা’ হয়ে সংকল্পবদ্ধ এক সুন্দর কিশোর শ্রেণির মেজাজ নিয়েছে। ফলে ‘আমরার’ কথা কবির একার সন্ন্যাস না হয়ে সকলের হয়ে আমাদের বুকের ভেতর স্বপ্ন সঞ্চার করে। কিশোরকবিতার মুল শক্তিই হচ্ছে পাঠকের মনে স্বপ্ন ও আনন্দ সঞ্চার করা। কৈশোরিক সংকল্পবোধে শুভবোধে পাঠকের চেতনার ভেতর কবির ভাবনা একাকার হয়ে যেতে পারলে তবেই আসে সার্থকতা। পাঠককে স্বপ্নে আচ্ছন্ন করে রাখার অপার ক্ষমতাই হচ্ছে কবির অন্তর্নিহিত শক্তির প্রকাশ। কবি তুষার কর এখানে সার্থক। ছোটোদের মনস্তত্বের ব্যাপারেও তিনি সচেতন। শিশু-কিশোর মনের আশা আকাক্সক্ষা আনন্দ উচ্ছ্বাস স¦প্ন-কল্পনা সব যেন উঠে আসে তার কবিতায়। কবি তার সময় ও জীবনকে কবিতায় ধরে রাখেন। সাহিত্যে স্থানিকতার বিষয়টি সর্বজনস্বীকৃত। অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি সিলেট নদী, পাহাড়, অরণ্য, হাওর, চা বাগান আর কমলালেবুর এক সুগন্ধিময় দেশ। এইসব সুগন্ধ তিনি কবিতায় জড়ো করতে চেয়েছেন। তাঁর এসব কবিতা পড়তে পড়তে আলোময় এক মায়াময় জগৎ পরিভ্রমণ হয়ে যায়। ‘এই অরন্য’ স্নিগ্ধ সুন্দর একটি দীর্ঘ কবিতা। দীর্ঘ হলেও শব্দের ও ছন্দের শক্তিশালী বুনন গুণে কোথাও ঝুলে  পড়েনি। পুরো কবিতায় টান টান ভাবে তিনি প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য ও মানুষের  নিষ্ঠুরতা তুলে ধরেছেন। ‘এই অরন্য এখানে থাকুক, মেঘের মায়াটি মেখে/, দিন দিনে আমি বেড়ে তো উঠছি শ্যামল দেখে/ পাখিরা এখানে উড়ুক ঘুরুক মুক্তির ডানা মেলে/ উজাড় করো না বনভুমিকে, বাতাস যাক না খেলে।/ গাছেরা যে কাঁদে, পাতারাও কাঁদে আঘাতটা পেলে গায়ে।/ অভিশাপ বুঝি নেমে আসে ঠিক তক্ষুনি পায়ে পায়ে/ গাছগুলো রোখে ঝড় ও ঝঞ্ঝা, হাজার দুর্বিপাক/ ভালোবাসা দাও, হাতটি বাড়াও, বনভূমি বেঁচে থাক। এভাবে বৃক্ষ ও বনভূমির বর্ণনায় তিনি আমাদের অনেক অর্জন, সর্ম্পক ও দস্যুতার কথা বলতে বলতে বোধিবৃক্ষের ছায়ায় ভগবান বুদ্ধের নির্বাণ লাভ, রামায়নের রাম-সীতার বনবাস, রাবনের পঞ্চবটিবন ও সীতাহরণ, পান্ডব ও দ্রৌপদীর বনবাস, সাধুসন্ত পর্যটকদের জন্য সুন্দর শান্ত স্নিগ্ধ বনভূমির দিকে পাঠক মনকে নিয়ে গেছেন। যেখানে স্মৃতি জাগানিয়া নীরব এক বনভুমিকে আমরা অবলোকন করি। সেখানে বনের পশুপাখির জীবনকে তিনি গভীর মমতায় তুলে ধরেছেন। ‘পুরানো একটি অশ্বত্তের কাছে জানা যাবে কত কিছু/ বাকালে পাতায় অভিজ্ঞতায় মাথা করে আছে নীচু। ছোটো সে পাখি, পিঁপড়ে এবং কাঠবিড়ালীর ছানা/ সকলে বন্ধু, সকলের সাথে বহুকাল ধরে জানা’।/ কবির মমতাবোধ, মানবতাবোধ, চিত্র কল্পনা, মধুময় ভাষা কবিতার সৌন্দর্যকে অনেকখানি বাড়িয়ে দিয়েছে। এই প্রকৃতির আরো কিছু দুর্দান্ত কবিতা রয়েছে, তার ‘ভাঙা পথের রাঙা ধুলো’ গ্রন্থে। ‘পাহাড় তুমি’ ‘পাখি হয়ে যাই’, ‘চায়ের পাতার দেশে’, হাওর দেখেছো কখনো তুমি’, ‘আমার যে কুলাউড়া’, শিরোনামের অসাধারণ সব কবিতা।

