শেখর ভট্টাচার্য
২৮ জুন , ২০২৪
কেঁচো খুড়তে যখন সাপ বেরিয়ে আসে তখন মাছের মায়ের পুত্রশোক শুরু হয়ে যায়। আধুনিক যুগ বড় বিচিত্র! এ যুগে উল্টো পুরাণ। মাছের মায়ের কোন ভূমিকা নেই, সাপ বেরোতে দেখলে মাছের বাবারা শোকের বদলে রাগে-গোস্বায় ফেটে পড়েন। স্বাভাবিক অবস্থায় পুত্রেরা টাকার যোগানের জন্য চিন্তা করেন না। পিতা গৌরি সেন পুত্রের সাধ, আহ্লাদ মেটাতে টাকার পাহাড় পুত্রের সামনে হাজির করেন। পুত্রের কাছে তিনি দয়ার সাগর, যেমন এককালে হাজী মুহম্মদ মহসীন ছিলেন দরিদ্র মানুষের কাছে।
তবে আধুনিক গৌরি সেন যে কাজটি করলেন তা দেখে আমাদের আক্কেল গুড়ুম হয়ে গেলো। কী নির্মম, কী নিষ্ঠুর এই আধুনিক গৌরি সেন। আদি গৌরি সেন কিন্তু এতো নিষ্ঠুর ছিলেন না। দেশবাসী বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করলো, পুত্র যখন সামান্য একটি ছাগল কেনে আনন্দে বিগলিত হয়ে ছাগলের সঙ্গে ‘ছাগল-ফি’ সোশ্যাল ম্যাধ্যমে পোস্ট করলো, তখন কেমন করে জানি প্যাণ্ডোরার বাক্স উন্মোচিত হতে শুরু করলো। রাগে, দুঃখে বিবেক, বিবেচনাহীন গৌরি সেন সরাসরি কী না পিতৃত্ব অস্বীকার করে বললেন ‘এ পুত্র আমার নয়’। বাংলা সিনেমার গল্পে এক সময় এই পিতৃত্ব, মাতৃত্ব নিয়ে ঘুরপাক খেতো। পিতৃ পরিচয়হীন সন্তানের গল্প নিয়ে গোটা তিন ঘন্টার একটি বাংলা সিনেমার গল্প রচনা করা হতো। নাম হতো এরকম, ‘ছেলে কার’ অথবা ছেলে তুমি কার। তিন ঘন্টা ভর জট ছাড়ানো। কাহিনী একবার উত্তরে একবার দক্ষিণে, শেষ দৃশ্যে দর্শকরা পিতৃত্ব স্বীকার এবং মধুর মিলন দেখে হাত তালি এবং সিটি দিয়ে সিনেমা হল থেকে বের হতো।
আর এক ধরণের গল্প ছিল। শ্রেণি সংঘাত নিয়ে। শ্রেণি চরিত্রের মহিমা না জেনে যে সব ছেলেরা প্রণয়কাণ্ড ঘটাতো তাদেরকে ত্যাজ্য পুত্র ঘোষণা করতে হরদম দেখা যেতো। বাংলা সিনেমায় চৌধুরী সাহেবরা (পড়ুন গৌরি সেন) সামান্য রিক্সাচালক, গাড়ির ড্রাইভার, কিংবা কাজের বুয়ার মেয়ের সঙ্গে ঢলাঢলি পছন্দ করলেও প্রেমে গদ-গদ হয়ে মোমের মতো গলে যাওয়াকে কোন ভাবেই মেনে নিতে পারতেন না। ধৈর্য্যরে বাঁধ তাদের ভেঙ্গে যেতো। গোপনে এসব মেয়েদের সঙ্গে ফষ্টি নষ্টি করবে এটি তারা মেনে নিতেন তবে প্রেম করে ঘরের বউ হিসেবে তুলে নেবে এটি কোন ভাবেই মানতে পারতেন না। অগণিত সিনেমায় আমরা পিতা, পুত্রকে ত্যাজ্য ঘোষণা করছেন এরকম দৃশ্য দেখেছি। হল কাঁপানো কন্ঠে চৌধুরী সাহেবকে বলতে শুনেছি, “বেরিয়ে যাও, তোমাকে ত্যাজ্য পুত্র ঘোষণা করলাম, এরকম নীচু কাজ যে করতে পারে সে আমার সন্তান নয়। দর্শকের চোখের জলে সিনেমা হলের মেঝে ভেসে গেলেও ছেলেকে শেষ পর্যন্ত ফিরে আসতে বলেননা চৌধুরী সাহেব। শ্রেণি চ্যুতি বলে কথা!
