Cinque Terre

সুলতানা রাজিয়া

২৯ এপ্রিল , ২০২০


শিক্ষক


সর্বক্ষেত্রেই তিনি ছিলেন প্রথম

জাতীয় অধ্যাপক ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা জামিলুর রেজা চৌধুরী গত মঙ্গলবার ভোররাতে চলে গেলেন না ফেরার দেশে।

ওই রাতে ধানমন্ডির বাসায় জামিলুর রেজা চৌধুরী ঘুমিয়ে ছিলেন। ভোরে সাহরির সময় তাঁর স্ত্রী তাঁকে ডাক দেন। কোনো সাড়া না পাওয়ায় তাঁকে স্কয়ার হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক। চিকিৎসকেরা জানান, হাসপাতালে আনার আগেই তিনি মারা গেছেন।

জামিলুর রেজা চৌধুরীর বয়স হয়েছিল ৭৭ বছর। তিনি সর্বশেষ ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের (ইউএপি) উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন।

অধ্যাপক ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী ছিলেন দেশের একজন খ্যাতনামা প্রকৌশলী, গবেষক, শিক্ষাবিদ, বিজ্ঞানী, ও সর্বোপরি তথ্য-প্রযুক্তিবিদ। তাঁর মধ্যে ছিল সকল আদর্শিক গুনাবলী বিদ্যমান। সর্বক্ষেত্রেই তিনি ছিলেন প্রথম।

বিভিন্ন ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রাখার স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি পেয়েছেন একুশে পদকসহ নানা সম্মাননা। সর্বশেষে তিনি মনোনিত হয়েছিলেন ‘জাতীয় অধ্যাপক’ হিসেবে। প্রকৌশলী সমাজের মধ্যে একমাত্র তিনিই এই সম্মান পেয়েছেন। 

ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী ১৯৪২ সালের ১৫ নভেম্বর সিলেট শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা প্রকৌশলী আবিদ রেজা চৌধুরী এবং মা হায়াতুন নেছা চৌধুরী। তিন ভাই দুই বোনের মধ্যে তার অবস্থান তৃতীয়। ড. জামিলুর রেজা চৌধুরীর শৈশবকাল ছিল বিচিত্র অভিজ্ঞতায় পরিপূর্ণ। বাবার চাকরির সুবাদে দেশের বিভিন্ন জায়গায় তার শৈশবকাল কেটেছে। তিন বছর বয়সে সিলেট ছেড়ে পরিবারের সঙ্গে চলে যান আসামের জোড়হাটে। ১৯৪৭ সালের আগস্টে আবার সিলেটে ফিরে আসেন।

এরপর তার বাবা বদলি হয়ে ময়মনসিংহে চলে যান। সেন্ট গ্রেগরিজ স্কুল থেকে তিনি ১৯৫৭ সালে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেন। এরপর ঢাকা কলেজ থেকে ১৯৫৯ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। এরপর ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার জন্য তিনি ভর্তি হন আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমানে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়)। ১৯৬৩ সালে তিনি প্রথম বিভাগে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন।

বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ফলাফল প্রকাশের কয়েকদিন পর নিয়োগপত্র ছাড়াই বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নেন তিনি। পরবর্তী সময়ে ১৯৬৩ সালের নভেম্বর মাসে তিনি প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন পুরকৌশল বিভাগে। এভাবেই তার শিক্ষকতা জীবন শুরু হল। ১৯৬৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বার্মাশেল বৃত্তি নিয়ে চলে যান ইংল্যান্ডে। এই বৃত্তি বছরে একটাই দেওয়া হতো। সাউদাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি এমএসসি করেন, অ্যাডভান্স স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে। থিসিসের বিষয় ছিল, কংক্রিট বিমে ফাটল।

১৯৬৮ সালে তিনি কম্পিউটার এইডেড ডিজাইন অব হাইরাইজ বিল্ডিং বিষয়ের উপর পিএইচডি করেন। পিএইচডি শেষ করে দেশে ফিরে তিনি বুয়েটের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। এরপর ১৯৭৩ সালে সহযোগী অধ্যাপক ও ১৯৭৬ সালে অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি পান। ২০০১ সাল পর্যন্ত বুয়েটে অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এর মধ্যে কখনো বিভাগীয় প্রধান ছিলেন, ডিন ছিলেন। বুয়েটের কম্পিউটার সেন্টারের পরিচালক ছিলেন প্রায় ১০ বছর।