মেঘেরা এসেছে আজ নিচে নেমে আকাশ পেয়েছি  আমি

যেখানেই যাই, যে দিকে তাকাই, নিজেকে ভাবছি দামি

..............................................

রৌদ্র ছায়ায় মনোরম শোভা, পৃথিবী কত বড়

তৃণে ও তরুতে উৎসব শুরু, সুন্দর হয় জড়ো

.....................................................

ধন মান খ্যাতি প্রয়োজন নেই, কিছুই চাই না তার

গন্ধে-পুলকে ঘুম ভেঙে যায়, পথ ডাকে বার বার

....................................................

ঢেউয়ের ছন্দ নদীতে সাগরে, নিখিল ভুবন জুড়ে

ধ্রুবতারা আর শুকতারা চোখে, পাখি হয়ে যাই উড়ে (পাখি হয়ে যাই উড়ে)

পুরো কবিতা কি কাব্যিকতায়, কি উপমায়, কি ছন্দে অন্ত্যমিলে সব দিকে

সমধুর গীতিময় ও সুন্দর। কবি নিজেকে এখানে উজাড় করেছেন। এরকম আর একটি কবিতা ‘পাহাড় তুমি’।

‘পাহাড় তুমি প্রতিদিনই  দাঁড়িয়ে থাকো একা

নদীর তীরে বনের ধারে তুমি কাজল রেখা

................................................

বৃষ্টি এলে ভিজতে তোমার লাগে কী খুব ভালো

জোনাক পোকা রাতের বেলা জ্বালায় তাদের আলো?

.............................................

নীরবতা তোমার ভাষা, তুমি অনেক বড়

তোমার মতো আকাশ ছোঁয়া আমায় তুমি করো।’

এই স্থানিকতা, সময় ও জীবনের প্রভাবে প্রভাবিত সাহিত্য পৃথিবীর প্রতি প্রান্তরের কবি সাহিত্যিকদের সাহিত্যকর্মে বিরাজমান। নিজের গ্রাম, জেলা, দেশ, সময়, ভূ-প্রকৃতি, ঋতু, রাজনীতি, সমসাময়িক ঐতিহাসাহিক অর্জন ইত্যাদি কবির সৃষ্টি জুড়ে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। প্রতিজন লেখক সাহিত্যিক কবির কাছে  জন্মস্থান, স্কুল গ্রাম ও শৈশব কৈশোরের স্মৃতি বড়ো মধুময়। চায়ের পাতার দেশ সিলেটের শ্যামল নিসর্গ শোভিত জাফংল চা বাগানে ৫ ডিসেম্বর ১৯৫০ সালে কবি তুষার কর-এর জন্ম। পৈতৃক নিবাস মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার করের গ্রামে। তাই,স্বভাবতই চা বাগানের সৌন্দর্য কবির কবিতায় মূর্ত হয়ে ওঠে। অন্ত্যমিলহীন এই কবিতা খুব সুন্দর।

‘দুটি পাতা আর একটি কুঁড়ির গালিচা বিছানো পথ

দু’পাশে পাহাড়, মাঝখানে পথ, চলে গেছে বহুদূর,

অরুণ আলো যে দুয়ার খুলেছে ঘন্টা বাজালো তাই

ধূলিমাটিময় জীবনের কথা লিখে রাখে প্রতি ভোর।’