সম্প্রতি জ্যান্ত (পড়ুন প্রকৃত) একজন বাবা সাপ বেরোনোর আলামত পেয়েই সন্তানের পিতৃত্ব অস্বীকার করেছেন। আহারে পুত্র যে দেশে হাজার কোটি টাকার নীচে রাগ ভৈরবী আলাপের সূচনা হয় না সে দেশে সামান্য পনের লাখ টাকার ছাগল নিয়ে কথা হওয়ায়, বাবা তার সন্তানের পিতৃত্ব অস্বীকার করলেন। এতোই সামান্য পরিমান অর্থ যা দিয়ে অনেকের পরিবারের সন্তানদের পাশের বাড়ি থাইল্যান্ড ট্রিপের খরচও কুলোয় না। দেশের ইজ্জত, সম্মান জলাঞ্জলি হলো। ছাগলকাণ্ডের পুত্রের অবস্থা দেখে দেশ প্রেমিক অর্থ পাচারকারীরা মুখ লুকোচ্ছেন।
কয়েকদিন আগে যাকে নিয়ে শোরগোল চলছিল তিনি ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত মহাপরিদর্শক। তিনি তো দর্শক হয়ে বসে থাকতে পারেন না। তিনি আবার শুদ্ধাচার পুরস্কারপ্রাপ্ত। তিনি মহাজন। তিনি আমাদের রোল মডেল। মেয়ের বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে একটি ফ্ল্যাট কিনে কী এমন অপরাধ করেছিলেন! মেয়ের আবদার বলে কথা। সামান্য কয়েক কোটি টাকা দিয়ে মেয়ের জন্য দ্বিপ্রাহরিক বিশ্রামাগার তৈরি করেছিলেন তিনি অভিজাত এলাকায়। তবে তিনি পিতৃত্ব অস্বীকারকারী নয়। একবারের জন্যও তিনি বলেননি, এ মেয়ে আমার নয়। তিনি বাংলা সিনেমার লাইনে হাটেননি, তিনি মার্জিত আধুনিক পিতা।
তবে বড় নিষ্ঠুর ওই রাজস্ব-পিতা, শব্দটি নুতন, শুনতে খারাপ লাগলেও আমার উদ্ভাবনীকে অনুৎসাহিত করবেন না পাঠক। তাকে আমি সম্মান করে রাজস্ব-পিতা হিসাবে তাকে সম্বোধন করছি। রাজস্ব পিতা পুলিশ পিতার থেকে কিছুটা বোকা কিসিমের। তিনি ছেলেকে দিয়ে ছেলে খেলে না করালেও পারতেন। কোরবানির মহৎ উদ্দেশ্যে ছাগল কিনবে, ছাগলের সঙ্গে গলাগলি করে ‘ছাগলফি’ তোলার কী প্রয়োজন ছিল। রাজস্ব পিতা পুলিশ পিতার মতো শুরুতে শত হাজার কোটিতে ধরা পড়েননি, তিনি ভাংতি টাকা অর্থাৎ পনের লাখ টাকার ছাগলে আটকে গেছেন। তবে দুজনই বাংলা বাগধারা অনুযায়ী শিখন্ডি খাড়া করেননি। বড়ই মহৎ, বড়ই স্বচ্ছ তারা। আধুনিক বিসিএসকাক্সক্ষীদের কাছে রোল মডেল। তবে অনেক দুষ্টু লোক বলছে, মহা-দর্শকের দিক থেকে মুখ ফেরানোর জন্য নাকি রাজস্ব বাবুর মুখে আল ফেলানো হয়েছে। জানি না, রাজা , রাজড়াদের কর্মকান্ডের মহিমা বোঝা দায়।
দেশে এক দল মানুষ সীমাহীন স্বাধীনতা ভোগ করছে। তাদের আগমন ঘটে ক্যাডার সার্ভিস এবং রাজনৈতিক দলগুলো থেকে। রাজনীতিকে তার মুঠো বন্দি করেন নানাভাবে। ক্ষমতাসীন দল থেকে টিকেট যোগাড় করে প্রথমে তারা সাংসদ পদ লাভ করেন। অন্যদিকে তারা যখন ‘জনসেবা’ করেন তখন রাজনীতর মানুষ হয় তাদের হাতের পুতুল। রাজনীতির মানুষ যখন সাংসদ, মন্ত্রীত্ব গ্রহণ করেন তাদের অজ্ঞতার সুযোগ নেন ক্যাডাররা।
দোষ শুধু তাদের নয়, দোষ যদি দিতেই হয় তাহলে এসমস্ত কর্মকান্ডের সংস্কৃতি আমরা যারা তৈরি করেছি আমাদের সবার। তাদেরকে ডেকে আমরা ধর্মালয়ের, ‘মেম্বরস অনলি’ ক্লাবের সভাপতি নির্বাচিত করেছি। সমাজ মেনে নিয়েছে তাদেরকে ধর্মালয়, ধর্ম-সভা, খেলাধুলা, সাহিত্য, শিল্প সংস্কৃতি সব কিছুর মধ্যমনি হিসেবে। এছাড়া পদাধিকার বলে তারা নানা প্রতিষ্ঠানের সভাপতি, সচিব। তারা সবাই মিলে আমাদেরকে একটি শৃঙ্খল দিয়ে ঘিরে রেখেছেন, সেই শৃঙ্খলের ভেতর থেকে আমরা লম্ফঝম্ফ করছি। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ ছাড়া আমাদের করার আর কিছুই নেই।