১৯৭৯ সালে ব্যাংককে টঘঊঝঈঅচ-এ কয়েক মাস পরামর্শক হিসেবে ছিলেন। ১৯৭৪-১৯৭৫ সালে কমনওয়েলথ স্কলারশিপ নিয়ে তিনি যুক্তরাজ্যের সারে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং এসোসিয়েট প্রফেসর ছিলেন। ১৯৯৬ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোন ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী। তিনি বিদ্যুত জ্বালানি ও খনিজসম্পদ এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় বিষয়ক উপদেষ্টা ছিলেন।

এরপর ২০০১ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত তিনি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৯৭ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম বিআইটির গভর্নিং বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন। বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংকের পরিচালক পর্ষদের চেয়ারম্যান ছিলেন ১৯৯৬ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত। তিনি ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন যুক্তরাজ্যের সিভিল ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের ফেলো, যুক্তরাজ্যের একজন চার্টার্ড ইঞ্জিনিয়ার এবং বাংলাদেশ কম্পিউটার সোসাইটির ফেলো।

১৯৯২ থেকে ১৯৯৩ পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের সভাপতি ছিলেন। বাংলাদেশ আর্থকোয়েক সোসাইটি এবং বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা), বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। অধ্যাপক চৌধুরী বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনের সফটওয়্যার রফতানি এবং আইটি সার্ভিস রপ্তানী-সংক্রান্ত টাস্ক ফোর্সের চেয়ারম্যান ছিলেন ১৯৯৭ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত। তিনি প্রধানমন্ত্রীর আইসিটি টাস্কফোর্সেরও একজন সদস্য ছিলেন। এছাড়া তিনি আরও অসংখ্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও জড়িত ছিলেন। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের উপাচার্যের দায়িত্বে ছিলেন।

দেশে-বিদেশে বিভিন্ন অবদানের জন্য সমাদৃত জামিলুর রেজা চৌধুরীর ৭০টি গবেষণা-প্রবন্ধ রয়েছে। তিনি একুশে পদক (২০১৭), শেলটেক পুরস্কার (২০১০), বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউশন স্বর্ণপদক (১৯৯৮), ড. রশিদ স্বর্ণপদক (১৯৯৭), রোটারি সিড অ্যাওয়ার্ড (২০০০), লায়ন্স ইন্টারন্যাশনাল (ডিস্ট্রিক-৩১৫) স্বর্ণপদক, জাইকা রিকগনিশন অ্যাওয়াডসহ নানা পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেছেন। তিনি ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি পেয়েছেন। তিনিই একমাত্র বাংলাদেশি, যিনি একটি ব্রিটিশ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকৌশল বিষয়ের ওপর এ ধরনের ডিগ্রি পেয়েছেন।

পারিবারিক জীবনে অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীর স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছেন। তাঁর স্ত্রীর নাম সেলিনা নওরোজ চৌধুরী; তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফলিত পদার্থবিদ্যায় মাস্টার্স ডিগ্রিধারী। বড় সন্তান (মেয়ে) কারিশমা ফারহিন চৌধুরী পেশায় পুরকৌশলী এবং ছোট সন্তান (ছেলে) কাশিফ রেজা চৌধুরী ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিগ্রী করেছেন।

গত বছরের ১৯ জুন সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সাবেক শিক্ষক ও ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের উপাচার্য অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ পান।

তাঁর বাবা আর ভাইসহ পরিবারের অনেক সদস্যই প্রকৌশলী ছিলেন। বড় হয়ে তাঁর বাবা ও ভাইদের মতো তিনিও বেছে নেন এই পেশা।

স্বাধীনতার পর এ দেশে যত বড় বড় ভৌত অবকাঠামো তৈরি হয়েছে, তার প্রায় প্রতিটির সঙ্গেই জামিলুর রেজা চৌধুরী কোনো না কোনোভাবে জড়িত ছিলেন। যুক্ত ছিলেন বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে। হাত দেন পদ্মা সেতু নির্মাণের বিশাল কর্মযজ্ঞে।

জামিলুর রেজা চৌধুরী একসময় যুক্তরাষ্ট্রে কাজের ডাক পেয়েছিলেন বিখ্যাত আরেক বাংলাদেশি প্রকৌশলী এফ আর খানের কাছ থেকে। এভাবে দেশে-বিদেশে অনেক সম্মান কুড়িয়েছেন এ গুণী মানুষ।

শেষ পর্যন্ত সৃষ্টিকর্তার ডাকে চিরদিনের জন্য চলে গেলেন ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী। তাঁর মৃত্যুতে জাতি হারালো এক প্রখর প্রতিভাবান পুরুষ।