এখানে চা পাতাজীবীদের জীবন, সবুজ স¦প্ন, পথের নুড়ি, পালাপার্বণ, তরুময়

ছায়াময় বাংলো, ঘরবাড়ি, নীরবতা, ষড়ঋতু চাপাতা প্রক্রিয়াকরণসহ অপরূপ সব রঙিন অনুষঙ্গ ছন্দে ও সুরে চিত্রময় হয়ে আছে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের দেখানো পথে বাংলাদেশের কবি আহসান হাবীব ও আল মাহমুদের ধারায় পুষ্ট কিশোরকবিতা কবি সুজন বড়ুয়ার প্রচেষ্টায় আজ মহিমান্বিত। তুষার কর সেই ঘরনার একজন নিবিষ্ট কবি। কিশোরকবিতায় মগ্ন এক ভাবুক বাউলের মতো কবি। প্রকৃতির ভেতর ডুবে থাকা, অবাক চোখে তার স্বাদ আস্বাদন করা, নিজের ভেতরের অনুভূতিকে কোমল শব্দ প্রয়োগে পাঠকের সম্মুখে মেলে ধরার নীরব সাধক তিনি। ‘একটি মাঠের গল্প’, ‘মেঘদের ঠিকানা’, ‘বৈশাখ ও পাখির পালা’, ‘ওগো পাখি,’ এবং ‘ওগো ভোরের আলো’ অপরূপ সব কবিতা।

‘হাওর দেখেছো কখোনো তুমি? দেখেছো কি বড় বিল

মেঘের ছায়ায় রোদের আঁচল আকাশের গাঢ় নীল

উদাসী মনের প্রকৃতি এখানে সুরময় ভায়োলিন

ঢেউয়ের দোলায় নিত্য যে দোলে, বেদনায় হয়ে নীল। 

.................................................

হিজল তমাল নল খাগড়ায় বনের ধারটি ঘেঁষে

সোনালী এবং রূপালী মাছেরা যায় বহুদূর ভেসে

মায়াবী ছবির মুগ্ধ আবেশে বৃষ্টিতে ভেজে মন

অমল ধবল পাল তোলা নাও পায় যে সোনার ধন।

পুরো কবিতাটি পড়লে মনের ভেতর এক স্নিগ্ধতা নেমে আসে। কবিতা যে জুতসই শব্দ প্রয়োগের শিল্প তা তুষার করের ‘হাওর দেখেছো কখনো তুমি ’ পড়লে বোঝা যায়। সুন্দর যথাযথ শব্দ প্রয়োগের ফলে মনের ভেতর অন্যরকম  মুুুুুুুুুুুুুগ্ধ আবেশ ছড়িয়ে পড়ে। হাওর নিয়ে এমন সুন্দর কিশোরকবিতা আমি পড়িনি। অভিনন্দন কবি।

কবি তুষার কর একাত্তরের রণাঙ্গনের একজন সক্রিয় মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তাঁর সম্পাদনায় ‘সাপ্তাহিক দূর্জয় বাংলা’ প্রকাশিত হয়। তাঁর কবিতায় রয়েছে একাত্তরের রণাঙ্গনের জ্বলজ্বলে স্মৃতি। আমাদের বাংলাদেশ, আমাদের মা, মুক্তিযুদ্ধ ও মাতৃভাষার কথা, বঙ্গবন্ধুর কথা তাঁর কবিতায় বারবার এসেছে। তিনি মন ও মননে ষোলোআনা বাঙালি। মহান একুশ, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার প্রতি গভীর শ্রদ্ধাবোধের পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর কৈশোর ও প্রথম যৌবনে ‘দেশ ছিল অগ্নিগর্ভ। স্বাধীনতার পথে এক একটা গণসংগ্রাম, গণজাগরণ গণ-অভ্যুত্থনের ঢেউ অতিক্রম করেছে এই দেশ। অগ্নিগর্ভ সেই সব দিনের কথা ফুটে ওঠে তাঁর কবিতায়। ‘স¦াধীনতা’, ‘শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি’ ও ‘একুশের ইশতোহার’ ‘একাত্তরের কথা’, মুখটা খুলে’, কবিতায় তিনি গভীর শ্রদ্ধায় তা ধারণ করেছেন। ‘আস্তে রাখবে পা/ এখানে বোনের চুল/ এখানে মায়ের হাত/ তবু কেন হয় ভুল?’ (স্বাধীনতা) বধ্যভূমির প্রতি শ্রদ্ধাবোধের কথা আমরা ভূলে যাই। কবি অল্প কথায় তার চিত্র তুলে ধরেছেন। এভাবে ‘একুশের ইশতেহার’ কবিতায় তিনি স্বাধীনতা বিরোধীদের দম্ভ, আমাদের চেতনা ও উদ্দীপনার কথা বলেছেন নিপুণ দক্ষতায়। শব্দ নিবার্চনে তিনি একজন কুশলী কারিগর তা এখানে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ‘প্রভাতফেরীর মিছিল তোমাকে ডাকে/ এখানো রয়েছে অনেক তো কাজ বাকি/ দৈত্য-দানোরা দম্ভ এখনো হাঁকে/ উড়তে যে চায় পরাজিত বাজ পাখি’।/...‘অজেয় শক্তি শহীদ মিনার বঙ্গে/ জেগে উঠবার গেয়ে যায় আজো গান তো/ সে যে মণিহার বাংলায় সারা অঙ্গে/ উদ্দীপনার উৎস তো অবিশ্রান্ত।’

