Cinque Terre

ইব্রাহীম চৌধুরী খোকন

০২ জুন , ২০২৫


সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক ও সম্পাদক- প্রথম আলো উত্তর আমেরিকা
দেখা হওয়াটা জরুরি নয়, এনাম


ফিলাডেলফিয়ার আকাশে হঠাৎ মেঘের গর্জন। বইমেলা ঘিরে কোলাহল জমে উঠেছে, শনিবার দুপুর পেরিয়ে গেছে অনেক আগেই। এমন সময় মঞ্চে উঠার ডাক এলো। কণ্ঠস্বর প্রস্তুত করছি, ঠিক তখনই সাংবাদিক হেলাল উদদীন রানার ফোন। ফোন ধরতেই স্থির হয়ে গেল চারপাশ। তিনি জানালেন-এনামুল মুনীর আর নেই। ঘড়ি দেখতে হলো না, জানলাম ১২টা বেশ আগেই বেজে গেছে!  

হাজার মাইল দূরে দাঁড়িয়ে এমন সংবাদ নিয়ে কথা বলা যায় না। মঞ্চে উঠে কেবল জানাতে পেরেছিলাম, আমার দীর্ঘ সময়ের সাথী, সংস্কৃতির মাটিতে পা রেখে পথ চলা এনামুল মুনির আর নেই। বাকিটা আর বলা সম্ভব হয়নি। গলার স্বর কেঁপে ওঠে, কথারা দলা পাকায়। মিলনায়তনে মুহূর্তের নিস্তব্ধতা নেমে আসে। জনকোলাহলের মাঝে শোকের ছায়া যেন ছড়িয়ে পড়ে, বাষ্পরুদ্ধ শ্রোতারা নীরবে অশ্রুপাত করেন এক সংস্কৃতি যোদ্ধার জন্য।


আমার ও এনামুল মুনীরের সম্পর্ক শুরু হয়েছিল সিলেটের দরগা গেইট এলাকায়। তখন আমি রাজনীতির মাঠে পুরোদস্তুর কর্মী। একপর্যায়ে নাট্য সংগঠন ‘নাট্যায়ন’-এ যুক্ত হই। এনামকে পাই এক প্রাণখোলা তরুণ হিসেবে।  রুহুল আজাদ চৌধুরী, নিজাম উদ্দিন লস্কর ময়না, আব্দুর রাজ্জাক-তাঁদের সঙ্গে এনামের ছিল প্রাণখোলা সম্পর্ক।  এমন সান্নিধ্যে সহজেই এনামের সঙ্গে সখ্য গড়ে উঠলো। তর্ক, বিতর্ক, আলোচনায় আমি প্রায়ই তাকে আমার পক্ষে দাঁড়াতে দেখতাম। এনামকে কেবল একজন নাট্যকর্মী হিসেবেই দেখিনি, সময়ের ক্ষুব্ধ প্রজন্মের এক প্রজ্ঞাবান কণ্ঠস্বর হিসেবে পাশে পেয়েছিলাম। মঞ্চে, আড্ডায়, বেতারে, প্রান্তিক চত্বরে, রাজপথে, সঙ্গোপন পরামর্শের অগুনতি বৈঠকের স্মৃতি!

স্বাধীনতা-পরবর্তী বৈরী রাজনৈতিক জলবায়ুতে আমরা বেড়ে উঠেছি। সময়টা ছিল সংগ্রামের, দ্বন্দ্বের, আর হতাশা পেরিয়ে আলো খোঁজার সময়। রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক টানাপোড়েনের বৈরী সময়টি। ক্ষুব্ধ প্রজন্মের লড়াকু প্রতিনিধি হিসেবে প্রত্যাশার আকুতিতে আমরা জ্বলছিলাম। যাত্রাপথের বাঁকে বাঁকে ছিল নানা ফাঁদ। সময়ের সেসব ফাঁদে পড়ে কতো যৌবন নিঃশেষ হয়েছে মুক্তির আকুতিতে, সে এক ভিন্ন আলোচনা। এনামুল মুনীরের মৃত্যু সংবাদের সঙ্গে ভাবনাটি প্রাসঙ্গিক হয়ে বুকে লাগছে। ফিরে দেখছি। অনেক প্রশ্ন, অনেক অমীমাংসিত বিষয়। সেই সময়ের অনেক প্রজন্ম যেমন হারিয়ে গিয়েছে আত্মসংকটে, এনাম তেমনি নিজেকে গড়ে তুলেছিল প্রতিবাদের সৌন্দর্যে, সাহসিকতার ভাষায়।