দেশে এখন দুরকম বংশের নাগরিক বসবাস করেন। একটি হলো উচ্চবংশীয় এবং অন্যটি চরম নিম্নবংশীয়। উচ্চবংশীয়রা সকল বংশীয় এবং সকল ভাণ্ডার থেকে নানা কায়দায় অর্থ দেশ বিদেশে রাখা নিজেদের সিন্দুকে রাখার সম্মতি পেয়েছেন। উচ্চবংশীয়রা চলেন উচ্চ লয়ে, উচ্চতালে। এ কারণে কোরবানির জন্য তাদের প্রয়োজন উচ্চবংশীয় ছাগল। রাজস্ববাবুর ছেলেটি যে কাণ্ডে ভাইরাল হয়ে গেলো তাহলো ১৫ লাখ টাকায় ‘উচ্চবংশীয়’ ছাগল” কেনার উদ্যোগ নিয়ে।
একজন সরকারি চাকরিজীবীর কলেজ পড়ুয়া ছেলে কীভাবে এত বিলাসী জীবনযাপন করতে পারেন, তা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠছে। পিতা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালেরও প্রেসিডেন্ট। একজন সরকারি কর্মকর্তা হয়েও শেয়ারবাজারে প্লেসমেন্ট শেয়ারের বড় ব্যবসায়ী তিনি। বিষয়টি তিনি নিজেও অস্বীকার করেননি। যে সন্তানকে অস্বীকার করে সম্পদের হেফাজত করতে চেষ্টা করছেন তার পরিচয় এখন শরতের সকালের আকাশের মতো স্বচ্ছ। পুত্রের মাতা রাজস্ব সাহেবের দ্বিতীয় স্ত্রী। দ্বিতীয়ার বাড়ি ঘরের খবরও এখন সবার কাছে পরিশ্রুত জলের মতো। মহামান্যার বাবার বাড়ি ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার আমিরাবাদ ইউনিয়নের সোনাপুর গ্রামে। তিনি ফেনীর আওয়ামী ঘরানার বিখ্যাত হাজারী পরিবারের নিকট আত্মীয়। ছাগল কাণ্ড দিয়ে যে গল্পের শুরু হলো, সে গল্প বিস্তৃত হচ্ছে ক্রমশ। বিস্তৃত হতে হতে এটি হাজার লক্ষ কোটিতে ইতোমধ্যে পৌঁছে গেছে।
‘এক দেশে ছিল এক রাজা’ এরকম বাক্য দিয়ে একসময় রূপকথার গল্প শুরু হতো। আধুনিক রূপকথা যারা লিখবেন তারা গল্প শুরু করবেন, একদেশে ছিল হাজার হাজার রাজা। রাজারা ছিলেন বড়ই স্বাধীন। তাদের টাকশাল ছিল না আবার ছিলও। তাদের হাতিশাল নেই, তবে কুকুর, বেড়াল, হরিণশাল আছে। প্রজাদের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ রক্ষার মাথা ব্যথা নেই। প্রজাদের শ্রমে যে টাকশাল, ব্যাংক, শেয়ার-বাজার, ইন্সুরেন্স কোম্পানি গড়ে উঠে সে গুলো থেকে তারা প্রকাশ্যে অর্থ লোপাট করেন। রাজাদের মধ্যে বড়ই সদ্ভাব। একজনের বিপদে আর একজন দ্রুত এগিয়ে আসেন। দুষ্টু প্রজারা যখন তাদের নিয়ে বেশি বেশি আলোচনা করেন তখন তারা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। এ কাজে তারা একে, অপরকে সহায়তা করেন। প্রজাদের মধ্যে তারা ধর্ম, রাজনীতি, সামাজিনীতি নিয়ে সব সময় মারামারি, ঝগড়া ঝাটি বাঁধিয়ে রেখে দেশ পরিচালনা করতে তারা আনন্দ উপভোগ করেন। তাদের আদর্শ, কৌশল বিশ্ববাসীর অনুসরণ করা উচিৎ। (পুনশ্চঃ লেখাটি শুরু করেছিলাম রাজস্ব বাবু দেশে থাকা অবস্থায়, জাদুর কাঠি ব্যবহার করে তিনি গত রবিবার ২৩ জুন, ২০২৪ তারিখে দেশ ত্যাগ করেছেন বলে ঢাকার সকল পত্রিকা থেকে জানা গেলো)
এএফ/০৭