এভাবে ‘শহীদ মুুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি’ কবিতায় তিনি বলেছেন, ‘একটি শ্লোগান ছিল যে রাখির বন্ধন/ উদ্যত ছিল সঙ্গিন মুখোমুখি/ প্রতিরোধে কত রাত দিন গেছে কেটে/ সুনীল স্বপ্ন দিয়ে যেত মনে উঁকি।

আন্দোলন সংগ্রাম আত্মত্যাগের অগ্নিগর্ভ সময়ে তিনি দেশ ও দেশের মানুষকে চিনেছেন জেনেছেন। তাঁর লেখায় তাঁর ব্যক্তি আদর্শ ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় ফুটে ওঠে। ‘মায়ের চিঠি’, ‘চিঠি-১,২,৩’, ‘তোমাকে ডাকছে’ ‘মুক্তিযোদ্ধার সামাধির পাশে’ কবিতায় আমাদের বুকের হুহু কান্না, দেশের জন্য, স্বাধীনতার জন্য জীবনের মায়া ত্যাগের কথা চিত্রায়িত হয়েছে।

‘দিনগুলো ছিল উদ্দাম ঝড়ো হাওয়া

হাতছানি দিতো যুদ্ধের মাঠ তাই

একটি ছেলের গল্প আজকে শোনো

ঘর ছেড়ে দিয়ে ঘরে আসে নাই।

......................................

যুদ্ধের মাঠে কেটে যেত রাতদিন

স্বাধীনতা এলে ফিরবে বলেছে মাকে,

এসব কথা সে লিখতো কাজের ফাঁকে। (চিঠি-১)

মহান একশে ফেব্রুয়ারি, রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ নিয়ে তিনি মনকাড়া সব কবিতা লিখেছেন, যা আমাদের সাহিত্যর অমূল্য সম্পদ হিসেবে কালজয়ী হতে পারে।

কিশোরকবিতায় শিল্প উপকরণ ছন্দ, অন্ত্যমিল, সরলতা, অলংকার ও কল্পনার বিস্তারে তুষার কর সফলভাবে নিজেকে উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছেন। বর্তমানে অনেকেই কিশোরকবিতা সৃষ্টির চেষ্টা করছেন। কিন্তু সঠিক উপলদ্ধির অভাবে বেশির ভাগই পদ্য থেকে যাচ্ছে। ভাবের গভীরতায় প্রতি দৃষ্টি না থাকায়, শুধু তথ্য ও বর্ণনার আধিক্যে বিবরণধর্মী সরল পদ্য হচ্ছে, কিশোরকবিতা নয়। কবি তুষার করের একটা বড়ো গুণ লক্ষনীয় যে, অন্ত্যমিলহীন একটি কবিতা ছাড়া তিনি আর কোনো প্রকার নিরীক্ষাধর্মী কবিতা গ্রন্থভুক্ত করেননি। চিরায়ত ধারায় তিনি কবিতায় পরিভ্রমণ করেছেন। হয়তো পাঠকের সাথে সংযোগ সৃষ্টির প্রচেষ্টায় নিরীক্ষাকে তিনি এড়িয়ে গেছেন। কবিতার প্রাণসংহারী নিরীক্ষা না করে জনপ্রিয় ধারার প্রতি তিনি একনিষ্ট থেকেছেন। কিছু কবিতায় ভাবের গভীরতা পরিণত কবিতার গতিকেই জাগ্রত করেছে। যেমন: ‘রাতের তারা দিনের তিনি রবি/ তাঁরই গানে আকাশ ভরে আছে/ আলোকেরই ঝরনাধারা নামে/ দুঃখ সুুুুখে পাই যে তাঁরই কাছে/ প্রাণের সঙ্গে এমনি বাঁধা সেতু/ কালের হাতে মন্দিরা তাই বাজে/ পাষাণ ভেঙে আনন্দ ওই এলো/ সুরের আগুন ছড়িয়ে সবার মাঝে।’ কবিতার কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে রচিত তিনটি কবিতার সমন্বয়ে দীর্ঘ এ কবিতায় তিনি আমাদের প্রতিদিনের আশ্রয়কে গভীর মমতাভরে চিত্রায়িত করেছেন। ভাবের গভীরতায় তাঁর কবিতার শক্তি অনেক দূর পর্যন্ত আলো ফেলেছে।