এনাম ছিল আমার সাহচর্যের একজন একনিষ্ঠ সঙ্গী-নাট্য মঞ্চে, বেতারে, রাস্তায়-রাস্তায়, জনগণের পাশে।   দুঃসময়কালে এনামুল মুনীর ছিল আমার ছায়া, বিশ্বাসী সাথী। আমরা একসাথে দাঁড়িয়েছি, একসাথে লড়েছি, একসাথে স্বপ্ন দেখেছি। স্বৈরশাসন বিরোধী সাংস্কৃতিক আন্দোলন, তেল গ্যাস আন্দোলন, সিলেট বিভাগ আন্দোলনসহ নানা সময়ে এনামকে পাশে পাওয়া গেছে। নিজেদের বিশ্বাস আর করণীয় নিয়ে অকপট উচ্চারণের একনিষ্ট সমর্থক হিসেবে এনামুল মুনীরকে সবসময় পেয়েছি।

বিদেশ বিভুঁইয়ে আসার পর যেমন হয়-বিচ্ছিন্নতা আসে। কিন্তু এনামের সঙ্গে যোগাযোগ কখনো ছিন্ন হয়নি। সে ছিল আমার লেখা প্রতিটি বইয়ের পাঠক, প্রতিক্রিয়াশীল আলোচক। শুধু প্রশংসা করেনি, প্রয়োজন মতো সমালোচনা করত, চিন্তায় জাগরণ আনত। 

শেষবার দেশে গেলে শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে সে বিদায় জানিয়েছিল-

“আবার দেখা হবে ভাই।”

হেসে বলেছিলাম-

“আবার দেখা হওয়াটা জরুরি নয় এনাম”

আমার কাঁধে হাত রেখে চুপ করে দাঁড়িয়েছিল অনেকক্ষণ। কিছু শব্দ, কিছু স্পর্শ জীবনের চেয়েও দীর্ঘায়ু।

আজ ভাবছি-তোমার চলে যাওয়ার এই মুহূর্তে, কার কাছে বলব আমাদের পারা, না-পারার কথাগুলো? কার কাছে রাখব না-করা স্বপ্নের দীর্ঘশ্বাস? তুমি ছিলে এমন এক কণ্ঠস্বর, যে উচ্চারণ করতো আমাদের না-পারার গ্লানি, হাহাকার আর প্রতিজ্ঞার আকুতি। 

চলে গেছো, এনাম। চলে যাওয়ার অর্থ যে ভুলে যাওয়া নয়। তুমি আছো সেই শহরের ধুলিকণায়, যেখানে আমরা একদিন কোলাহলে ডুবে যেতাম। তুমি আছো সেই মানুষের হৃদয়ে, যারা তোমার সঙ্গ পেয়েছিল, তোমার সাহস দেখেছিল, তোমার মতো করে ভালোবাসতে শিখেছিল।

এনামের মৃত্যুর খবর বুকের গভীরে এক ফাটলের মতো বেজে চলেছে। সে শব্দ থামবে না। জানি, সামাজিক সাংস্কৃতিক অঙ্গণের অনেকরেই আজ বিলাপ উঠবে। নীরবে অশ্রু ঝরবে।

ঝরুক! ঝড় উঠুক ! বৃষ্টি নামুক অঝোর ধারায়।  

একজন এনামুল মুনীরের জন্য এমন অশ্রুধারা খুবই প্রাকৃতিক, খুবই প্রাসঙ্গিক!

এনাম, তুমি জীবনকে যাপন করোনি শুধু, জীবনকে অর্থ দিয়েছিলে। প্রতিবাদ দিয়েছিলে, প্রেম দিয়েছিলে, পথ দেখিয়েছিলে।

তোমার জন্য আমাদের অনেকের হৃদয়ে রয়ে যাবে এই অনুচ্চারিত শোকগাথা। যখন কোনো আড্ডায় তোমার নাম উঠবে, বলব- 

দেখা হওয়াটা জরুরি ছিল না, এনাম।

পথ চলায় তোমার অবিনাশী উপস্থিতির জন্য ধন্যবাদ। চলে যাওনি-শুধু রূপ নিয়েছ আমাদের স্মৃতির মর্মরে। 

‘মৃত্যু’ নিয়ে জীবনানন্দ দাশ যেমন বলেছেন-

মৃত্যু একদিন আসবেই- 

এই নিয়তি চিরন্তন, কিন্তু সেই দিন,

আমি যেন থাকি মেঘে ঢাকা সন্ধ্যায়,

মাঠের ধারে একা।

না থাকুক কোলাহল, না থাকুক শোক,

শুধু থাকুক বাতাসে আমার পরিচিত গন্ধ-

আর একটি নাম- যেন কেউ আস্তে বলে, 

‘সে ছিল, সে আজও থাকে...’




এএফ/০২