এভাবে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা ‘তার কাছে গেলে’ কবিতায় অশেষ শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও সরলতা ভরে বলেছেন ‘এই বাংলার মাঝি আর জেলে/ মুটে ও মজুর, ঘরহারা ছেলে/ সকলের সে যে বন্ধু স্বজন/ সকলের সে যে প্রিয়/ মন ভালো হবে, তাঁর সমাধিতে ভালোবেসে ফুল দিও?/ তাঁর কাছে গেলে হৃদয় জুড়ায়/ প্রতিদিন হই শুদ্ধ/ অটল ঐক্য ছিল দৃঢ় পণ/ একাত্তরের যুদ্ধ/ তার নামে তাই বাংলার মাঠে/ আমরা যেন বুনি ধান/ শেখ মুজিবর রহমান।’ এই কবিতায় তিনি নিপুন দক্ষতায় বঙ্গবন্ধুর প্রতি বাঙালির সীমাহীন ভালোবাসা নির্ভরতা, স্বাধীনতা পাওয়ার সংগ্রামে বাঙালিকে দৃঢ়ভাবে ঐক্যবদ্ধ করার অবিশ্রান্ত পরিশ্রমের চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন।

নদী নির্সগ শ্যামল প্রকৃতির রূপময় কবিতা ‘নদী’, সেই নদী ধান সিঁড়ি’, ‘মেঘদের ঠিকানা’, ‘এসো না মাধবকুন্ডে’, ‘দেশান্তর’, ‘আমি বাংলার ছেলে’, ‘নববর্ষ’, ‘পাখির সাথে’, ‘পালিয়ে যাই দূরে’ ও ‘ওগো ভোরের আলো’ প্রভৃতি কবিতায় আবহমান বাংলাকে কিশোর উপযোগী করে তিনি উপস্থাপন করেছেন। যে বিষয়েই তিনি কবিতা লিখুন না কেন, তা পাঠক হৃদয়কে গভীরভাবে ছুঁয়ে যায়। কবিতায় ছবির পর ছবি পাঠকের সামনে ফুটে ওঠে। শান্ত প্রকৃতির মূর্ত সৌন্দর্য পাঠক দর্শন করে অভিভূত হয়। হৃদয়ে গেঁথে দেওয়া আশ্চর্য সব লাইন স্নিগ্ধ হাওয়ার মতো পাঠকের মনকে শীতল করে। আয়নার মতো দেখতে পাই গাছ পাখি নদী, পাহাড় জঙ্গল, চা বাগান, হাওর, শস্যখেত, মাটি, জলসহ আমাদের অপরূপ বাংলাদেশ।

কিশোর কবিতার ভেতর গল্প গেঁথে দিয়ে বিষয় প্রকরণে একটু অপরিকল্পিতভাবে আলাদা হওয়ার একটা প্রবণতা লক্ষ করি।

কিশোর কবিতা এমনিতেই সীমিত পরিসরের, তার উপর কৈশোরিক ভাবনা ও বিষয় নির্ভর হওয়াতে অনেক কিছু এড়িয়ে চলতে হয়। কিন্তু, তাই বলে আমরা কিশোর কবিতাকে রক্ষণশীল কোনো সাহিত্য মাধ্যম হিসেবে দেখতে চাই না। প্রতিদিনই নবায়নযোগ্যতাই কিশোর-কবিতার মূল গতিপথ। শুধু বিবরণের পর বিবরণ কবিতার শরীর নষ্ট করে। তাই বিবরনের চেয়ে কল্পনা জরুরি। কবির কল্পনাই কবিতার প্রাণশক্তি। কবিতায় প্রাণসঞ্চার না হলে সেটা পাঠক হৃদয়কে নাড়া দেবে কী করে? শব্দ ছন্দ অন্ত্যমিল দিয়ে বিবরণের পর বিবরণ সাজিয়ে কবিতার শরীর নির্মাণ করা যায়, কিন্তু প্রাণ সঞ্চারিত হয় না। সার্থক কবিমাত্রই একটি কি দুটি বাক্যে কবিতায় প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে। তখন অলৌকিক এক ভাষায় কবিতা কথা বলে ওঠে।

‘ওগো ভোরের আলো’ কবিতাটি সুন্দর, কল্পনানির্ভর।

‘ওগো ভোরের আলো,পাহাড় পেরিয়ে এসে

আমাকে জাগাও, কতো না সোহাগ ভরে

কেউ তো জানে না তুমি ছিলে কোন দেশে

আমি বড় হই, তোমার হাতটি ধরে।

আকাশ ঝোঁকে মুখের ওপর, আনন্দ তার বুকে

ইশকুলে যাই কত্ত তাড়া, ব্যাগভরা আছে বই

আমি হেঁটে চলি মেঘেরাও হাঁটে সুখে

ঘাসের বুকে  চাঁপাফুল রঙ, রোদ্দুর হইচই।’

এছাড়া ‘ইচ্ছে হলেই’, আয়ের দামাল ছেলে’

কবিতা দুটোও চমৎকার। ‘গাছে গাছে হাওয়া

লাগে/মাটির বুকে সাড়া জাগে/ আয়রে পাগল,

ছন্নছাড়া/আপন ভুলে আয়/ নদীর মতো সময় বয়ে

যায়/ আয়রে দামাল, আয়রে পাগল আয়।’

নিজেকে নিয়ে লেখা ‘দিনলিপি’ নামক কবিতাটি

দীর্ঘ একটু গতানুগতিক হলেও নিজের মনের দুঃখটুকু

প্রকাশ করা হয়েছে। যেমন ‘দিন যাপনের গ্লানিভরা

দিন/কষ্ট ভীষণ দেয়/জীবনটা কেন গঞ্জনা শুধু/ সুখ তার

কেড়ে নেয়।’

কিশোর কবিতাকে ঠিক এমন হতে হয় যে, তার স্পর্শে মন জেগে উঠবে, কল্পনা তার পাখনা ছড়াবে, স্বপ্ন তার হৃদয় ভরাবে, স্বাদে গন্ধে শিল্প সৌন্দর্যে কবিতা পাঠকের কাছে জীবন্ত হয়ে উঠবে। জীবন্ত হয়ে উঠবে পাঠকের বর্তমান অথবা হারানো সোনালি কৈশোর। শিশুর জগৎ খাপছাড়া হলেও কৈশোর খাপছাড়া নয়। স্বপ্ন ও বাস্তবতার তীব্র অভিঘাতের ছন্দময় জগৎ কৈশোর। পরিপূর্ণ জীবনবোধে জাগ্রত হওয়ার পূর্বক্ষণ মাত্র। এই সময়কে সজীব সুন্দর ও

প্রাণময় করে তুলতে শ্রদ্ধেয় তুষার করসহ যাঁরা কিশোর কবিতার চর্চা করছেন তাঁদের নিরন্তর প্রচেষ্টাকে আমরা একটি আন্দোলন হিসেবে দেখেছি।

তাদের হাতে সময়ের সাথে সাথে গতানুগতিকতার ভেতর থেকে কিশোরকবিতা ধীরে ধীরে বাঁক নিচ্ছে এবং আরো নেবে এই বিশ্বাস আমাদের আছে। কেউ

কেউ এককভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন। আমরা চাই সম্মিলিত উদ্যোগ। তুষার কর একজন অভিজ্ঞ কবি। তিনি আমাদের কাছের মানুষ আপনজন। আমি তাঁর কবিতার মুগ্ধ পাঠক। তিনি সাহসী সংগ্রামী বিনয়ী ও কর্মনিষ্ঠ মানুষ। এখনো লিখছেন পত্রিকার পাতায়। তাঁর নতুন নতুন কবিতা দেখি ও পড়ি। তিনি আমাদের শক্তিমান কবি এবং কিশোর কবিতা অন্তপ্রান মানুষ। একজন শ্রদ্ধেয় সংগ্রামী বীর মুক্তিযোদ্ধ। ভালো থাকুন বরেণ্য কবি তুষার কর। আপনার সৃষ্টিশীল দীর্ঘ জীবন কামনা করি।


এ সংশ্লিষ্ট অন্য লেখা

কবি তুষার কর : আলাপচারিতায় একদিন